কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

আগাম নির্বাচন ও ত্রিশক্তির ভাবনা

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার জোর দিয়ে বলেছে, নির্বাচনের আগে সংস্কার করতে হবে। নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে ভোটার নিবন্ধন এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের মতো বিষয়গুলো মোকাবেলা করতে হবে। চীন, পাকিস্তান ও জাপান বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে নির্বাচনী সংস্কার সমর্থন করার কথা বলেছে। চীন, জাপান ও পাকিস্তান কোনো দেশ সংস্কারের বিরোধিতা করছে না এবং নির্বাচনের কথা বললেও এখনই নির্বাচনের জন্য কোনো চাপ দিচ্ছে না। মো: বজলুর রশীদ [সূত্র : নয়া দিগন্ত, ১৭ জুন ২০২৫]

আগাম নির্বাচন ও ত্রিশক্তির ভাবনা

দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও জরুরি সংস্কার করে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে গত বছর ৮ আগস্ট নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রা শুরু। তবে এরই মধ্যে নির্বাচন প্রশ্নে সরকারকে অস্বস্তিতে পড়তে হয়। এদিকে কথা বলার অধিকার পেয়ে বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন আন্দোলন-দাবিদাওয়ার নামে সরকারের কাজকে বাধাগ্রস্ত করছে। 

 

 

প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল ও পক্ষের তাড়াতাড়ি নির্বাচন চাওয়া এবং রাখাইন করিডোর এখতিয়ারহীন বলায় বিভেদ দেখা দেয়। দুই ব্যক্তির ইগো সমস্যা মনে করা হলেও বাস্তবে এটি একাধিক অংশীজনের স্বার্থের একটি জটিল সমীকরণ।

 

 

একসময় সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে চলতে বাংলাদেশের আশার আলো হিসেবে পরিচিতি পাওয়া অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখন দেশের গণতন্ত্র পরিচালনায় যাদের মিত্র হিসেবে পাওয়ার কথা তাদের কাছ থেকে আক্রান্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশের টালমাটাল রাজনৈতিক দৃশ্যপট স্থিতিশীল করার কঠিন কাজটি ৮৪ বছর বয়সী এই অর্থনীতিবিদের জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

 

 

ভারত একটি প্রধান আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশে দিল্লির গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। ভারত মনে করে, বাংলাদেশে একটি আগাম নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট স্থিতিশীল করতে সহায়তা করবে, যার ফলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে। সেই সাথে এ অঞ্চলে ভারতের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত হবে। বাণিজ্য, বাণিজ্য পথ, শরণার্থী স্রোত, আন্তঃসীমান্ত উত্তেজনা, সেভেন সিস্টার্সে যোগাযোগ, চিকেন নেক সুরক্ষা- এ সব বিষয়ে বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার ও সরকারের স্থিতিশীলতাকে ভারত গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বিগত সাড়ে ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকা ফ্যাসিবাদে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। আগাম নির্বাচন ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল দলগুলোকে ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করতে পারে বলে দিল্লি হয়তো ভাবছে। ফলে দেশটিতে চীনের প্রভাব মোকাবেলা করা যাবে।

 

 

বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের সাথে ক্ষমতার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসছে। বিএনপির লক্ষ্য নিজেদের প্রভাব ও জনসমর্থন কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে জয়ী হওয়া। ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করা। দলটি মনে করে, নির্বাচন যত পিছিয়ে যাবে, অন্তর্বর্তী সরকার তত বেশি ক্ষমতা সংহত করবে, যা বিএনপির বিজয়ের সম্ভাবনা বাধাগ্রস্ত করবে। তাই বিএনপি বারবার দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে, পারলে এখনই। তাই বিএনপিকে এ জন্য কোনো দায়ভার বা বিরোধিতা করা সঠিক নয় বলে অনেকে মনে করেন। জনগণের মধ্যে বিএনপির ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বিএনপি প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। নির্বাচনের জন্য জনসাধারণের প্রত্যাশা পুঁজি করে আরো সমর্থন জোগাড় করতে এবং নির্বাচনী বিজয়ের গতিবেগ তৈরি করতে চায় বিএনপি।

 

 

গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ায়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা ইস্যুতে আচরণ এবং আওয়ামী লীগের উপর বিধিনিষেধে বাংলাদেশের সমালোচনা করে। এই সমালোচনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, যা আন্তর্জাতিক ভাবমর্যাদা উন্নয়নে ইউনূস প্রশাসনের ওপর চাপ বাড়িয়েছে।

 

 

ভারত নিজের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা চায়; বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফিরে আসতে এবং রাজনৈতিক অবস্থান স্থিতিশীল করতে চায়; নির্বাচিত সরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে পারে এ যুক্তি থেকে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দ্রুত নির্বাচনে জোর দিয়েছিলেন। এই অর্থে, তাদের অবস্থান বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রয়োজনীয়তার সাথে মিলে যায়।

 

 

ভারত এখন বিএনপির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার প্রচেষ্টায় রয়েছে। বিএনপির আগাম নির্বাচন চাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশে ভারতের কৌশলগত স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা উভয়ের মধ্যে সম্ভাব্য সমন্বয়ের ইঙ্গিত দেয়। এদিকে, নির্বাচন বিলম্বিত করতে জনগণের পছন্দ বিএনপি এবং ভারতের উদ্দেশ্যের প্রতি অবিশ্বাস ও অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রচেষ্টার প্রতি তাদের সমর্থনের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। এটি পাওয়ার ডায়নামিক্সের একটি জটিল ইন্টারপ্লে তৈরি করেছে।

 

 

অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কয়েকটি সংস্কারের প্রস্তাব করেছে, কিন্তু জনগণের কিছু অংশ তাদের অগ্রগতি ও ফল নিয়ে অসন্তুষ্ট। অনেকে বিশ্বাস করেন, সংস্কারগুলো মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব ও দুর্নীতির মতো সমালোচনামূলক বিষয়গুলো কার্যকরভাবে এখনো মোকাবেলা করতে পারেনি। অনেকে বলছেন, ১৫ বছরের সর্বগ্রাসী দুর্নীতির জঞ্জাল কয়েক মাসে দূর করা সম্ভব নয়; এ জন্য সংস্কার করতে সরকারকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কার বাস্তবায়ন এবং শাসনব্যবস্থার উন্নতির জন্য আরো সময় পেলে সম্ভাব্যভাবে জনসন্তুষ্টি বাড়িয়ে তুলবে। নির্বাচনপ্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে জনগণ সন্দিহান। ভোটার নিবন্ধন, নির্বাচনী নিরাপত্তা এবং ভোট গণনার মতো বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য উদ্বেগের বিষয়। নির্বাচন বিলম্বিত করে নির্বাচনী কাঠামো প্রস্তুত ও উন্নত করতে আরো সময় প্রয়োজন; যাতে নির্বাচনের ফলের প্রতি জনগণের আস্থা প্রতিস্থাপিত হয়। সাধারণ মানুষ এটি প্রত্যাশা করে। 

 

 

আগাম নির্বাচনের প্রশ্নে জাপান, চীন ও পাকিস্তানের মতামত রয়েছে। তবে কোনো দেশ সরাসরি বা এখনই নির্বাচন চায় এমন কোনো মেসেজ পাওয়া যায়নি। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী বৃহৎ শক্তি চীন বরাবর এ অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর জোর দিয়ে আসছে। বাংলাদেশে আগাম নির্বাচন স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে, যা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলতে পারে। আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি এড়াতে চীন অবশ্যই অস্থিতিশীলতার ঝুঁকির বিরুদ্ধে আগাম নির্বাচনের সম্ভাব্য সুবিধা-অসুবিধা সতর্কতার সাথে বিবেচনা করছে বলে জানা গেছে। কেননা, বাংলাদেশে চীনের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে, যেমন- বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর (বিসিআইএম) এবং অন্যান্য অবকাঠামো প্রকল্প। আগাম নির্বাচন চাওয়ায় সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধাগ্রস্ত হতে পারে বিধায় সতর্ক চীন।

 

 

বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে চীন বরাবর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। আগাম নির্বাচন সমর্থন করার অর্থ হতে পারে কোনো পক্ষ নেয়া, চীনের নিরপেক্ষতার ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করা এবং বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির সাথে সম্পর্কের টানাপড়েনে বেইজিং নিজের নিরপেক্ষ কূটনৈতিক অবস্থান বজায় রাখতে সতর্কতার সাথে অগ্রসর হচ্ছে।

 

 

পাকিস্তানও বাংলাদেশের সম্পর্ক উত্থান-পতনের সম্মুখীন হয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। পাকিস্তান নিজে মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রার অবমূল্যায়নের মতো অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বাংলাদেশের আগাম নির্বাচন সমর্থন করার পাশাপাশি ঢাকার রাজনৈতিক বিষয়ে জড়িত থাকার কারণে বাড়াবাড়ি এড়াতে ইসলামাবাদ তার নিজস্ব অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং সম্পদ বরাদ্দের বিষয়টিও বিবেচনা করছে। ভারত আগাম নির্বাচনে পাকিস্তানের সমর্থনকে বাংলাদেশে তার প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা হিসেবে দেখছে। জাপানে প্রধান উপদেষ্টার সাম্প্রতিক সফরে তিনি যেভাবেই হোক ডিসেম্বর-জুনের ভেতর অবশ্যই নির্বাচন করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। জাপান সরকার এ ঘোষণায় একাত্মতা প্রকাশ করে। 

 

 

আন্তর্জাতিক মিডিয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, প্রায়ই জেনারেল ওয়াকার এবং ড. ইউনূসের মধ্যে রাজনৈতিক মতভেদের বিষয়গুলো ফলাও করে প্রচার করছে। উদাহরণস্বরূপ- দ্য হিন্দু জানিয়েছে, জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অন্তর্বর্তী সরকারের নীতি, বিশেষত রাখাইন করিডোর ইস্যু পরিচালনার বিষয়ে কমান্ডিং অফিসারদের সাথে বৈঠকে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। এদিকে ড. ইউনূসের পদত্যাগের চিন্তাভাবনাও প্রচারিত হয়েছে। এসব প্রতিবেদন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, যা দেশটির রাজনৈতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরদারি আরো বাড়িয়েছে। এর ফলে জেনারেল ওয়াকার ও ড. ইউনূসের ওপর তাদের মতবিরোধ নিরসন ও রাজনৈতিক দৃশ্যপট স্থিতিশীল করার চাপ অনেকটা বেড়েছে। উভয়ের মধ্যে রাজনৈতিক মতবিরোধ কমিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক চাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশ, ভারত, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান জেনারেল ওয়াকার এবং ড. ইউনূসের অবস্থান ও কর্মকাণ্ড প্রভাবিত করছে বলে মনে হয়।

 

 

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার জোর দিয়ে বলেছে, নির্বাচনের আগে সংস্কার করতে হবে। নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে ভোটার নিবন্ধন এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের মতো বিষয়গুলো মোকাবেলা করতে হবে। চীন, পাকিস্তান ও জাপান বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে নির্বাচনী সংস্কার সমর্থন করার কথা বলেছে। চীন, জাপান ও পাকিস্তান কোনো দেশ সংস্কারের বিরোধিতা করছে না এবং নির্বাচনের কথা বললেও এখনই নির্বাচনের জন্য কোনো চাপ দিচ্ছে না।

 

 

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার