কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

২০২৫ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নানা ভাবনা

ড. কানন পুরকায়স্থ । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫

২০২৫ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নানা ভাবনা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) এই ভাবনার শুরু বলা যেতে পারে ১৯২৮ সালে যখন অস্ট্রিয়ান গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্ট প্রশ্ন তোলেন—এমন কোনো অ্যালগরিদম বা পর্যায়-পরম্পরা আছে কি, যা সিদ্ধান্ত দেবে যুক্তির নিয়ম ব্যবহার করে উপস্থাপিত কোনো বর্ণনা সঠিক কি না? বার্ট্রান্ড রাসেলের আত্মবিরোধী অথচ সত্য যুক্তি থেকে শুরু করে কূর্ট গডলের অসম্পূর্ণতার তত্ত্ব ব্যবহার করে হিলবার্টের এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যুক্তিবাদীরা যখন হিমশিম খাচ্ছেন, তখন কেমব্রিজের এক নবীন গণিতবিদ অ্যালান টুরিং  তাত্ত্বিকভাবে একটি কম্পিউটার মেশিনের ধারণা উপস্থাপন করেন। সেটি ১৯৩৫ সালের কথা। এই ধারণা থেকে পরবর্তীকালে লন্ডন ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটিতে টুরিং একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, যার শিরোনাম ছিল, ‘On computable numbers with an application to the Enstscheidungsproblem’।

 

এই শিরোনামের সর্বশেষ শব্দটি একটি জার্মান শব্দ, যা হিলবার্টের উপরোল্লিখিত প্রশ্নকে নির্দেশ করছে। এভাবে নানা বিবর্তনের পথ ধরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-এর জন্ম হলো। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে যুক্তরাজ্যের  তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের আহ্বানে লন্ডনে প্রথম গ্লোবাল এআই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল এআইয়ের ঝুঁকিকে কিভাবে কমানো যায় এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এআইকে কিভাবে ব্যবহার করা যায়। সম্মেলন শেষে এআই নিরাপত্তা বিষয়ে ‘দ্য ব্লেচলি ডিক্লারেশন’ ঘোষণা করা হয়।

 

 

এর মূল বিষয় হচ্ছে প্রতিটি দেশ এআই অবমুক্ত করার আগে এর ঝুঁকি সম্পর্কে মূল্যায়ন করবে। ২০২৫ সালে এআই কিভাবে বিজ্ঞান ও সমাজের নানা ক্ষেত্রে  প্রয়োগ করা হবে সে বিষয়ে কিছু উদাহরণ এই নিবন্ধে উল্লেখ করব। প্রথমত, জলবায়ুর মডেল থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করা এখন গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই মডেল চরম আবহাওয়ার ঘটনার পূর্বাভাস দিতে পারে, যা প্রশমন এবং অভিযোজনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

 

 


সুইডিশ বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস প্রথম পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা এবং বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলেন। যাহোক, সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্ত সরকারি প্যানেলের (আইপিসিসি) এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে কার্বন ডাই-অক্সাইড দ্বিগুণ হলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাওয়ার ‘খুবই সম্ভাবনা’ রয়েছে। বৈজ্ঞানিকভাবে আমরা জানি যে বেশির ভাগ অনিশ্চয়তা অ্যারোসল এবং মেঘের আচরণ থেকে উদ্ভূত হয়। কারণ উভয়ের ক্ষেত্রেই  সূর্যালোককে প্রতিফলিত করে শীতল প্রভাব বা তাপ শোষণ করে উষ্ণতার প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। ২০২৫ সালে জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করে জলবায়ুবিজ্ঞানের অগ্রগতি সাধিত হবে, যা জলবায়ু মডেলের অনিশ্চয়তা কমাতে সাহায্য করতে পারে এবং সঠিকভাবে আবহাওয়া সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব হবে।

 

 

দ্বিতীয়ত, এআইভিত্তিক গবেষণাবিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছে। ২০২০ সালে গুগলের মালিকানাধীন ডিপ মাইন্ডের তৈরি একটি মডেল আলফা ফোল্ড মানবদেহের প্রতিটি প্রোটিনের গঠন সম্পর্কে সঠিকভাবে পূর্বাভাস দিয়েছে। ২০২৪ সালের মে মাসে আলফা ফোল্ড-৩ অন্যান্য অণু যেমন ডিএনএ, আরএনএ এবং ছোট অণুর গঠন বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা এআই-এর আরো অগ্রগতি এবং ২০২৫ সালে ওষুধ আবিষ্কার সম্পর্কিত গবেষণায় এর ব্যবহার দেখতে পাব।

 

 ওপেন এআই-এর জিপিটি-৫ প্রকাশ করার পরিকল্পনা রয়েছে, যেখানে জিপিটি মানে হচ্ছে জেনারেটিভ প্রাক-প্রশিক্ষিত ট্রান্সফরমার, যা একটি বড় ভাষার মডেল। মানুষ যেভাবে চিন্তা করতে সময় নেয় এবং সমস্যার উত্তর দেয় সেভাবে এআই কাজ করবে বলে ধারণা করা যায়। এআই গবেষকরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছেন যুক্তিনির্ভর একটি প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দেওয়া যায়। নিউ মেক্সিকোর সান্তা ফি ইনস্টিটিউটের গবেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন যে কী বিষয় যুক্তি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। এ বিষয়ে একটি শক্তিশালী উপায় এআই এখনো বের করতে পারেনি। এ নিয়ে গবেষণা অগ্রসরমাণ।

 

 

২০২৫ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নানা ভাবনাতৃতীয়ত, ২০২৫ সালে হিউম্যানোয়েড বা যন্ত্রমানবের  নানা ব্যবহার লক্ষ করা যাবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ব্যবহার করে এই মানবসদৃশ রোবটের দুই হাত ও দুই পা মানুষের মতো ব্যবহার করা হবে। যেমন—গাড়ি তৈরির কারখানায় এ ধরনের যন্ত্রমানব ব্যবহার করে যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হবে। এরই মধ্যে বিএমডাব্লিউ গাড়ির কারখানায় এ ধরনের যন্ত্রমানবের ব্যবহার শুরু হয়েছে। ইলন মাস্ক জানিয়েছেন যে তাঁর কম্পানি টেসলা ২০২৫ সালে ‘অপটিমাস রোবট’ তৈরি শুরু করবে। বিভিন্ন গুদামে এই মানবসদৃশ্য রোবট ব্যবহার করবে।

 

 

অরিগনের ‘এজেলিটি রোবটিকস’ ২০২৫ সালে ব্যাপক হারে যন্ত্রমানব তৈরি করবে। আপাতত তাদের লক্ষ্যমাত্রা বছরে ১০ হাজার রোবট। রোবট প্রযুক্তিতে এআইকে সাফল্যজনকভাবে ব্যবহারের ফলে এ ধরনের যন্ত্রমানব অতিসত্বর হাসপাতালে, বিভিন্ন কফির দোকানে এবং মানুষের বাড়িতে ঘরের নানা কাজ সম্পাদনের জন্য ব্যবহার করা হবে। উল্লেখ্য, রোবটের একটি হাতকে সম্পূর্ণরূপে মানুষের হাতের মতো ব্যবহার করা এখনো সম্ভব হয়নি। কারণ এআই-নির্ভর রোবট শুধু সুনির্দিষ্ট যুক্তির ভিত্তিতেই কাজ করতে সক্ষম। এ বিষয়ে নিয়ে চলছে ব্যাপক গবেষণা।

 

 

চতুর্থত, মহাকাশশিল্পে আগে থেকেই এআই ব্যবহার হচ্ছে, তবে ২০২৫ সালে এই শিল্পে এআই ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হবে। কারণ চন্দ্রপৃষ্ঠের বেশ কয়েকটি অভিযান সম্পন্ন করার কথা এ বছর, যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে চন্দ্রপৃষ্ঠে মানুষের স্থায়ীভাবে অবস্থান নিশ্চিত করা। স্পেস এক্সের স্টারশিপ, নাসার আর্টিমিস মিশন এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তা ছাড়া রাশিয়া, চীন, ভারত এবং জাপানের বিভিন্ন প্রকল্প এই লক্ষ্যে কাজ করছে। এসব প্রকল্পে এআই চন্দ্রপৃষ্ঠ এবং মহাকাশের অন্যান্য স্থান থেকে বৈজ্ঞানিক উপাত্ত সংগ্রহ করতে সহায়তা করবে।

 

 

পঞ্চমত, এআইকে আদালতে ব্যবহার করার চিন্তা-ভাবনা চলছে এখন। বিচার বিভাগের বিভিন্ন কাজে স্বচ্ছতা আনা এবং সত্যকে উদঘাটনের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হবে এআই। যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর নানা দেশে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন শুরু হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এআই যদি ভুল করে তাহলে আমরা কাকে দায়ী করব। এআই কি চেতনাসমৃদ্ধ একটি মেশিন, না চেতনাবিহীন? কেউ কেউ প্রস্তাব করছেন, এআই ওয়েলফেয়ার অফিসার নিয়োগ করতে হবে, যিনি এআইয়ের কর্মকাণ্ডে নৈতিকতার বিষয়টি দেখবেন এবং এর ঝুঁকি নির্ধারণ করবেন।

 

 

বস্তুত এআই অ্যালগরিদমগুলো কী বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা করছে তা বোঝার জন্য আমাদের একটি উপায় দরকার। সাইবার ক্রাইম ব্যাপক এবং দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এআই বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা হুমকির একটি প্রধান অংশ হবে, যা আমাদের ডিজিটাল, শারীরিক এবং রাজনৈতিক নিরাপত্তাকে গুরুতরভাবে প্রভাবিত করবে। বর্তমানে ব্যবহৃত অনেক এআই সিস্টেম গভীরভাবে পক্ষপাতদুষ্ট। উদাহরণস্বরূপ বীমা প্রিমিয়ামের পরিমাণ নির্ধারণ থেকে বাণিজ্যিক বিভিন্ন বিষয়ে পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত এআই দিতে পারে। এমনকি এ ধরনের পক্ষপাতমূলক এআই প্রগ্রাম ব্যবহার করে বিচার বিভাগীয় সাজা প্রদানের সিদ্ধান্তগুলোও কালো মানুষের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করতে দেখা গেছে।

 

 

গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ উল্লেখ করেছেন যে বড় করপোরেশনগুলো আমাদের ডাটা শোষণ করছে, তাই এ বিষয়ে আমাদের খুব উদ্বিগ্ন হওয়া দরকার। তাঁর ভাবনায় আমরা লক্ষ করি এআই শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এর অর্থ বৈজ্ঞানিক বস্তুনিষ্ঠতার নামে কেউ ডাটা নিজের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করতে পারে এবং একটি অ্যালগরিদম তৈরি করতে পারে, যা মেশিনের পেছনে থাকা ব্যক্তির ইচ্ছানুসারে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত প্রদান করতে পারে।

 

 

কবি টি এস এলিয়ট কফির চামচ দিয়ে তাঁর জীবন পরিমাপ করার চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সময়ে, তিনি ফেসবুক, টুইটার, ই-মেইল এবং মোবাইল ফোনের কথা শুনতে পাননি। এই জিনিসগুলো এখন আমাদের জীবন পরিমাপ করছে এবং আমাদের উদ্বিগ্ন করছে। এ কারণেই প্রযুক্তির পেছনে ছুটে চলার তীব্র চাপ থেকে যে রোগে আক্রান্ত হয় তার জন্য জার্মানরা একটি নুতন শব্দের ব্যবহার শুরু করেছে, তা হলো ‘ইলক্রানখাইট’ বা Eilkrankheit, যা এখন ইংরেজিতে গৃহীত হয়েছে। এআই আমাদের জীবনের বিভিন্ন স্তরে এই Eilkrankheit সংক্রমিত করছে।

 

 

সর্বোপরি আমরা একটি ডিজিটাল সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রে প্রবেশ করছি, যেখানে কম্পিউটারের মতো মানুষদের বিশেষ উদ্দীপনায় সাড়া দিতে, নির্দিষ্ট উপায়ে কাজ করতে এবং এমনকি কিছু জিনিস বিশ্বাস করতে রাজি করানোর জন্য খুব কার্যকরভাবে প্রগ্রাম করা যায়। মার্গারেট অ্যাটউড তাঁর বই ‘দ্য বার্নিং কোয়েশ্চন’-এ উল্লেখ করেছেন যে ‘ক্ষমতা নৈতিকভাবে নিরপেক্ষ। এমন কিছু নেই যা বলে যে এটি ভালো, এমন কিছু নেই যা বলে যে এটি খারাপ। বিদ্যুৎ আপনার বাতি জ্বালাতে পারে বা আপনার ঘর পুড়িয়ে দিতে পারে; তাই এটি মানুষের শক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত।’ এআই-এর ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। এটি মানবতার জন্য ভালো ও খারাপ উভয় জিনিসই করতে পারে। এ কারণেই পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, ‘এআই সম্ভবত মানবতার জন্য সবচেয়ে ভালো বা সবচেয়ে খারাপ জিনিস হতে পারে।’ এ বিষয়গুলোকে বিবেচনায় রেখেই ২০২৫ সালে আমাদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এআইয়ের ব্যবহার ঝুঁকি নির্ধারণের ভিত্তিতে নিশ্চিত করতে হবে।

 

 

 লেখক : যুক্তরাজ্যে কর্মরত বিজ্ঞানবিষয়ক উপদেষ্টা ও অধ্যাপক