কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বীজ বপন

মো. জাহিদ হোসেন । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বীজ বপন

যদি কোনো জাতির নিজস্ব সত্তাকে স্থায়ীভাবে বিলীন করতে হয়, তাহলে আঘাত করতে হয় তার সংস্কৃতিতে। হয়তো সেই অভিলাষ চরিতার্থ করতেই ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের সঙ্গে সঙ্গেই শাসকচক্র পূর্ব বাংলার সংস্কৃতির মূলভিত্তি, ভাষার ওপর করে কুঠারাঘাত। এরই পরিক্রমায় সৃষ্টি হয় এক অমর দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি, যার ইতিহাস কষ্টের হলেও বাংলার ঐতিহ্যে দান করেছে গর্বিত অধ্যায়। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে ফজলুল হক তাঁর বক্তৃতায় প্রথম পাকিস্তান প্রস্তাব পেশ করেন।

 

মূলত সেখানেই ফজলুল হকের বক্তব্যের পর পাঞ্জাববাসী তাঁকে ‘শের-ই-বঙ্গাল’ বা শেরেবাংলা উপাধিতে ভূষিত করে। লাহোর প্রস্তাবটি ছিল যে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব এলাকাগুলোর মতো যেসব অঞ্চলে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেসব অঞ্চলে ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ (স্টেটস) গঠন করতে হবে, যার মধ্যে গঠনকারী এককগুলো হবে স্বশাসিত ও সার্বভৌম।

 

১৯৪১ সালের ১৫ এপ্রিল মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে লাহোর প্রস্তাবকে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্রে একটি মৌলিক বিষয় হিসেবে সন্নিবেশ করা হয়। কিন্তু ১৯৪৬ সালে মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার সময় এই প্রস্তাবকে সামান্য পরিবর্তন করে উপস্থাপন করা হয়।

 

এখানে ‘স্টেটস’ শব্দটিকে একবচন শব্দ ‘স্টেট’-এ পরিবর্তন করা হয়। এই পরিবর্তন মূল লাহোর প্রস্তাবের মৌলিক পরিবর্তন সাধন করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের উত্তর-পূর্ব দিকে বাংলা ও আসাম নিয়ে এবং উত্তর-পশ্চিম দিকে পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান সমন্বয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো নিয়ে একটি সার্বভৌম স্বাধীন ‘রাষ্ট্র’ গঠন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়, যা মূলত একটি রাষ্ট্র, পাকিস্তানেরই নামান্তর। কৌশলে সেদিন বহুবচনকে একবচনে রূপান্তর না করলে হয়তো বাংলাদেশের জন্ম আরো ২৩ বছর আগেই হতে পারত।

 

 

১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারত নামে ধর্মভিত্তিক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয় এই অঞ্চলে। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এই বাংলা যেমন পরাধীন ছিল ব্রিটিশ কলোনির কাছে, ঠিক একইভাবে আবারও পরাধীনতার শিকল নেমে আসে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্রের দ্বারা। প্রথমেই তারা আগ্রাসনের লক্ষ্যবস্তু করে এই অঞ্চলের ভাষাকে। মূলত পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই এই রাষ্ট্রের ভাষা কী হবে, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তান সৃষ্টি যখন সুনিশ্চিত, তখন ভাষা নিয়ে এই বিতর্ক আরো ঘনীভূত হয়।

 

 

 

মে মাসে চৌধুরী খলীকুজ্জামান এবং জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। এর বিরুদ্ধে শুরু হয় ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহাম্মাদ এনামুল হকসহ এই অঞ্চলের বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবাদ।

 

১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে তমদ্দুন মজলিস নামক একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। ওই সংগঠনের সদস্যরা বাংলাকে ‘শিক্ষা ও আইন-আদালতের বাহন’ করার প্রস্তাব করেন। ডিসেম্বর মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত হলে পূর্ব বাংলায় প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। সেই মাসেই গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এরপর ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদে এর সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের দাবি জানান। সেটি অগ্রাহ্য হয়।

 

 

এরপর ১৯ মার্চে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘উর্দু এবং কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ ২৪ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনেও তিনি অনুরূপ ঘোষণা দিলে ছাত্রসমাজ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে পাকিস্তান সরকার আরবি হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগ নেয়। এর বিরুদ্ধেও পূর্ব বাংলার জনগণ তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানায়। 

 

 

১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি সারা দেশে ধর্মঘট পালিত হয়। ৩১ জানুয়ারিতে নতুনভাবে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয় এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত হয়।

 

 

সরকার ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে। আন্দোলনকারীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা মেডিক্যালের দিক থেকে মিছিল নিয়ে এগোতে থাকে। পুলিশ প্রথমে লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করলেও পরবর্তী সময়ে গুলিবর্ষণ করে। শহীদ হন বরকত, জব্বার, রফিকসহ আরো অনেকেই। প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি শোকযাত্রা বের করা হয়। সেখানে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান।

 

 

পরের দিন শহীদদের স্মৃতি অমর করে রাখার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়, যা ২৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ভেঙে ফেলে। শহীদ মিনার ভেঙে ফেললেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাঝে যে চেতনা জাগ্রত হয়, তা ছিল অমর। ভাষার দাবিতে করা আন্দোলন থেকে বাঙালি জাতি উপলব্ধি করে যে তাদের রয়েছে একটি পৃথক সত্তা, নিজস্ব সংস্কৃতি। তারা পাকিস্তানি নয়, তারা বরং একটি স্বতন্ত্র জাতি। আর এই অনুপ্রেরণার কাছে পরাস্ত হয়েই পাকিস্তানি শাসকরা বাধ্য হয় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে।

 

 

মূলত এই আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়াস পায়। আর ঐক্যবদ্ধ মানসিকতাই তাদের মাঝে জাতীয় সংহতির চরম সঞ্চার ঘটায়। তারা বুঝতে পারে যে কেবল ধর্মের ভিত্তিতে আবদ্ধ থেকে হাজার মাইল দূরের এই সম্পর্ক অব্যাহত রাখা কঠিন। এই আন্দোলনেই পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখণ্ডের দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তাকে মিলিয়ে সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের অধিবাসীদের মনে এক হওয়ার অনুভূতি সম্ভবত আর জাগ্রত হবে না। বাঙালি জাতির চেতনা ও একতার চরম বিস্ফোরণ গড়ায় মুক্তিযুদ্ধে। আর সেখানেও জীবন দিয়ে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা। একটি পরাধীন ও নিষ্পেষিত জাতি পায় একটি স্বাধীন দেশ। এর পশ্চাতেও রয়েছে একুশের চেতনা।

 

 

আসলে ভাষার জন্য যে কেবল বাঙালিরাই জীবন দিয়েছে, এমনটি নয়। আরো অনেক জাতিই ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। ১৯৬৫ সালে ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকার রাষ্ট্রভাষা হিন্দি করলে মাদ্রাজের জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। মানুষ রাস্তায় নেমে আসে দলে দলে। প্রায় দুই মাস ধরে দাঙ্গা হয় দক্ষিণে, বিশেষ করে মাদ্রাজে। শতাধিক লোকের মৃত্যু হয়। সারা দক্ষিণ ভারত, বিশেষ করে তামিলনাড়ু উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এর প্রতিবাদে আত্মাহুতির ঘটনাও ঘটে। পরবর্তী সময়ে সরকার তার একপেশে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। কিন্তু পরবর্তী নির্বাচনে সেই প্রদেশে কংগ্রেসের হয় ভরাডুবি।

 

 

দক্ষিণ আফ্রিকার ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা। ১৯৭৬ সালে তৎকালীন ট্রান্সভাল প্রদেশে আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ আফ্রিকানার ভাষায় (দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসরত শ্বেতাঙ্গ ডাচদের জার্মান-ডাচ ভাষার মিশ্রণ) শিক্ষাদান স্কুলে বাধ্যতামূলক করলে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। তারা তাদের মাতৃভাষা জুলু এবং ব্যাবহারিক লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা ইংরেজিতে শিক্ষা নিতে বেশি আগ্রহী ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবাদ সভা ডাকা হয়। এ ঘটনাকে বলা হয় সুয়েটো অভ্যুত্থান। তৎকালীন বর্ণবাদী সরকার নির্বিচারে গুলি করে শতাধিক শিক্ষার্থীকে হত্যা করে। এই ট্র্যাজেডির দিনটিকে বলা হয় ‘ডে অব চাইল্ড’। যুক্তরাষ্ট্রে অনেক নেটিভ আমেরিকান ভাষা ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা বিলীন হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে সেই ভাষা রক্ষার দাবিতে আন্দোলন ও জীবন দেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র আদি ভাষা রক্ষায় একটি আইন প্রণয়ন করে।

 

 

বাঙালির গর্বিত সেই ইতিহাসে আরেকটি নতুন মাত্রা যোগ হয় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর, যখন ইউনেসকো বাংলাদেশের শহীদ দিবস ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বাঙালির সেই ভাষা দিবসকে আজ সমগ্র বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করছে, যা সব বাংলাদেশিকে করছে গর্বিত। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক জুলাই অভ্যুত্থান পর্যন্ত বাঙালির যত ক্রান্তিলগ্ন এসেছে, সব ক্ষেত্রেই সর্বাগ্রে এগিয়ে এসেছে এই জাতির ছাত্র ও তরুণ সমাজ। তাই তাদের অর্জনের গর্বটা নিশ্চয়ই অনেক বেশি। একইভাবে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতেও অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে সেই তরুণ ছাত্রসমাজকে। তাহলেই বাংলাদেশের অবস্থান একদিন দেখা যাবে সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায়।

  

লেখক : প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

বরিশাল ক্যাডেট কলেজ