কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

৩৬ জুলাই : বাংলাদেশের অর্জন

ডা. সজল আশফাক, নিউ ইয়র্ক থেকে [সূত্র : দেশ রূপান্তর, ০২ আগস্ট ২০২৫]

৩৬ জুলাই : বাংলাদেশের অর্জন

৩৬ জুলাই। ২০২৪ সালের জুলাই মাস বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর ইতিহাসে একটি অন্যতম ঘটনা। কারও কাছে এটি বিপ্লব, কারও কাছে অভ্যুত্থান। সংজ্ঞানুযায়ী কোনটা বিপ্লব আর কোনটা অভ্যুত্থান, সেই বিতর্কে যাব না। তবে আমি মনে করি, ঘটনাটা বিপ্লব। এর পক্ষে অনেক যুক্তি দেখানো যাবে, সেটাও একটা লম্বা তর্কের ব্যাপার। আজ সেই তর্ক নয়। ৫ আগস্ট, বিপ্লব চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে তখনই যখন ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে যায়। এ নিয়েও বিতর্ক হাসিনা ফ্যাসিস্ট না  স্বৈরাচার? এসব বিতর্ক প্রকাশ্যে না হলেও প্রচ্ছন্নভাবে উঁকি দিতে থাকে বিগত ১৫ বছরের সুবিধাবাদী এবং বিপ্লবের সফলতা নিয়ে সন্দেহ থাকা দল বা গ্রুপের মাঝে। পরিকল্পিতভাবেই কয়েকটি মহল এটিকে সামনে এনে বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কের মাধ্যমে বিভেদ সৃষ্টির পাঁয়তারা শুরু করে।  এদের প্রথম গ্রুপটি ফ্যাসিস্ট আদর্শবাদী সুবিধাভোগী আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে Fair-Weather Revolutionary  বা সুদিনের বিপ্লবী অথবা Bandwagon Revolutionary  বা হাওয়াপন্থি বিপ্লবী। দ্বিতীয় গ্রুপটি মূলত সুযোগ সন্ধানী। প্রতিটি বিপ্লবের ইতিহাস শুধু আদর্শবাদীদের গল্প নয়, বরং এর ছায়ায় বাস করে কিছু সুবিধাবাদী চরিত্রও। এদের কেউ বিপ্লবের ঝুঁকি নেন না, কেউ আবার বিপ্লবের আদর্শে অবিচল নন।

 

এবার একটু ধারণা দেই সুদিনের বিপ্লবী নিয়ে। এরা হচ্ছে সেসব ব্যক্তি, যারা বিপ্লব বা আদর্শের প্রতি অনুগত থাকে যতক্ষণ সেটা নিরাপদ এবং লাভজনক। বিপ্লব বা আন্দোলনে ঝুঁকি বা বিপদ এলেই তারা সরে পড়ে, চুপ থাকে, বা ভোল পাল্টে ফেলে। এদের বিপ্লবপ্রীতি এক ধরনের আবহাওয়ার মতো রোদ থাকলে পাশে, ঝড় এলে গা-ঢাকা। যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৯৯১) ভাঙনের সময় অনেক পার্টি সদস্য পুঁজিবাদের পক্ষে সরে যান যখন তারা দেখেন কমিউনিজম দুর্বল হয়ে পড়েছে। ইরানের ইসলামী বিপ্লবে (১৯৭৯) প্রথমে যারা গণতন্ত্র ও পরিবর্তনের পক্ষে ছিলেন, ধর্মীয় উত্থানের সময় অনেকেই চুপ ছিলেন অথবা পাল্টে যান। আরব বসন্ত (২০১০-২০১২)-এর সময় তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া এ দেশগুলোতে সরকার পতনের পর অনেক পুরনো আমলের রাজনীতিবিদ হঠাৎ করে গণআন্দোলনের পক্ষে কথা বলা শুরু করেন।

 

 

কিছু পুরনো আমলের রাজনীতিবিদ জনগণের আন্দোলন সফল হলে হঠাৎ ‘নতুন পরিবর্তনের নেতা’ সেজে উঠেছিলেন। বাংলাদেশ, এক-এগারোর সময় (২০০৭) গণতন্ত্রের প্রবক্তা বলে পরিচিত ব্যক্তিরা সামরিক-সমর্থিত সরকারের সময় নীরব ছিলেন বা সরাসরি সমর্থন দিয়েছেন। Bandwagon Revolutionary  বা হাওয়াপন্থি বিপ্লবী হলো তারা, যারা জয়ী পক্ষের গন্ধ পেলে ঝাঁপ দেয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯) কথা। যখন রাজতন্ত্র ধসে পড়ে এবং গণতন্ত্রের দাবি জোরালো হয়, তখন অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি (যারা আগে রাজতন্ত্রের পক্ষেই ছিলেন) হঠাৎ করে বিপ্লবের পক্ষে সরে আসেন। এদের অনেকেই বিপ্লবের আদর্শে বিশ্বাস করতেন না বরং নিজেদের প্রাণ বাঁচানো বা নতুন ক্ষমতার সুবিধা নিতেই ‘বিপ্লবী’ সেজেছিলেন। আরব বসন্ত (২০১০-২০১২)-এ তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া এ দেশগুলোতে সরকার পতনের পর অনেক পুরনো আমলের রাজনীতিবিদ হঠাৎ করে গণআন্দোলনের পক্ষে কথা বলা শুরু করেন। আসলে তারা জনমত ও পরিস্থিতির সুবিধা নিতে চেয়েছিলেন। একইভাবে বাংলাদেশে ১৯৭১-এর পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা নিষ্ক্রিয় ছিলেন বা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি নমনীয় ছিলেন, তারা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর হঠাৎ করেই ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে’ সেজে ওঠেন। এদের কেউ কেউ প্রশাসনিক পদও লাভ করেন। এই দুই ধরনের চরিত্রের মধ্যে পার্থক্য খুব একটা নেই।

 

 

দুই চরিত্রের মানসিকতা প্রায় একই। তবে এই দুই চরিত্রের বিপদের দিক হচ্ছে এরা  আদর্শহীনতা ছড়ায়, প্রকৃত বিপ্লবীরা কোণঠাসা হন, কারণ সুবিধাবাদীরা নেতৃত্বে চলে আসে। বিপ্লবের প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত হয়, কারা আন্দোলনের নেতা ছিলেন, কারা শুধু ফায়দা তুলেছেন সীমারেখা মুছে যায়। জনগণের বিশ্বাসহীনতা তৈরি হয়, মানুষ রাজনীতিকে ছলনা বা নাটক মনে করতে শুরু করে। রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যায়। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইতোমধ্যে বিএনপি, কিছু বাম দল এবং ইসলামপন্থি দলের মধ্যে এই চরিত্রগুলোকে খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রত্যেক বিপ্লবেই ঝুঁকি থাকে, ত্যাগ থাকে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী যখন বিপ্লব সফল হয়, তখন সত্যিকারের যোদ্ধাদের ছাপিয়ে সুযোগসন্ধানীরা উঠে আসে। ফলে কোনো বিপ্লবকে মূল্যায়ন করতে গেলে আমাদের দেখতে হবে কারা রক্ত দিয়েছিল, আর কারা শুধু পুরস্কার নিতে এসেছিল। বিপ্লবের স্বার্থে নয়, নিজেদের স্বার্থে যারা আসে তারা বিপ্লবের চেয়ে বড় শত্রু। ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লবে হাওয়াপন্থি, সুদিনের বিপ্লবী এবং ১৫ বছরের সুবিধাবাদীরা ৫ আগস্ট থেকেই বিপ্লবের পেছনে লাগে- বিপ্লবের ক্রেডিট এবং নতুন করে সুবিধা নেওয়ার জন্য। যা ইতোমধ্যে আমাদের রাজনীতিতে শুরু হয়েছে। আর সুবিধাবাদীদের লক্ষ্য একটাই, বিপ্লবকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করা, এটা তাদের নৈতিক দায়, তা না হলে নিজেরাই দোষী হিসেবে একদিন আইনের মুখোমুখি হবেন। প্রকৃতপক্ষে ২০২৪ জুলাইয়ের বিপ্লব যখন বিজয় লাভ করে, তখন থেকেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিকল্পের হীন উদ্দেশ্য নিয়ে, বিপ্লব-অভ্যুত্থান, ফ্যাসিস্ট-স্বৈরাচার নিয়ে অযাচিত বিতর্কের সূচনা করে এই তিনটি পক্ষ। বিভিন্ন কারণে ৮ আগস্ট সরকারের প্রধান হিসাবে একটি  গোষ্ঠীর পছন্দের ব্যক্তি নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পেলেও বিপ্লবীরা সরকারের শীর্ষ পদে ফ্যাসিস্ট মনোনীত রাষ্ট্রপতিকে মেনে নিতে বাধ্য হয়। ১ বছরের মাথায় অন্তর্বর্তী সরকারের যেসব ব্যর্থতার কথা বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে,  সেগুলোকে বিরাজমান প্রতিকূল বাস্তব পরিস্থিতির নিরিখে সাধারণ মানুষ তাকে আপাত দুর্বলতা হিসেবে মেনে নিয়েছেন। সরকারের দুর্বলতার মধ্যে যেগুলো উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে তার মধ্যে আছে, ১৫ বছর গুম খুন লুটের সঙ্গে জড়িতদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে না পারা । একই সঙ্গে দোষীদের আইনের আওতায় না নিয়ে আসার ফলে, অন্তর্বর্তী সরকারের বিপক্ষে অসন্তোষ বাড়তে থাকে।

 

 

তারপরও জুলাই আন্দোলনের এক বছর পূর্তিলগ্নে অর্জনগুলো একেবারে কম নয়। এই অর্জন খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। ভুলে গেলে চলবে না, ১৫ বছরের দুঃশাসনের পর দুর্নীতিগ্রস্ত- পুলিশ, জনপ্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, মিডিয়া রেখে যাওয়ার পর তাদের প্রতি আইনগত সদয় আচরণ সরকারের সফলতা অর্জনের প্রক্রিয়ার গতিকে ধীর করেছে। এই সফলতাকে রাজনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তরের প্রতীক হিসেবে দেখা যায়। যেমন

 



১. ফ্যাসিস্ট শাসনের পতন

 

 

২. অন্তর্বর্তী সরকারের আন্তরিকতার কারণেই জাতিসংঘের রিপোর্ট বাংলাদেশের জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও তার পরবর্তী সংকটগ্রস্ত পরিস্থিতির মানবাধিকার লঙ্ঘনের দলিল হিসেবে পলাতক ফ্যাসিস্ট সরকারের বিচারকার্যে সহায়তা করবে।

 

 

৩. আন্তর্জাতিক বিচার ট্রাইব্যুনাল (ICC) ) দুর্নীতি, গুম এবং নির্বাচনী জালিয়াতির অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে। কয়েকজন প্রাক্তন কর্মকর্তা ও মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে।

 

 

৪. বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি

 

 

৫. মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা

 

 

৬. ভারতীয় আগ্রাসনের অবসান

 

 

সীমান্তে হত্যাকাণ্ড, নদীশাসন ও বাণিজ্যিক অন্যায় অবসান হয়েছে বলে সরকার ও কূটনৈতিক মহল দাবি করছে।

দেশের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তে বিদেশি হস্তক্ষেপ কমেছে।

 

 

৭. দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের বাস্তবায়ন

বড় বড় দুর্নীতিবাজ আমলা, দলীয় নেতা, ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার হয়েছে।

দুদক স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে পারছে।

 

 

৮. প্রশাসনিক ও বিচারিক সংস্কার

বিচার বিভাগে দলীয় নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পেয়েছে; বিচারপতিদের নিয়োগে স্বচ্ছতা বেড়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক গ্রেপ্তার হয়েছেন।

প্রশাসনে সংস্কার চলছে

 

 

৯. যুব সমাজ ও শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক জাগরণ

স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির নামে সহিংসতা বন্ধ হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাষ্ট্র সচেতনতা ও নেতৃত্ব গড়ে উঠছে।

 

 

১০. অর্থনৈতিক মুক্তির পদক্ষেপ

রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের অবসান হওয়ায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে আস্থা ফিরে এসেছে।

টাকার মান স্থিতিশীল হচ্ছে, রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক।

 

 

১১. আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সম্মান

বিশ্ব গণমাধ্যমে (যেমন BBC, NYT, Al Jazeera) এই বিপ্লব ‘বাংলাদেশের দ্বিতীয় গণজাগরণ’ হিসেবে প্রশংসিত হয়েছে।

জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থা দেশে স্বচ্ছ নির্বাচন ও মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রশংসা করছে।

 

 

১২. ২০২৫ সালের শুরুতে সর্বদলীয় সম্মতিতে গঠিত স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, বায়োমেট্রিক প্রযুক্তি ও পেপার ব্যালট ফিরিয়ে এনে ভোটব্যবস্থার সংস্কার করেছে।

 

 

১৩. প্রতিকূলতা মাথায় নিয়ে বিডিআর হত্যায় কমিশন কাজ করছে। জুলাই সনদ ঘোষণার ব্যাপারেও রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট বাতিল এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ কমেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।

 

 

বিপ্লব কখনোই শুধু ক্ষমতা বদলের নাম নয়। এটি মানসিক, নৈতিক এবং সাংগঠনিক রূপান্তরের সূচনা। ২০২৪ সালের বিপ্লব বাংলাদেশকে একটি নতুন পথের সামনে দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু বিপ্লবের আদর্শ ও আত্মত্যাগ রক্ষা করতে হলে, ইতিহাসকে সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করা এবং নেতৃত্বে আদর্শবানদের প্রতিষ্ঠা করাই এখন সবচেয়ে জরুরি। এখনো অনেক কাজ বাকি। বিডিআর এবং শাপলা চত্বর হত্যাকা-, আয়নাঘরসহ গুম খুনের বিচারের অপেক্ষায় জনগণ। দেশের মানুষ অপেক্ষায় আছে একটি অর্থবহ নির্বাচনের।