আদর্শ বিসর্জনে রাজনৈতিক দলের মৃত্যু
মেজর (অব.) মনজুর কাদের [সূত্র : যুগান্তর, ০১ জুন ২০২৫]

বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দল স্থায়ী হয় না। আজ আছে তো কাল নেই। দেখতে দেখতে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডও নিষিদ্ধ হয়ে গেল। নিজেদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের দুর্বলতা, ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য দলের আদর্শ বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া, ক্ষমতায় গিয়ে দুর্বিনীত মনোভাব দেখানোর জন্য জনগণ মুখ ফিরিয়ে নিলে ধীরে ধীরে দল বিলুপ্ত হয়ে যায়।
পাকিস্তানে ক্ষমতাসীনদের দলের রুগ্ণ অবস্থা
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বোঝাপড়া মোতাবেক ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট অতি সহজেই ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী একের পর এক ভুল করতে থাকে এবং ক্ষমতাসীনদের উন্নাসিকতার কারণে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী মুসলিম লীগ দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করে।
পাকিস্তান হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু
এদিকে স্নায়ুযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসাবে (সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের বিরুদ্ধ শক্তি) আবির্ভূত হয়ে উন্নাসিকতায় গা ভাসিয়ে দেয়। কারণ প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র প্রভাবশালী পরাশক্তি হয়ে ওঠে। ভারত এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং মুসলিম দেশ পাকিস্তানকে বিভক্ত করার লক্ষ্যে হিন্দুত্ববাদী ভারতের (কংগ্রেস মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও তা কায়েম করতে পারেনি) চানক্য নেতৃত্ব ষড়যন্ত্র শুরু করে, সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নিজেদের গুপ্তচর ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বিকালে ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে গঠিত হয় নতুন একটি রাজনৈতিক দল, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন সামছুল হক। দলটি ১৯৫৪ সালে একে ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টিসহ (কেসেপি) অন্য কয়েকটি দলের সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট সরকারে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ক্ষমতায় যায়।
‘মুসলিম’ শব্দ বাদ : পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নামকরণ
১৯৫৫ সালে মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দলটির নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ রাখা হয়। এ নামকরণের মাধ্যমে দলটি ধর্মনিরপেক্ষ ভারত এবং বামপন্থিদের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি নিয়ে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মতবিরোধের কারণে এবং নেতৃত্বের জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ১৯৫৭ সালের ২৬ জুলাই প্রতিষ্ঠা করেন ন্যাপ। পরবর্তীকালে চীন ও সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে আদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিভক্ত হয়। চীনঘেঁষা ন্যাপের অংশের নাম হয় ‘ন্যাপ (ভাসানী)’ আর মস্কোঘেঁষা অংশের নাম হয় ‘ন্যাপ (মোজাফফর)’।
শেখ মুজিবের স্বৈরাচারী মনোভাব
মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে সরে আসার পর শেখ মুজিবুর রহমান দলটির মধ্যে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে স্বৈরাচার হয়ে উঠেন। যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ায় তার প্রভাব আরও বৃদ্ধি পায়। ১৯৭০ সালে মওলানা ভাসানীর সহায়তায় (ন্যাপ ভাসানীর নির্বাচন বর্জনের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানকে ওয়াকওভার দেওয়া) সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ১৬ ডিসেম্বরের পর নিজ রাজনৈতিক দলের আদর্শের বিরুদ্ধে গিয়ে জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠন, দুর্নীতি, দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি এবং রক্ষীবাহিনী গঠন করে বিরোধীদল দমনের কারণে জনপ্রিয়তা হারায়। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি করে আওয়ামী লীগ জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
রক্ষীবাহিনী গঠন
ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর জলপাই রঙের পোশাকের অনুরূপ পোশাকে রক্ষীবাহিনী সৃষ্টি করে শেখ মুজিব হাজার হাজার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে নৃশংসভাবে হত্যা করার আদেশ দেন এবং ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল কায়েমের মাধ্যমে আজীবন ক্ষমতায় থাকার বন্দোবস্ত করেন। ৪টি বাদে সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট : রাজনৈতিক পটপরিবর্তন
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তরুণ অফিসারদের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থানের ফলে ভারতের পুতুল বাকশাল সরকারের পতন ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে। আধিপত্যবাদী শক্তি ৩ নভেম্বর পালটা অভ্যুত্থান করলে ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, বীরউত্তম ক্ষমতায় আসীন হন। এ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জিয়া সামরিক বাহিনী এবং বেসামরিক নাগরিকদের অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন।
মওলানা ভাসানীর ভূমিকা
নভেম্বরের শেষদিকে পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে ন্যাপের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান যাদু মিয়া দেখতে আসেন। এ সময় আমি (লেখক) সেখানে উপস্থিত ছিলাম। মওলানা তার চিরাচরিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘যাদু, তোমার ন্যাপ দিয়া কিছু হইব না। দেশ বাঁচাতে হলে মিলিটারির সঙ্গে মিল্যা একটা পার্টি করো।’ পরদিন সেনাপ্রধান এবং উপসামরিক আইন প্রশাসক, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান অসুস্থ মওলানাকে পিজি হাসপাতালে দেখতে আসেন। এ সময়েও আমি (লেখক) সেখানে উপস্থিত ছিলাম। মওলানা বললেন, ‘নির্বাচন দিয়া দেশ বাঁচাতে পারবা না, আগে দল গঠন করো, তারপর নির্বাচনের কথা বইল।’
রাজনীতির মাঠে জিয়া
কালক্ষেপণ না করে দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী এবং সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেন। এরপর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং প্রেসিডেন্ট হিসাবে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান তার শাসনকে অসামরিকীকরণের অভিপ্রায়ে একদিকে যেমন ‘সমমনা’ রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে একটি রাজনৈতিক জোট গঠনের কথা চিন্তা করেন, অন্যদিকে তিনি নিজস্ব একটা রাজনৈতিক দল সৃষ্টির বিষয়টিও খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন।
জাগদল গঠন
তিনি মনে করেন, জোটের মধ্যে শতভাগ অনুগত একটা দল না থাকলে জোটকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। সে লক্ষ্যে তিনি নিজে নেপথ্যে থেকে ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল’ (জাগদল) নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার ছিলেন দলটির আহ্বায়ক। রাজনৈতিক শক্তি সমন্বয় করার জন্য সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশুর (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল এবং কৃষিমন্ত্রী) অফিসে রাতের বেলায় রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা আসতেন এবং কথাবার্তা বলতেন। জিয়া মাঝে-মধ্যে সেখানে উপস্থিত থাকতেন।
‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’ ঘোষণা
১৯৭৮ সালের ১ মে জিয়াউর রহমানকে চেয়ারম্যান করে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’ ঘোষণা করা হয়। জিয়া সেনাবাহিনীর প্রধান থেকেও পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ বনে যান। ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তিকে মোকাবিলা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সামরিক এবং বেসামরিক নেতৃত্বের এক বিরাট সেতুবন্ধন তৈরি হয় এ সময়।
জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একটা প্ল্যাটফর্ম। ফ্রন্ট নেতারা সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এককাট্টা-এটাই ছিল একতার ভিত্তি। তবুও নানা মত ও পথের নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত এ ফ্রন্ট নিয়ে জিয়াউর রহমান স্বস্তিতে ছিলেন না। তিনি ‘সমমনা’ লোকদের নিয়ে আলাদা দল তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ইউনাইটেড পিপলস পার্টির নেতা কাজী জাফর আহমদ, সাংবাদিক নেতা এনায়েতউল্লাহ খান মিন্টু ফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে যান।
‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ গঠন
ন্যাপের সভাপতি, মশিউর রহমান যাদু মিয়া, মুসলিম লীগের নেতা শাহ আজিজুর রহমান এবং জাগদল (১৯৭৮ সালের ২৮ আগস্ট ‘জাগদল’ বিলুপ্ত) বিলুপ্ত করে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ গঠন করা হয়। মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায় ‘সিনিয়র মিনিস্টার’ (প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদায়) নিয়োগ করা হয়।
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকার রমনা রেস্তোরাঁ প্রাঙ্গণে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জিয়াউর রহমান বিএনপির প্রধান হিসাবে দলের নাম, গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচি আনুষ্ঠানিক দল ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠিত হয় তদানীন্তন বাংলাদেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলের জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ নেতাকর্মীদের সম্মিলনে। ব্যাপকভিত্তিক একটি জাতীয়তাবাদী দল হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান দক্ষিণপন্থি, বামপন্থি ও মধ্যপন্থি মতাদর্শের নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে দল গড়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বিভিন্ন দল থেকে আবিষ্কার করে ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনয়ন দেয়।
জগদ্দল পাথর সরানো
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে পাকিস্তানের আধা-ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে পূর্ব বাংলার জনগণ সংগ্রাম শুরু করে এবং এর চূড়ান্ত পর্বে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে বাংলাদেশের মানুষ সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের দোসর সম্প্রসারণবাদী ভারতের খপ্পরে পড়ে।
আধিপত্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদী জগদ্দল পাথর সরাতে মওলানা ভাসানী আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। পরিশেষে জিয়া এ আন্দোলনের হাল ধরে চলতে গিয়ে আধিপত্যবাদী শক্তির মদদপুষ্ট দেশদ্রোহীদের হাতে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সার্কিট হাউজে নিহত হন। এর ১৩ দিন আগে ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন শেখ হাসিনা। কী এক অদ্ভুত সমন্বয়।
প্রেসিডেন্ট জিয়া শাহাদতবরণ করার পর আধিপত্যবাদী ভারত অনেক চেষ্টা করেছে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আনতে। কিন্তু দেশপ্রেমিকদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তবে ১৯৯১-৯৬-এর বিএনপি সরকারের মিসক্যালকুলেশনের কারণে মাগুরা উপনির্বাচন নিয়ে বিপর্যয় ঘটে এবং আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হয়।
চারদলীয় জোট গঠন
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবারও নির্বাচিত হওয়ার জন্য সব ধরনের অপতৎপরতা চালায়। কিন্তু দেশপ্রেমিকদের চেষ্টায় জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামি শক্তির সমন্বয়ে গঠিত চারদলীয় জোট আধিপত্যবাদী শক্তির চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ার বিধ্বস্ত হলে War on Terror ঘোষণা করা হয়। এ যুদ্ধের প্রথম টার্গেট হয় ইসলামি শক্তি। যেহেতু চারদলীয় জোটের মধ্যে ইসলামি শক্তি ছিল, তাই আধিপত্যবাদী শক্তি সমগ্র বিশ্বে প্রচার করে, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে।
জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি শক্তি নির্মূল
অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা না নেওয়ায় আধিপত্যবাদী শক্তির মদদে ১/১১-এর সরকার গঠন করে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি শক্তিকে নির্মূল করার ব্যবস্থা করে। দীর্ঘ ১৮ বছর আধিপত্যবাদী ভারতের মদদপুষ্ট আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শক্তি ক্ষমতায় থেকে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি রাজনৈতিক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে, সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে, গণতন্ত্র নির্বাসিত করেছে-এক অদ্ভুত অচলায়তন সৃষ্টি করেছে সর্বত্র।
রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি
ভুল রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী মুসলিম লীগ, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি, পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগ, স্বাধীনতার পর গঠিত শক্তিশালী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), এরশাদের জাতীয় পার্টি নিঃশেষ হয়ে গেছে। রাজনৈতিক ভুলের কারণে অতীতেও রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত হয়েছে, ভবিষ্যতেও একই ধারা অব্যাহত থাকবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ধ্বংস এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য অতিসম্প্রতি আওয়ামী লীগের সব কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যত বড় শক্তি হোক না কেন, জনগণের শক্তির কাছে সব অপশক্তি পরাজিত হয়, যার প্রমাণ ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান।
মূল সমস্যা ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তি
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ২৫ মে বিকালে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। ওই বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মান্না বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ভারতীয় আধিপত্যবাদের কারণে দেশ বড় সংকটের মধ্যে রয়েছে। এজন্য পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকা দরকার বলে প্রধান উপদেষ্টা মনে করছেন।’
বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এখনো শেষ হয়নি। বাংলাদেশের সমাজে প্রধান দ্বন্দ্ব হলো নির্যাতিত বাংলাদেশি নাগরিক এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির মধ্যে; কারণ এ দ্বন্দ্ব সমাজের বিকাশকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে।
এ দ্বন্দ্ব যারা বুঝবেন না এবং এ দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে আধিপত্যবাদী ভারতের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে লড়বেন না, তাদের ভবিষ্যৎ কণ্টকাকীর্ণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
মেজর (অব.) মনজুর কাদের : সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য