কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

আইএমএফের ঋণ শর্ত ও বাংলাদেশের অর্থনীতি

সেলিম জাহান । সূত্র : বণিক বার্তা, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

আইএমএফের ঋণ শর্ত ও বাংলাদেশের অর্থনীতি

আন্তর্জাতিক মুদ্রাভাণ্ডারের (আইএমএফ) সঙ্গে বাংলাদেশের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে। সাত কিস্তির এ ঋণ কর্মসূচির তিন কিস্তিতে এ পর্যন্ত ২৩১ কোটি ডলার পাওয়া গেছে।

 

 

আন্তর্জাতিক মুদ্রাভাণ্ডারের (আইএমএফ) সঙ্গে বাংলাদেশের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে। সাত কিস্তির এ ঋণ কর্মসূচির তিন কিস্তিতে এ পর্যন্ত ২৩১ কোটি ডলার পাওয়া গেছে। বাকি চার কিস্তিতে প্রাপ্তব্য ২৩৯ কোটি ডলার। চতুর্থ কিস্তির ঋণ মোট ৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার পাওয়ার কথা ছিল দুই মাস আগে গত ডিসেম্বরে। কিন্তু সংবাদে প্রকাশ যে ঋণের চতুর্থ কিস্তির প্রাপ্তি বিলম্বিত হবে।

 

 

এ বিলম্বের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক মুদ্রাভাণ্ডার উভয়েরই ভাষ্য রয়েছে। মোটা দাগে মুদ্রাভাণ্ডার বলেছে যে তাদের দেয়া শর্ত পূরণ না করার কারণে চতুর্থ কিস্তির ঋণ সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে এবং বাংলাদেশ সরকার বলেছে যে কিছু কিছু দেয়া শর্ত এখনই মানা সম্ভব নয়। বৈশ্বিকভাবে এ জাতীয় ঘটনা আন্তর্জাতিক মুদ্রাভাণ্ডারের জন্য নতুন কিছু নয়। কঠিন শর্তসাপেক্ষে উন্নয়নশীল দেশে ঋণ দেয়া এবং সেসব শর্ত কঠোরভাবে পালন না হলে ঋণ স্থগিত করা মুদ্রাভাণ্ডারের কর্মসংস্কৃতির এক উল্লেখযোগ্য অংশ।

 

 

আশির দশকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাঠামোগত সাযুজ্য কর্মসূচির কথা হয়তো অনেকেরই মনে আছে। নানা অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সে সময় এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বহু দেশকে আন্তর্জাতিক মুদ্রাভাণ্ডারের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়েছিল। সেসব ঋণের বিপরীতে মুদ্রাভাণ্ডার কঠোর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার লক্ষ্যের শর্ত আরোপ করেছিল। সেসব লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে নানা দেশের স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি বিঘ্নিত হয়েছে, দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে, অসমতা ঘনীভূত হয়েছে এবং সামাজিক খাত সংকুচিত হয়েছে। এক কথায়, মানুষের জীবনকে অস্থিতিশীল করে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সে সময়েও তাদের দেয়া শর্ত পূরণ না করতে পারায় বহু দেশের প্রতিশ্রুত ঋণের কিস্তি আটকে রাখা হয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঋণ পর্যন্ত বাতিল করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রাভাণ্ডারের পরিপ্রেক্ষিতে আশির দশকের বাংলাদেশের অভিজ্ঞতাও এর ব্যত্যয় নয়।

 
 

এবারেও চতুর্থ কিস্তির ঋণ বিলম্বিত হওয়ার কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রাভাণ্ডার শর্ত পূরণ না হওয়ার কারণ দেখিয়েছে। তাদের ভাষ্যমতে, আগের অনেক শর্ত পূরণ হয়নি এবং নতুন করে পূরণ না হওয়া শর্ত বেড়েছে। একটি শর্ত ছিল, রাজস্বনীতি থেকে রাজস্ব প্রশাসনকে পৃথক করা। কিন্তু সে ব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। শর্তের মধ্যে ব্যক্তিগত আয়কর থেকে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, মূল্য সংযোজন করের হার ঠিক করা, করছাড় কমিয়ে আনাও ছিল। সেসব ক্ষেত্রেও অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। শর্তের তালিকা এখানেই শেষ নয়। আর্থিক খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন ও পুরনো আইনের সংশোধন, সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে নিয়ে আসা, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারটি ক্রমান্বয়ে বাজারের হাতে ছেড়ে দেয়া ইত্যাদিও শর্তের অংশ।

 
 

এসব ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের ভাষ্য হচ্ছে যে শর্তের ক্ষেত্রে বেশকিছু বিষয় আছে, যার বাস্তবায়ন তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভব নয়। তাছাড়া সরকারের বেশকিছু করণীয় কাজ আছে, তাই তারা অত তাড়া করছে না। সেই সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে এটাও বলা হচ্ছে যে কিছু শর্ত আছে, যা মুদ্রাভাণ্ডার বললেই সরকার পূরণ করবে না। কারণ এখন বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির অবস্থা ভালো—চলতি হিসাব, আর্থিক হিসাব এবং প্রবাসী আয় ইতিবাচক। তাই আন্তর্জাতিক মুদ্রাভাণ্ডারের ঋণের কিস্তি পাওয়ার জন্য সরকার মরিয়া হয়ে উঠছে না। মুদ্রাভাণ্ডার যদি এখন কিছু নাও দেয়, তাতে কিছু যায়, আসে না, এমন ভাষ্যও শোনা যাচ্ছে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে।

 

 

তবে বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মুদ্রাভাণ্ডারের স্থগিত ঋণ-কিস্তি সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। এক. বিগত বিপর্যয় থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। কোনো কোনো সূচকে যদিও সাময়িক স্বস্তির চিহ্ন দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সেগুলো এখনো শক্ত বজায়ক্ষম ভিত্তিভূমির ওপর দাঁড়িয়ে নেই। সুতরাং আন্তর্জাতিক মুদ্রাভাণ্ডারের ঋণের বিষয়ে আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি অত্যন্ত পরিষ্কার দৃঢ অবস্থান আমরা নিশ্চয়ই নেব, কিন্তু আমাদের বক্তব্যে আমাদের তিনটি বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এক. আমাদের কথা যেন কোনো অনভিপ্রেত স্পর্শকাতরতার সৃষ্টি না করে; দুই. আমাদের এমন কথা বলা উচিত নয় যা পরবর্তী সময়ের বাস্তবতায় আমাদের আবার ফিরিয়ে না নিতে হয়; এবং তিন. আমরা জনগণকে যেন বিভ্রান্তিকর আশ্বাস না দিই।

 

 

দুই. আমাদের অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠভাবে মূল্যায়ন করতে হবে যে ঋণ কর্মসূচিটি আমাদের প্রয়োজন আছে কিনা এবং সেটা আমরা চলমান রাখতে চাই কিনা। এটা কোনো রাজনীতির ব্যাপার নয়, কোনো আবেগের ব্যাপার নয়, এটা একটা বিশুদ্ধ প্রয়োজনের ব্যাপার। একই সঙ্গে মনে রাখা দরকার যে প্রশ্নটি এটা নয় যেন ঋণের শর্তগুলোর ক্ষেত্রে আমরা কঠোর কিংবা নমনীয় অবস্থান নেব কিনা। প্রশ্নটি হচ্ছে, কেমন করে আমরা সে ব্যাপারে একটি বাস্তবসম্মত অবস্থান নিতে পারি।

 

 

তিন. ঋণ কর্মসূচিটি যদি আমরা বজায় রাখতে চাই, তাহলে মনে রাখা দরকার যে শর্তগুলো আমাদের মানতে হবে। তবে সে ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মুদ্রাভাণ্ডারের সঙ্গে আশু আলোচনায় বসা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে কেন শর্তগুলো পূরণ করা যাচ্ছে না, সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা দরকার। এটাও অবশ্য আমাদের মনে রাখা দরকার যে কোন কোন সংস্কার আমাদের স্বার্থেই করা দরকার, আন্তর্জাতিক মুদ্রাভাণ্ডার তা বলছে বলে নয়।

 

 

ঋণ-কিস্তি না পাওয়ার একটা নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশ অর্থনীতিতে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এ কিস্তি স্থগিত হওয়ার ফলে বিশ্বব্যাংকের বাজেট সহায়তাও আটকে যাবে কিনা, সেটাও দেখা দরকার। প্রতিবারই ঋণ-কিস্তি ছাড়ের জন্য মুদ্রাভাণ্ডারের নির্বাহী পর্ষদের অনুমোদন লাগে। চতুর্থ কিস্তির ছাড়ের বিষয়টি আলোচনার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রাভাণ্ডার ফেব্রুয়ারির বদলে মার্চে বৈঠকে বসছে। বাংলাদেশ সরকার মতামত ব্যক্ত করেছেন যে মার্চে নয়, বরং আন্তর্জাতিক মুদ্রাভাণ্ডারের নির্বাহী পর্ষদের জুন বৈঠকে দুটি কিস্তি—চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির প্রস্তাব পর্ষদে উঠুক। এ প্রস্তাবেরও বাস্তবসম্মত ও নির্মোহ বিবেচনা হওয়া প্রয়োজন বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিপ্রেক্ষিতে।

 

 

সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক

মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন