আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস যে বার্তা দিচ্ছে
জিয়াউর রহমান। সূত্র : আমাদের সময়, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

দেশের অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছে না। তবে সেটি হঠাৎ করেই খারাপ হয়নি। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ কয়েক বছরে ধীরে ধীরে অর্থনীতির অবস্থা খারাপ হচ্ছিল। আর তাদের বিদায়ের বছরে (২০২৪) পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। টাকার ব্যাপক দরপতন, রিজার্ভ তলানিতে নেমে আসা, ডলারের জন্য হাহাকারÑ স্থানীয় বিনিয়োগ ও শিল্পের জন্য বড় আঘাত হিসেবে দেখা দেয়। গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের নানামুখী চেষ্টায় রিজার্ভ পরিস্থিতির নাটকীয় উন্নতি হয়েছে। স্থিতিশীলতা এসেছে ডলার-টাকা বিনিময় হারে। রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় বাড়ছে। বেড়েছে রপ্তানি আয়ও।
কিন্তু কয়েকটি সূচকের ইতিবাচক ধারার মধ্যেও যে সামগ্রিক অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ চলছে, তার অনেকটাই যেন ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। সরকারের নীতিনির্ধারকরাও এসব বিষয় এড়িয়ে গিয়ে নিজেদের সাফল্যগাথায় বেশ বুঁদ হয়ে ছিলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের দেওয়া জিডিপির প্রবৃদ্ধি সংক্রান্ত সাম্প্রতিক পূর্বাভাস ওই সাফল্যগাথাকে বড় প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। তারা প্রবৃদ্ধি হারের যে পূর্বাভাস দিয়েছে, তা সরকারের প্রক্ষেপিত লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকের মতো। বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া না হলে আগামী দিনে অর্থনীতি বেশ বড় সংকটে পড়তে পারে।
নানা কারণে চলতি অর্থবছরে যে প্রবৃদ্ধি হার কিছুটা কমবে, তা আগে থেকেই ধারণা করা যাচ্ছিল। সরকারও বিষয়টি অনুধাবন করে মার্চে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য সংশোধন করে ৫ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ।
গত এক মাসে বাংলাদেশের তিনটি বড় উন্নয়ন অংশীদার আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে যে পূর্বাভাস দিয়েছে, তার প্রতিটিতে প্রবৃদ্ধি প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ৪ শতাংশের কম। চলতি মাসের প্রথম দিকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য সংশোধন করে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে ৩ দশমিক ৯ শতাংশে নামিয়ে আনে। গত ২২ এপ্রিল আইএমএফের দেওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়, চলতি বছর বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। পরদিন বিশ্বব্যাংকের দেওয়া পূর্বাভাসে সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি দেখানো হয় আরও কম, ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। গত জানুয়ারি মাসে তারা ৪ দশমিক ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা বলেছিল।
এডিবির বিশ্লেষণ অনুসারে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শ্রমিক বিক্ষোভ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের অর্থনীতির সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির ওপর প্রভাব ফেলেছে। অন্যদিকে আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মন্দার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হয়েছে। ফলে ভোগের প্রবণতা কমেছে। এতে প্রবৃদ্ধির হারও কমবে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ের অস্থিরতার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
অবশ্য বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হ্রাসের বিষয়টি একেবারে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। চলতি বছর শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের প্রবৃদ্ধি কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আইএমএফ মনে করছে, এ বছর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে ২ দশমিক ৮ শতাংশ, যা গত বছর ৩ দশমিক ৩ শতাংশ ছিল। সংস্থাটির সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে এর কারণ হিসেবে বলা হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী আর্থিক ব্যবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী মন্দা মোকাবিলা করে সামনে এগোতে হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারী, ২০২১ সালে শুরু হওয়া বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির উত্থান এবং ২০২২ সালে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক মন্দা। এর ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই সাম্প্রতিক শুল্ক ইস্যুতে বিশ্বব্যাপী আর্থিক ব্যবস্থা অস্থিতিশীল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির ধারা হোঁচট খাওয়ার পেছনে অভ্যন্তরীণ নানা ইস্যুর ভূমিকাও কম নয়। গত বছরের জুলাই থেকে প্রথমে কোটাবিরোধী ও পরে সরকার পতনের আন্দোলন ঘিরে যে ব্যাপক অস্থিরতা তৈরি হয়, তার রেশ এখনও কাটেনি। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে সাভার-গাজীপুরের তৈরি পোশাক কারখানাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় শিল্প-কারখানায় ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের ঘটনা ঘটে। তাতে উৎপাদন কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। সম্প্রতি পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও তা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসেনি। গত সপ্তাহেও শ্রমিক অসন্তোষের মুখে গাজীপুরে কমপক্ষে ৫টি কারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। দৈনিক প্রথম আলোতে ২০ এপ্রিল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৫ মাসে বিজিএমইএর সদস্য এমন ১১৩টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে। এতে কাজ হারিয়েছেন ৯৬ হাজার মানুষ। এর মধ্যে গত আগস্টের পর বন্ধ হয়েছে ৬৯টি কারখানা। তাতে কাজ হারিয়েছেন ৭৬ হাজার জন। অবশ্য একই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আলোচিত সময়ে বিজিএমইএর সদস্য পদ নিয়েছে নতুন ১২৭টি কারখানা। এসব কারখানা পুরোপুরি উৎপাদনে এলে ৭৪ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। তবে এটি বেশ সময়সাপেক্ষ বিষয়।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান সংকটে পড়েছে। এরই মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, বাকিগুলো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে চলতি মূলধনের অভাব, কোনোটি আবার ঋণপত্র খুলতে সমস্যায় পড়ছে। এসব উদ্যোক্তার অনেকের বিরুদ্ধে ব্যাংক লুট, অর্থপাচারসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ আছে। তবে এসব অভিযোগে বিচারের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের বিষয়টি মাথায় রেখে প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকরভাবে সচল রাখার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
এদিকে নানা কারণে নতুন বিনিয়োগেও স্থবিরতা বিরাজ করছে। জ্বালানি-বিদ্যুতের ঘাটতির পাশাপাশি যোগ হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মব-সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। চলতি মাসে ইসরায়েলি মালিকানার গুজব ছড়িয়ে সারাদেশে বেশ কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির আউটলেটে হামলা চালানো হয়েছে। এমন পরিস্থিতিকে নতুন বিনিয়োগের জন্য মোটেও অনুকূল মনে করছেন না উদ্যোক্তারা। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচন ও পরবর্তী সরকারকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তাও বিনিয়োগের জন্য একটি বাধা হয়ে আছে।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি হ্রাসের আরেকটি বড় কারণ অবকাঠামো ও উন্নয়ন খাতের ব্যয়ে অতিমাত্রায় লাগাম টেনে ধরা। গত মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ৪৫ হাজার কোটি টাকা কমিয়েছে সরকার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সংশোধিত এডিপির মাত্র সাড়ে ৩৬ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ব্যয় কমেছে ২৫ হাজার কোটি টাকা।
তবে এডিবি, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক কিছু আশার কথাও শুনিয়েছে। তাদের মতে, আগামী বছর বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়বে। আইএমএফ আশা করছে, আগামী বছর আমাদের প্রবৃদ্ধি হতে পারে সাড়ে ৬ শতাংশ। আর বিশ্বব্যাংকের মতে, এটি ৪ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। অবশ্য এই আশাবাদের বাস্তবায়ন নির্ভর করবে বেশ কিছু ‘যদি’ এবং ‘কিন্তু’র ওপর। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যযুদ্ধ ও মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিদ্যমান উত্তেজনা যুদ্ধে গড়ালে তা শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, পুরো বিশ্বকেই অস্থিতিশীল করতে পারে। এ ধরনের কোনো সংকট তৈরি হলে তা কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সেই পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে, দ্রুততম সময়ে তার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান প্রয়োজন। ভারতের বিমানবন্দর ব্যবহার করে তৈরি পোশাক রপ্তানির সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এই ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনতে দ্রুত আমাদের নিজস্ব সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর লক্ষ্যে স্থানীয় শিল্পে বিরাজমান সমস্যাগুলোর সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সরকারের উচিত উদ্যোক্তাদের সঙ্গে নিবিড় সংলাপে যাওয়া। তাদের মধ্যে আক্ষেপ আছে, সরকার বিদেশি বিনিয়োগ ও অন্যান্য ইস্যুতে যত আগ্রহী, স্থানীয় বিনিয়োগের ব্যাপারে ততটাই উদাসীন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, বিশেষ করে মব-সন্ত্রাস কঠোরভাবে দমনে আরও কার্যকর উদ্যোগ জরুরি। পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে মৌলিক সংস্কারগুলো করে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা অপরিহার্য। কারণ অসংখ্য ইস্যু আছে, শতভাগ সদিচ্ছা থাকলেও রাজনৈতিক ও স্থিতিশীল সরকার ছাড়া যেগুলোর সমাধান দুরূহ।
দীর্ঘদিন ধরে দেশের শ্রমবাজারে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। প্রতিবছর প্রায় ২৪ লাখ তরুণ এই বাজারে আসছে। কিন্তু তাদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। গত নয় মাসে নতুন কর্মসংস্থান আরও সীমিত হয়ে পড়েছে। উল্টো এই সময়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। তাই প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার ব্যাপারে।
জিয়াউর রহমান : সাংবাদিক ও বিশ্লেষক