কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

আজও প্রাসঙ্গিক ভাসানীর ফারাক্কা লংমার্চ

মোহাম্মদ ইমরান হোসেন [সূত্র : যুগান্তর, ১৬ মে ২০২৫]

আজও প্রাসঙ্গিক ভাসানীর ফারাক্কা লংমার্চ

১৬ মে আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসনবিরোধী লড়াইয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। আজ থেকে প্রায় অর্ধশতক আগে ১৯৭৬ সালের এই দিনে আয়োজিত হয়েছিল ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ। ভারত সীমান্তঘেঁষা চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে দাঁড়িয়ে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বাঙালি জাতিকে দিয়েছিলেন ঐতিহাসিক বার্তা : ‘জলের অধিকার ছাড় দেওয়া যায় না।’ ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে ভারত যখন একতরফাভাবে গঙ্গার প্রবাহ থামিয়ে বাংলাদেশের প্রাণপ্রবাহ বন্ধ করে দিতে উদ্যত হয়, তখন রাষ্ট্রীয় নীরবতা ভেঙে ভাসানী একাই লক্ষ জনতার নেতৃত্বে প্রতিবাদের মশাল জ্বালিয়েছিলেন। তার সেই প্রতিবাদ যেমন দেশের ইতিহাসের স্মরণীয় অধ্যায়, বর্তমান পরিস্থিতিতেও তেমনি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

 

 

ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের জন্য শুধু একটি প্রকৌশলগত বা কাঠামোগত সংকট ছিল না; ছিল রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক আত্মসমর্পণের বড় উদাহরণ। মওলানা ভাসানীই তা প্রথম বুঝেছিলেন। তাই তো ৯৬ বছরের বার্ধক্যকে উপেক্ষা করে লক্ষ জনতাকে সংগঠিত করে ৫০ মাইল দীর্ঘ ফারাক্কা লংমার্চের নেতৃত্ব দেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।

 

 

ভারত সরকার ১৯৬১ সালে গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শুরু করে, যা শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। আর সে বছরের ২১ এপ্রিল ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে পানি প্রত্যাহারের চুক্তি আদায় করে নেয় বাংলাদেশের কাছ থেকে। সেই যে পানি প্রত্যাহার শুরু হয়েছে, তারপর থেকে সব চুক্তি ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে তা অবিরতভাবে চালিয়ে গেছে ভারত। ফারাক্কা বাঁধ চালুর মাত্র ১ বছরেই এর প্রভাব পড়েছিল বাংলাদেশের পদ্মা এবং পদ্মার শাখা নদীগুলোর প্রবাহের ওপর। বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শুকনো নদী খাতে জমি চাষ অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল, পানির স্তর নেমে গিয়েছিল, নদীভাঙন বেড়েছিল, হুমকিতে পড়েছিল মানুষের জীবন-জীবিকা। মাত্র এক বছরের পর্যবেক্ষণেই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের ওপর জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ুগত ব্যাপক প্রভাব বুঝতে পারেন দূরদর্শী নেতা মওলানা ভাসানী। প্রাণ-প্রকৃতির পালনবাদী রাজনীতির প্রবক্তা মওলানা ভাসানীর সেই দূরদর্শিতা আজও বাঙালির পাথেয়।

 

 

তিনি ১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল হাসপাতাল থেকে ফিরেই বাংলাদেশের ন্যায্য পানির হিস্যা আদায়ে মাঠে নামেন আর ঘোষণা দেন ফারাক্কা লংমার্চের। শারীরিকভাবে অসুস্থ ও ৯৬ বছর বয়সি মওলানা ভাসানীর লংমার্চ ঘোষণায় বিস্মিত হয় তৎকালীন পুরো বাংলাদেশ। তবে তার দেশপ্রেম উদ্বুদ্ধ করে দেশের জনসাধারণকে। তাই তো তার ডাকে সাড়া দিয়ে ১৬ মে রাজশাহীর মাদ্রাসা মাঠ থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট পর্যন্ত ৫০ মাইলের দীর্ঘ লংমার্চে অংশ নেন লক্ষ জনতা। পাশাপাশি রাস্তাপারের হাজার হাজার গ্রামবাসী খাবার আর পানি নিয়ে লংমার্চের ক্লান্ত জনতার পাশে দাঁড়ান। পরদিন ১৭ মে বিকালে কানসাটে পৌঁছে যায় বিশাল এ লংমার্চ। সেখানে উপস্থিত জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রীয় নীরবতার দেওয়াল ভেঙে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘নদীর পানি আটকে রাখা মানে আমাদের গলাটিপে ধরা। আমরা বাঁচতে চাই, বাঁচতে হলে পানি চাই। এই পানি আমাদের ন্যায্য অধিকার।’

 

 

 

ভাসানীর ঐতিহাসিক সেই লংমার্চ ছিল আন্তঃসীমান্ত নদীর পানির অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রথম জাতীয় আন্দোলন। তিনি শুধু শাসকগোষ্ঠী নয়, প্রতিবেশী শক্তিধর রাষ্ট্র ভারতের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। আজ, ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি-ভারতের পানি আগ্রাসন থামেনি, বরং তিস্তা থেকে শুরু করে আড়াই ডজন নদীর ওপর অন্যায্য নিয়ন্ত্রণ এখনো একই রকমভাবে চলমান। ফলে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের নদীগুলো পানিশূন্য থাকছে, বাড়ছে মরুকরণ। সেচের পানির অভাবে লাখ লাখ হেক্টর আবাদি জমি চাষের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। ফলে কৃষি পেশার সঙ্গে যুক্ত কোটি মানুষ দারিদ্র্যের কবলে পতিত হচ্ছে, বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন থেকে। পাশাপাশি বর্ষা মৌসুম এলে ভারতের আকস্মিকভাবে ছেড়ে দেওয়া পানিতে বন্যার শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। নদীর বুকে পলি জমে চর জাগছে আর দু-কূল তীব্র ভাঙনের শিকার হচ্ছে। ফলে নদীতে ঘরবাড়ি হারিয়ে জলবায়ু উদ্বাস্তু হচ্ছে লাখ লাখ পরিবার। ন্যায্য পানির হিস্যাবঞ্চিত হয়ে নদীমাতৃক বাংলাদেশ আজ মরুকরণের পথে! মওলানা ভাসানী ১৯৭৬ সালে যে আশঙ্কা করেছিলেন, আজ সেই আশঙ্কাই বাস্তব হয়ে দেখা দিচ্ছে। পুরো দেশের নদীকেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে প্রতিবেশী ভারত সরকার।

 

 

 

আন্তর্জাতিক আইনগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গত ৫০ বছর ধরে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে চলেছে ভারত। অথচ ভারতের এ হেন কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারযোগ্য। ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘ জলপ্রবাহ কনভেনশনের ৫ ও ৬ ধারায় বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি ন্যায্য ও যুক্তিসংগত অধিকারের ভিত্তিতে সব অংশীদার রাষ্ট্রের মধ্যে বণ্টিত হতে হবে। কোনো রাষ্ট্র একতরফাভাবে প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ১৯৬৬ সালের হেলসিংকি সনদের ৪ ও ৭ ধারা অনুযায়ী, উজানের দেশকে আন্তঃসীমান্ত নদীর এমন ব্যবহার পরিহার করতে হবে, যা ভাটির দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কিন্তু বাস্তবে ভারত এসব নীতির ঘোরতর লঙ্ঘন করে যাচ্ছে, যার ফলে নদীভিত্তিক বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি ও অর্থনীতিতে প্রতিনিয়ত প্রভাব পড়ছে।

 

 

 

‘Equitable and Reasonable Utilization' এবং 'No Significant Harm’-এ দুটি নীতি আন্তর্জাতিক জলনীতির ভিত্তি। কিন্তু ভারত এ নীতিগুলোর সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে একতরফা পানি প্রত্যাহার করে চলছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতি, কৃষি ও পরিবেশ চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া ১৯৯২ সালের জাতিসংঘ জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ৩নং ধারা বলছে, কোনো দেশ তার সম্পদের ব্যবহারসংক্রান্ত এমন কোনো কর্মকাণ্ড করতে পারবে না, যা তার পার্শ্ববর্তী দেশের পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ আইনও লঙ্ঘন করে ভারত বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে মরুকরণের হুমকিতে ফেলেছে।

 

 

 

২০২৪ সালের ঐতিহাসিক জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ ভারতপন্থি নতজানু সরকারকে সরিয়ে দিয়ে একটি বাংলাদেশপন্থি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। জনগণ চায় একটি দৃঢ়, আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্রনীতি, যেখানে দেশের স্বার্থ থাকবে সর্বাগ্রে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার আন্তর্জাতিক মঞ্চে আন্তঃসীমান্ত নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দাবি করে কোনো জোরালো অবস্থান নেয়নি। জাতিসংঘ, সার্ক, BIMSTEC বা অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে এ ইস্যু উপস্থাপন করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনের উদ্যোগও দেখা যায়নি। কিংবা দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে যৌথ নদী কমিশনকে পুনর্গঠন এবং কার্যকর করার উদ্যোগও চোখে পড়েনি। এমনকি বাংলাদেশের পক্ষে থাকা জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের জলপ্রবাহ কনভেনশনে পর্যন্তও অনুসমর্থন দেওয়ার ঘোষণা বা সিদ্ধান্তের কথা পর্যন্ত শোনা যায়নি। উজানের দেশ ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে বাংলাদেশের পক্ষে এর চেয়ে বড় আন্তর্জাতিক আইন ও প্ল্যাটফর্ম আর কী হতে পারে! যৌথ নদীর যৌক্তিক জলবণ্টন নিশ্চিতে সরকারের জোরালো ভূমিকা না থাকাটা জনগণের প্রত্যাশার পরিপন্থি। সরকারকে বুঝতে হবে, পানি শুধু কূটনৈতিক ইস্যু নয়; এটি জাতীয় নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশগত অস্তিত্বের প্রশ্ন।

 

 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল পিএইচডি করেছেন গঙ্গার পানিবণ্টন ও আন্তর্জাতিক নদী আইনের ওপর। আইনের অভিজ্ঞ শিক্ষক হওয়ায় আন্তর্জাতিক আইন নিয়েও তার জ্ঞান যথেষ্ট। ক্ষমতা গ্রহণের আগে তাকে তিস্তার পানি নিয়ে যতটা সরব দেখা গেছে, ক্ষমতায় গিয়ে তিনি সেটি কতটুকু মনে রেখেছেন, সেটি নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। তিনি আন্তরিক হলে সরকার আন্তঃসীমান্ত নদী নিয়ে দক্ষ কূটনৈতিক পথে অগ্রসর হতে পারবে বলেই বিশ্বাস করি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা করা হয়েছে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে।

 

 

 তিনি দীর্ঘদিন ধরে নদী নিয়ে কাজ করছেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহীও ছিলেন তিনি। আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি এখন নদী সুরক্ষার জন্যও দায়িত্বপ্রাপ্ত। তার অভিজ্ঞতা তিস্তা, পদ্মাসহ ৫৪টি যৌথ নদী ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। তাছাড়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন মুরশিদ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। নদী সুরক্ষা নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তারও। এ তিন উপদেষ্টা ছাড়া আরও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব বাংলাদেশের দীর্ঘকালের জলবণ্টন সমস্যার সমাধান আনতে না পারলে আমরা আসলে কার ওপরই বা আস্থা রাখব! আশা করি, তারা দ্রুততম সময়ে যৌক্তিক ও ফলপ্রসূ কূটনৈতিক ব্যবস্থা নেবেন।

 

 

২০২৫ সালের ১৬ মে যেন আমাদের কাছে শুধু স্মৃতিচারণের দিন হিসাবে না আসে, বরং বাংলাদেশের নবচেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার দিন হয়। ফারাক্কা লংমার্চ আজও প্রমাণ করে-যেখানে রাষ্ট্র নতজানু, সেখানে প্রতিবাদই পথ দেখায়। মওলানা ভাসানীর সাহস, নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতা আমাদের দেখিয়েছে কীভাবে একক সংগ্রামেও একটি জাতির অধিকার আদায়ে সাড়া জাগানো যায়। আজ আমাদের নাগরিকদেরও সেই চেতনায় জেগে উঠতে হবে। আন্তর্জাতিক আইন, জাতীয় ঐক্য ও কূটনৈতিক সাহসিকতা দিয়ে বাংলাদেশকে তার ন্যায্য জলের অধিকার আদায় করতে হবে। কারণ নদীর ন্যায্য পানির হিস্যা হারালে হারিয়ে যাবে নদীমাতৃক বাংলাদেশ।

 

মোহাম্মদ ইমরান হোসেন : যুগ্ম সদস্য সচিব, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি, ভাসানী পরিষদ