কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

আবারও কি ভেঙে গেল ফিলিস্তিনের স্বপ্ন ?

মুহাম্মদ সাইফুল্যাহ । সূত্র : শেয়ার বিজ, ৪ জানুয়ারি ২০২৫

আবারও কি ভেঙে গেল ফিলিস্তিনের স্বপ্ন ?

প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনে দ্বিতীয় জয়লাভের পর আগামী ২০ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্টের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যিনি ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি ও ব্যবসায়িক চুক্তিতে পারঙ্গমতার জন্য খ্যাতিমান এবং ইসরায়েলের সঙ্গে মহান বন্ধুত্বের শক্তিশালী অঙ্গীকারে আবদ্ধ।

 

২০১৭ থেকে ২০২১ এর প্রথম মেয়াদে তিনি ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি এবং আব্রাহাম অ্যাকর্ডস বাস্তবায়নের সূচনা করেন। ফলে চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর পূরণ হয়েছে অনেক স্বার্থ আর ভেঙে গেছে ফিলিস্তিনের আজন্ম স্বাধীনতার স্বপ্ন। তাই দ্বিতীয় বিজয়ের পর ইসরায়েল যখন তাকে ‘মেইক ইসরায়েল গ্রেট’ বলে স্বাগত জানিয়েছে, তখন দেশটিকে অন্তত মধ্যপ্রাচ্যের গ্রেট বানাতে এবার তিনি কী পদক্ষেপ নেবেন এবং তাতে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার কী হবে— এ নিয়ে শুরু হয়েছে জোর কল্পনা।

 

ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি : ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর বেলফোর ঘোষণার মধ্য দিয়ে যে ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের শুরু তা সমাধান ও মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এ পর্যন্ত অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৪৮, ১৯৬৭ ও ১৯৮০ সালের ইউএন রেজুলেশন, ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তি, ২০০৩ সালের আরব শান্তি উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য।

 

এ ধারাবাহিকতায় ২৮ জানুয়ারি, ২০২০ ঘোষণা করা হয়—”Peace to Prosperity: A Vision to Improve the Lives of the Palestinian and Israeli People। ১৮১ পৃষ্ঠা এবং ২৯ হাজার শব্দের এ পরিকল্পনা মূলত দুটি অংশে বিভক্ত:
প্রথম অংশ— পলিটিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক। মূল বক্তব্য হলো : ইসরায়েলের সীমানা বৃদ্ধি (সেকশন: ৪), জেরুজালেমকে রাজধানী স্বীকৃতি (সেকশন : ৫), ফিলিস্তিনের সম্পূর্ণরূপে সেনাবাহিনী বিলুপ্তি (সেকশন: ৭) এবং শরনার্থীদের ফিলিস্তিনে ফেরার নিষেধাজ্ঞা (সেকশন : ১৬)। দ্বিতীয় অংশ— ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক। মূল বক্তব্য : আগামী ১০ বছরের মধ্যে ৫০ বিলিয়নের বেশি বিনিয়োগ করা হবে। যার মাধ্যমে পশ্চিম তীর ও গাজার মধ্যে সংযোগ টানেল, গাজা উপকূলে কৃত্রিম দ্বীপ, বন্দর ও এয়ারপোর্ট গড়ে তোলা হবে।

 

ট্রাম্প এটাকে নিজ প্রশাসনের বিরাট সাফল্য এবং ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ বলে বর্ণনা করেন। তবে অনুসন্ধানে জানা যায়— ট্রাম্পের সিনিয়র উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষ দূত জেসন গ্রিনব্যাট এ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। কুশনার একজন মডার্ন অর্থডক্স জিউ। ২০০৯ সালে তিনি ট্রাম্পের জুডাইজম-কনভার্টেড কন্যা ইভাংকাকে বিয়ে করেন এবং ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ট্রাম্প-প্রশাসনে নিয়োগ লাভ করেন। তার নিয়োগ প্রাপ্তির পর ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী স্বীকৃতির ঘোষণা দেন ও গোলান মালভূমির বসতি স্থাপন অনুমোদন করেন। অনেকে মনে করেন— এ পরিকল্পনায় এক তরফাভাবে ইসরাইলের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে এবং ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ইস্যু উপেক্ষা করা হয়েছে। ফলে এটা হয়ত শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হতে পারে। যেমন: ‘আল-জাজিরা’ এটাকে ‘দ্যা ফেইল্ড ডিলস অব দ্যা সেঞ্চুরি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

 

আব্রাহাম অ্যাকর্ডস : ফিলিস্তিনসহ অনেক রাষ্ট্র ডিল অব দ্যা সেঞ্চুরি প্রত্যাখ্যান করলেও কুশনার এবং গ্রিনব্যাটের অব্যাহত প্রচেষ্টায় উপসাগরীয় কিছু আরব দেশ হয়ত তা প্রত্যাখ্যাত করতে পারেনি। বিশেষত সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে নীরবে নর্মালাইজেশন বা সম্পর্ক স্বাভাবিক করণ প্রচেষ্টা চলতে থাকে। যার অংশ হিসেবে শুরু হয় ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ স্বাক্ষর।

 


আব্রাহামিক ধর্মগুলো— বিশেষত ইহুদি, খ্রিষ্টান এবং ইসলামের সাধারণ বিশ্বাস মতে, আব্রাহাম বা ইব্রাহিম (আ.) হলেন এই তিনও ধর্মের পিতৃপুরুষ। তাই প্রধানত এ তিন ধর্মে বিশ্বাসী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যে রচিত চুক্তিটির এমন তাৎপর্যপূর্ণ নামকরণ। যাতে ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সঙ্গে ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন, ডিসম্বরে মরক্কো এবং ২০২১ এ সুদান স্বাক্ষর করে।

 

অবশ্য ইসরায়েল ইতোপূর্বে সীমান্ত লাগোয়া মিশর এবং জর্ডানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে যা কখনই তেমন উষ্ণ ছিল না। তবে উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কটা হয়তো ভিন্ন। কারণ সীমান্ত থেকে দূরের এই দেশগুলোর রয়েছ নানা রকম উচ্চাকাঙ্ক্ষা। তাই বাইডেন আমলে নেতানিয়াহু ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে একে আরও এগিয়ে নেয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। যেমন: ২০২৩ এর জাতিসংঘ ভাষণে তিনি বলেন: ‘এটি ইহুদি ধর্ম ও ইসলামের মধ্যে, জেরুজালেম ও মক্কার মধ্যে এবং ইসহাক এবং ইসমাইলের বংশধরদের মধ্যে বিস্তৃত পুনর্মিলনকে উৎসাহিত করবে’।

 

চুক্তির অর্জন : অন্তত পাঁচটি কারণে এই চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ :
ট্রাম্পের সাফল্য: ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘ডিল-মেকার’ বলে গর্ব করেন। এ চুক্তির ফলে উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে প্রকাশ্যে সম্পর্ক স্থাপন করার ফলে হোয়াট হাউজ এটাকে ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি ও পররাষ্ট্রনীতির বিরাট অর্জন বলে বর্ণনা করতে পারবে।
২. ইসরায়েলের নিঃসঙ্গতা হ্রাস: ১৯২০ এর দশকে ইসরায়েল ‘আয়রন ওয়াল’ স্ট্র্যাটেজি ঘোষণা করে। যার মূল কথা হচ্ছে, ইসরায়েলকে এতটাই শক্তিশালী হতে হবে যেন ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করা ছাড়া আরবদের আর কোনো পথ না থাকে। সুতরাং এ চুক্তির মধ্য দিয়ে সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে ইসরায়েলের নিঃসঙ্গতা হ্রাস পাবে।

 

৩. উপসাগরীয় দেশগুলোর লাভ: ক. সংযুক্ত আরব আমিরাতের ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটন বৃদ্ধি এবং মার্কিন এফ-৩৫ ও ইএ-১৮জি গ্রোলার ইলেকট্রনিক যুদ্ধ বিমান ক্রয়ের মত অন্যান্য অর্জন সম্ভব হবে। খ. শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ বাহরাইনের সুন্নি শাসকদের পক্ষে ‘ফিফথ কলাম’ বা ঘরের শত্রু বিভীষণ নিয়ন্ত্রণে ইসরায়েলের প্রযুক্তি ক্রয় করা সম্ভব হবে। গ. মরক্কো বিতর্কিত পশ্চিম সাহারা অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণের স্বীকৃতি লাভের মতো পুরস্কার পেতে পারে। ঘ. সুদান সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকের তালিকা থেকে নাম কাটানো এবং বিশ্বব্যাংকের ঋণ পরিশোধের জন্য ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের মতো আরও সহায়তা পেতে পারে।

 


৪. ফিলিস্তিনিরা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার: বহু বছর ধরে আরব দেশগুলো একমত ছিল— একমাত্র ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার মাধ্যমেই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে পারে। তাই ফিলিস্তিনিরা মনে করেন— এই চুক্তি তাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নকে দুর্বল করে দিয়েছে এবং তারা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছে।
৫. ইরানের কৌশলগত ঝুকি: অব্যাহত অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি এই চুক্তি কৌশলগত দিক থেকে বাড়তি চাপ। কারণ ইরানের অবস্থান ইসরায়েলের বিমান ঘাঁটিগুলো থেকে বহু দূরে কিন্তু আরব আমিরাতের বেশ কাছে। ফলে পরমাণু স্থাপনার ওপর বিমান হামলার ক্ষেত্রে এটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।

 

এ সব কারণে ‘আমেরিকান জুইশ কমিটি’ মনে করে— আব্রাহাম অ্যাকর্ড হলো একটি ল্যান্ডমার্ক ও গেম চেঞ্জার এগ্রিমেন্ট। ফলে ইসরায়েল এবং চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে ডিরেক্ট ফ্লাইট, পিপল টু পিপল এক্সচেঞ্জ, বিজনেস পার্টনারশিপ ও গভর্নমেন্ট এগ্রিমেন্ট রচিত হবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইনভেস্টমেন্ট ও গ্রোথ বৃদ্ধি পাবে। চুক্তির ব্যর্থতা: ইসরায়েলের দৃষ্টিতে এই চুক্তি সিকিউরিটি অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন। ফলে চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলো লাভবান হতে থাকে আর ফিলিস্তিনের হতাশা বাড়তে থাকে।

 

এ অবস্থায় ২০২৩ এর ৭ নভেম্বর হামাস ইসরায়েলে আক্রমন চালায়। একজন ফিলিস্তিনি বলেন : হামাসের ইসরায়েল আক্রমণের অনেক কারণ রয়েছে। যার মধ্যে একটি হলো এই চুক্তি। আবার অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন- এটা আব্রাহাম অ্যাকর্ডের ব্যাক ফায়ার। যেমন: ‘জেরুজালেম পোস্টের’ ২৯ মে, ২০২৪ এর ‘Did the Abraham Accords cause October 7’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে— ‘৭ অক্টোবর ম্যাসাকারের সঙ্গে আব্রাহাম অ্যাকর্ডের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে’।

 

এর আগে ৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ‘টাইম’ ম্যাগাজিন It’s Time to Scrap the Abraham Accords’ শিরোনামে আর্টিকেল প্রকাশ করেছে। লিখেছেন হিউমেন রাইটস ওয়াচের মিডল ইস্ট ও নর্থ আফ্রিকার সাবেক প্রধান— সারাহ লিয়াহ উইটসন। তিনি চুক্তিটির ফলে সংঘটিত বাণিজ্য ও যুদ্ধের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে এই উপসংহারে পৌঁছেছেন— ‘এসব বিষয় প্রমাণ করে যে, এটা বন্ধ করা প্রয়োজন’।

 

তবে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস পিস ইনস্টিটিউট’ ১ এপ্রিল, ২০২৪ সালে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়- চুক্তি স্বাক্ষরের পর ২০২১ সালে যেখানে সামরিক ও অন্যান্য বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯৭৩ মিলিয়ন ডলার সেখানে ২০২৩ শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার মিলিয়ন ডলার; যার মধ্যে শুধু আরব আমিরাতের অংশ হলো ২ হাজার ৯৪৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার।

 

বাণিজ্যের এ ক্রমবর্ধমান হার এবং সিরিয়ায় আসাদ পতনের ফলে মনে করা হয়— চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশের সংখ্যা সম্ভবত আরও বৃদ্ধি পাবে। যেমন : যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের’ মিডল ইস্ট ও নর্থ আফ্রিকার সাবেক প্রধান রব গ্রিনওয়েলকে প্রশ্ন করা হয়— ট্রাম্পের এ মেয়াদে চুক্তিটির সম্ভাবনা কেমন? উত্তর তিনি বলেন: ‘অবশ্যই এর ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি, অর্থনীতি চাঙা রাখা, সামরিক ও নিরাপত্তা সক্ষমতা বৃদ্ধির মতো অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে’।

 

ফলে প্রশ্ন দেখা দেয় আব্রাহাম অ্যাকর্ড কি ফিলিস্তিন ইস্যুকে আড়াল করে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা স্থাপনের প্রচেষ্টা? নাকি এটি আরব বিশ্বের ঐক্য ভাঙনের প্রতীক? ধ্বংসস্তূপের ভেতর জলপাইয়ের ডাল মুখে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে যে শান্তির পায়রা নেমে আসার কথা, যথাসময়ে কি তার আগমন হবে নাকি আরও পিছিয়ে যাবে?