কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়নে সরকারের লাভ-ক্ষতি

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান [সূত্র : যুগান্তর, ০৮ মে ২০২৫ ]

আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়নে সরকারের লাভ-ক্ষতি

গত ১২ এপ্রিল মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঐকমত্য কমিশনের দুই সদস্যের সঙ্গে বৈঠকে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বলে পরদিন পত্র-পত্রিকাগুলো খবর ছেপেছে। বৈঠকে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ ও সদস্য বদিউল আলম মজুমদার অংশ নেন এবং এ সময় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য গঠন) মনির হায়দার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বলে আমরা জেনেছি। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের বক্তব্য অনুযায়ী, বৈঠকে অধ্যাপক আলী রীয়াজ ও বদিউল আলম মজুমদার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রমের অগ্রগতি সম্পর্কে চেয়ারম্যানকে অবহিত করেন। তারা প্রধান উপদেষ্টাকে জানান, বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনা চলমান রয়েছে। সংস্কার কার্যক্রমের বিষয়ে জনমত যাচাই এবং সে বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচিও গ্রহণ করা হয়েছে।

 

 

 

আমরা সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বিভিন্ন বক্তব্য থেকে দেখতে পাচ্ছি, একদিকে নির্বাচন, অন্যদিকে দেশ ও জনগণের প্রতি অঙ্গীকার থেকে বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নই তাদের অন্যতম লক্ষ্য। কিন্তু, সংস্কারের দৃশ্যমান অগ্রগতি না থাকায় কিছুদিন ধরে সংস্কারপ্রত্যাশী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে যে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে, বিভিন্ন সময় তাদের বক্তব্যে সেই আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। তবে সরকার যেহেতু আন্তরিকভাবেই কাঠামোগত সংস্কারের পক্ষে, সেক্ষেত্রে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক বিরোধ নেই, নেই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা-সেগুলো বাস্তবায়ন করে এসব চাপ মোকাবিলা করার একটা সুবিধা নিতে পারে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের এমনই একটি সুপারিশ ‘বাংলাদেশ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সার্ভিস’, যেখানে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের আইসিটি কর্মকর্তাদের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। সরকার কেন আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়ন করতে চাইছে, এমন প্রশ্নে মোটা দাগে আমরা তিনটা কারণ খুঁজে পাই। প্রথমত, আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়নে কোনো রাজনৈতিক বিরোধ নেই। দ্বিতীয়ত, এটি বাস্তবায়নে কোনো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নেই। তৃতীয়ত, এ বিষয়ে সরকারের কোনো বাড়তি ব্যয়ও করতে হবে না। আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়নের লাভের বিবেচনার আগে একটু দেখা যাক, এটি বাস্তবায়িত না হওয়ায় সরকার আসলে কী কী সমস্যার ভেতরে আছে।

 

 

 

আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়ন না করার ফলে সরকার যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, সেগুলো আসলে এক কথায় প্রকাশযোগ্য নয়। তারপরও আমরা সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে প্রতিনিয়ত যেসব সমস্যা দেখি, সেগুলো হলো মোটাদাগে-বিদেশমুখিতা, বিদেশি কনসালট্যান্ট নির্ভরতা ও বিদেশ নির্ভর প্রযুক্তির প্রচলন; সাইবার ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকারের দক্ষ জনবলের অভাব এবং আমাদের অরক্ষিত সাইবার স্পেস; সরকারি আইসিটি কর্মকর্তাদের যথাযোগ্য কর্মপরিবেশ নিশ্চিত না করা ও বঞ্চনার ফলে আইসিটি উদ্যোগগুলো টেকসই না হওয়া; একই উদ্যোগ একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠান বিচ্ছিন্নভাবে বাস্তবায়ন করার ফলে সমন্বয়হীনতা, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারি আইসিটি সেক্টরের যথাযথ প্রস্তুতি না থাকা; বৈষম্য ও শোষণের শাসন জিইয়ে রাখা এবং সুবিধাভোগীদের সুবিধা দিতে সর্বত্র শতভাগ অটোমেশন চালু না করে জনগণের সেবাপ্রাপ্তির অধিকার ক্ষুণ্ন করা;

 

 

 

দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারি চাকরিতে আসা আইসিটি গ্র্যাজুয়েটদের হতাশাগ্রস্ত করে তোলার মাধ্যমে বিদেশে মেধাপাচারকে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করা এবং দীর্ঘমেয়াদে মেধাবীদের সরকারি আইসিটি সেক্টরে আগমন নিরুৎসাহিত করা; সরকারের আইসিটি সেক্টর একক কোনো প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের আওতায় পরিচালিত না হওয়ায় যেখানে যে দক্ষতাভিত্তিক আইসিটি কর্মকর্তার প্রয়োজন, সরকারের তা নিশ্চিত করতে না পারা; সমন্বিত (ইন্টিগ্রেটেড) সিস্টেম তৈরি না হওয়ায় একই উদ্দেশ্যে তৈরিকৃত সিস্টেম ভিন্ন ভিন্ন দপ্তর বিচ্ছিন্নভাবে তৈরি করার ফলে দেশ ও জনগণের অর্থ ও সময়ের অপচয়; সরকার ঘোষিত ক্রিটিক্যাল ইনফরমেশন ইনফ্রাস্ট্রাকচারের (সিআইআই) মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণ ঝুঁকিতে ফেলা; সর্বোপরি জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানের UN-IDI বৈশ্বিক র‌্যাংকিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান সুসংহত করতে না পারার মতো বিষয়গুলো আমাদের চোখে ভাসে।

 

 

 

আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়িত হলে সরকারের বিদেশনির্ভরতা কমবে, ফলে দেশীয় প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে; সরকারি আইসিটি সেক্টরে যথাযোগ্য কর্মপরিবেশ নিশ্চিত হবে, ফলে দেশসেরা মেধাবীরা সরকারের আইসিটি সেক্টরে কাজ করতে উৎসাহিত হবেন। এতে মেধা পাচার রোধ করা সম্ভব হবে; সরকারের কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত একটি দক্ষ, চৌকশ ও মেধাবী আইসিটি ওয়ার্ক ফোর্স থাকলে যাদের দিয়ে সর্বত্র অটোমেশনের সুযোগ তৈরি হবে, ফলে বাংলাদেশের আজন্ম দুঃখ যে দুর্নীতি, সে দুর্নীতির সুযোগ সীমিত হবে; আইসিটিবেজড অটোমেটেড সিস্টেম হওয়ার ফলে বৈদেশিক বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে ও রেমিট্যান্স আহরণ বৃদ্ধি পাবে; আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়িত হলে দেশসেরা মেধাবীরা সরকারি চাকরিতে আসার উৎসাহ পাবেন, ফলে নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষ ও প্রশিক্ষিত বিশেষায়িত আইসিটি ফোর্স তৈরি হবে, যা সরকারের আইসিটি সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে এবং দেশ UN-IDI-এর মতো ই-গভর্ন্যান্স বিষয়ক বৈশ্বিক র‌্যাংকিয়ে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পারবে।

 

 

 

একটা উদ্ভাবনী, দক্ষ ও সুশৃঙ্খল আইসিটি সার্ভিস থাকলে দেশের সব ডিজিটাল সিস্টেম ও আইসিটি অবকাঠামো, ক্রিটিক্যাল ইনফরমেশন ইনফ্রাস্ট্রাকচারের নিরাপত্তা বিধান, মেইনটেন্যান্স ও সেবা প্রদান নিশ্চিত হবে; ই-জিপি, ই-পাসপোর্ট, ই-নথি, ই-মিউটেশন, ই-পর্চা, ই-খতিয়ান, ই-রিটার্ন, ই-বিআইএন, ই-টিআইএন, মৌজা ম্যাপ, এলডি ট্যাক্স, এনআইডি সার্ভিস, আইবাস++, জাতীয় তথ্য বাতায়ন, অনলাইন সঞ্চয়পত্র, এ চালান, অনলাইন জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, ডিজিটাল আরজেএসসি, সিডিএস.পোস্ট, আইপিএস.পোস্ট, বিআরটিএ সার্ভিস পোর্টালের মতো মেগা অ্যাপ্লিকেশনের ব্যবহার ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকার আত্মবিশ্বাসী হবে; সব থেকে বড় কথা আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়িত হলে সরকার সবখানে শতভাগ আইসিটিবেজড অটোমেটেড ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারবে। ফলে সরকারের রাজস্ব আহরণ ও ট্যাক্স কালেকশন বৃদ্ধি পাবে। রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি পেলে এবং দুর্নীতির সুযোগ সীমিত হলে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত হবে, এর ফলে সরকারের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে।

 

 

 

সংস্কারের যে অঙ্গীকার নিয়ে সরকার যাত্রা শুরু করেছিল, তা রাখার জন্য হলেও সরকারের আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা দরকার। তাহলে সরকার যে সংস্কারের অঙ্গীকার পূরণে বদ্ধপরিকর, এটা বলার একটা নৈতিক ভিত্তি পাবে। সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে সরকারের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থার যে দোলাচল, তা কাটাতে হলেও সরকার এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। শুধু তাই নয়, বিগত পতিত সরকারের আমলে আইসিটিতে যে দুর্নীতি বাণিজ্য হয়েছে, তা প্রতিরোধে সরকার যে আন্তরিক এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ ও আইসিটি সেক্টরের শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য সত্যিই যে কাজ করছে, তা প্রমাণে আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়ন সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে। আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়নে কেউ যদি রাজনৈতিক লাভও খোঁজে, সেটারও সুযোগ আছে।

 

 

সরকারকেই এখন প্রমাণ করতে হবে দেশ ও জাতির কাছে দেওয়া কাঠামোগত সংস্কারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে তারা কতটা আন্তরিক। কোনো রাজনৈতিক দ্বিমত কিংবা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা না থাকা একটা নির্বিবাদী ইস্যু ‘আইসিটি সার্ভিস’ বাস্তবায়ন করে সরকার শহিদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবে, নাকি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়ন না করে নিজের ওপর প্রতিনিয়ত চাপ তৈরি করবে, এ সিদ্ধান্তই তাদের। কিন্তু আমাদের চাওয়া একটাই, বীর শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে আর কোনো বৈষম্য ঠাঁই না পাক। শহিদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এ নতুন বাংলাদেশ হোক প্রযুক্তিনির্ভর, শোষণহীন, বৈষম্যমুক্ত, সমৃদ্ধ।

 

 

 

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান : যুগ্মসচিব, গভর্নমেন্ট আইসিটি অফিসার্স ফোরাম