কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

আজ বেদনাবিধুর পলাশী দিবস

শহীদুল ইসলাম [সূত্র : যুগান্তর, ২৩ জুন ২০২৫]

আজ বেদনাবিধুর পলাশী দিবস

আজ ঐতিহাসিক পলাশী ট্র্যাজেডি দিবস। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলা, বিহার, ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা মীরজাফরদের ষড়যন্ত্রের কারণে লর্ড ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ইংরেজ বাহিনীর কাছে পরাজিত হন। তার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে দেশ প্রায় ২০০ বছরের জন্য ব্রিটিশ বেনিয়াদের করতলগত হয়।

 

 

পলাশীর যুদ্ধ (২৩ জুন ১৭৫৭) বাংলা এবং ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, যা প্রায় দুইশ বছর স্থায়ী ছিল। পলাশী যুদ্ধের মূল কারণ ছিল নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে ইংরেজ বণিকদের দ্বন্দ্ব। নবাবের প্রধান সেনাপতি মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ইংরেজরা যুদ্ধে জয়লাভ করে। এ যুদ্ধের ফলে বাংলা ব্রিটিশদের হাতে চলে যায় এবং সেখান থেকেই ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের সূচনা হয়। পলাশী যুদ্ধের পরবর্তী বছরে বাংলাসহ পুরো ভারত ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল। এ সময়ে ব্রিটিশরা এ অঞ্চলের সম্পদ শোষণ করে এবং স্থানীয় মানুষের ওপর বিভিন্ন ধরনের নিপীড়ন চালায়। এ দীর্ঘ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পর্যায়ে বিদ্রোহ ও আন্দোলন দানা বাঁধে, যার মধ্যে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ ছিল উল্লেখযোগ্য।

 

 

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হয়। তবে বাংলা ভাষী অঞ্চলের মানুষ নিজেদের সংস্কৃতি ও ভাষার অধিকারের জন্য সংগ্রাম করতে থাকে। অবশেষে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণ দীর্ঘ স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, যা বাংলাদেশ নামে পরিচিত।

 

 

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭৫৭ সালের ১২ জুন কলকাতার ইংরেজ সৈন্যরা চন্দননগরের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। সেখানে দুর্গ রক্ষার জন্য অল্পকিছু সৈন্য রেখে তারা ১৩ জুন অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে যুদ্ধযাত্রা শুরু করে। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পথে হুগলী, কাটোয়ার দুর্গ, অগ্রদ্বীপ ও পলাশীতে নবাবের সৈন্য থাকা সত্ত্বেও তারা কেউ ইংরেজদের পথরোধ করেনি। ফলে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বুঝতে পারেন, তার সেনাপতিরাও এই ষড়যন্ত্রে শামিল।

 

 

বিদ্রোহের আভাস পেয়ে সিরাজ মীরজাফরকে বন্দি করার চিন্তা পরিত্যাগ করেন। তিনি মীরজাফরকে ক্ষমা করে তাকে শপথ নিতে বলেন। মীরজাফর পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে অঙ্গীকার করেন যে, তিনি শরীরের একবিন্দু রক্ত থাকতেও বাংলার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন হতে দেবেন না। গৃহবিবাদের মীমাংসা করে নবাব রায় দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, মীরজাফর, মীর মদন, মোহন লাল ও ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রেঁকে সৈন্য চালানোর দায়িত্ব দিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করেন।

 

২৩ জুন সকাল থেকেই পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজরা মুখোমুখি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। তার আগের দিন ২২ জুন মধ্যরাতে রবার্ট ক্লাইভ কলকাতা থেকে তার বাহিনী নিয়ে পলাশী মৌজার লক্ষবাগ নামে আম্রকাননে এসে তাঁবু গাড়েন। বাগানটির উত্তর-পশ্চিম দিকে গঙ্গা নদী। সকাল ৮টায় হঠাৎ করেই মীর মদন ইংরেজ বাহিনীকে আক্রমণ করেন। তার প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে ক্লাইভ তার সেনাবাহিনী নিয়ে আমবাগানে আশ্রয় নেন। ক্লাইভ কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন। মীর মদন ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলেন।

 

কিন্তু মীরজাফর, ইয়ার লতিফ ও রায় দুর্লভ যেখানে সৈন্য সমাবেশ করেছিলেন, সেখানেই নিষ্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। দুপুরের দিকে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে সিরাজউদ্দৌলার গোলাবারুদ ভিজে যায়। তবুও সাহসী মীর মদন এবং অপর সেনাপতি মোহন লাল ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই গোলার আঘাতে মীর মদন মারাত্মকভাবে আহত হন এবং মারা যান। নবে সিং হাজারী ও বাহাদুর খান প্রমুখ গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধানও একই সঙ্গে মারা যান। সিরাজউদ্দৌলা মীরজাফর ও রায় দুর্লভকে তাদের অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে তীব্র বেগে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেন। কিন্তু উভয় সেনাপতি তার নির্দেশ অমান্য করেন। তাদের যুক্তি ছিল গোলন্দাজ বাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া অগ্রসর হওয়া আত্মঘাতী ব্যাপার।

 

কিন্তু কোম্পানি ও নবাবের বাহিনীর মধ্যে তখন দূরত্ব মাত্র কয়েকশ গজ। বিশ্বস্ত সেনাপতি মোহন লাল নবাবকে পরামর্শ দেন যুদ্ধবিরতি ঘটলে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী; কিন্তু সিরাজ মীরজাফর প্রমুখের পরামর্শে পশ্চাৎপসরণের সিদ্ধান্ত নেন। বিকাল ৫টায় সিরাজউদ্দৌলার বাহিনী নির্দেশনার অভাবে এবং ইংরেজ বাহিনীর গোলন্দাজি অগ্রসরতার মুখে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে অর্থাৎ পরাজয় স্বীকার করে। নবাবের ছাউনি ইংরেজদের অধিকারে আসে।

 

 

সিরাজউদ্দৌলা তার সহধর্মিণী লুৎফুন্নেসা ও ভৃত্য গোলাম হোসেনকে নিয়ে রাজধানী থেকে বের হয়ে স্থলপথে ভগবানগোলায় পৌঁছে যান এবং সেখান থেকে নৌকাযোগে পদ্মা ও মহানন্দার মধ্য দিয়ে উত্তরদিক অভিমুখে যাত্রা করেন। তার আশা ছিল পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছাতে পারলে ফরাসি সেনাপতির সহায়তায় সৈন্য সংগ্রহ করে বাংলাকে রক্ষা করবেন। কিন্তু তার সে আশা পূর্ণ হয়নি। সিরাজ পথিমধ্যে বন্দি হন ও মিরনের নির্দেশে মোহাম্মদী বেগের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন।

 

 

তার এই শাহাদতের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতাসূর্য ১৯০ বছরের জন্য অস্তমিত হয়।