আলোচিত সব ইস্যু
সূত্র : কালবেলা, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুর পর প্রথম ওয়াশিংটন সফর করলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এ সফরে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টসহ শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, যা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে বিশ্বজুড়ে আলোচনা চলছে। দুই নেতার বৈঠকে বিভিন্ন বিষয়, বিশেষ করে বাণিজ্যিক বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে।
কমপ্যাক্ট বা সিওএমপিএসিটি
দুই নেতার বৈঠকের পর তারা কমপ্যাক্ট নামে একটি উদ্যোগের ঘোষণা দিয়েছেন। কমপ্যাক্ট—সিওএমপিএসিটি বা ক্যাটালাইজিং অপরচুনিটিজ ফর মিলিটারি পার্টানারশিপ, অ্যাকসিলারেটেড কমার্স অ্যান্ড টেকনোলজি ফর দ্য টুয়েন্টিওয়ানথ সেঞ্চুরি। এটি প্রতিরক্ষা, বিনিয়োগ, বাণিজ্য, জ্বালানি, উদ্ভাবনসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নতুন স্তরে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে একটি উদ্যোগ। এর মধ্যে নির্ধারিত কিছু লক্ষ্য বেশ উচ্চাভিলাষী বলে মনে হতে পারে।
‘মিশন ৫০০’
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ‘মিশন ৫০০’ ঘোষণা করা হয়েছে। যার লক্ষ্য হচ্ছে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যকে ৫০০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়া। বর্তমানে দেশ দুটির মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ১২৯ বিলিয়ন ডলার। তাহলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে তা তিনগুণ বাড়াতে হবে।
ট্রাস্ট বা টিআরইউএসটি
ট্রাম্প-মোদির বৈঠকে আরেকটি উদ্যোগের ঘোষণা এসেছে, সেটি হলো ট্রাস্ট বা টিআরইউএসটি। ট্রাস্ট হলো ট্রান্সফর্মিং দ্য রিলেশনশিপ ইউটিলাইজিং স্ট্র্যাটেজিক টেকনোলজি। এই উদ্যোগের লক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ এবং উদীয়মান প্রযুক্তিতে অংশীদারত্ব বাড়ানো। পাশাপাশি চলতি বছরের শেষ নাগাদ একটি যৌথ ভারত-মার্কিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রোডম্যাপ চূড়ান্ত হবে। এ-সংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদানের জন্য কমপ্যাক্ট ও ট্রাস্টের মতো সংক্ষিপ্ত নাম গ্রহণ করা হয়েছে।
শতকোটি ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তি
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা বাণিজ্য প্রায় শূন্য থেকে বেড়ে ২০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এর মধ্য দিয়ে ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশে পরিণত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এখনো ভারতকে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র সরবরাহ করে রাশিয়া। ২০১৭ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তা ৬২ শতাংশ থেকে কমে ৩৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার করার বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ভারতে চলতি বছর থেকে ‘শত শত কোটি ডলারের’ সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি বাড়াবে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম (স্টেলথ) এফ৩৫ যুদ্ধবিমান সরবরাহের পথ তৈরি হবে। বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, এ বিষয়ে কথা বলা যতটা সহজ, কাজ করে দেখানো তার চেয়ে বেশি কঠিন। যেমন উইলসন সেন্টারের মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘এটি শুনতে ভালোই লাগে। এটি ঘোড়ার সামনে গাড়ি লাগানোর মতো একটি বিষয় হতে পারে।’
ইলন মাস্কের সঙ্গে মোদির বৈঠক
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও উদীয়মান প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও শীর্ষ ধনকুবের ইলন মাস্কের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন নরেন্দ্র মোদি। এই সাক্ষাতের সময় ভারতে ইলন মাস্কের মালিকানাধীন স্টারলিঙ্ক ইন্টারনেট সেবা বা ইলেকট্রিক গাড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান টেসলার ব্যবসা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।ভারতে সরাসরি স্টারলিঙ্ককে তরঙ্গ বরাদ্দ দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন ইলন মাস্ক। এ নিয়ে ভারতীয় ধনকুবের মুকেশ আম্বানির সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। স্টারলিঙ্কের তরঙ্গ নিলামের পক্ষে আম্বানি। তার লাইসেন্সের বিষয়টি এখনো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ভারতে গাড়ি উৎপাদন কারখানা স্থাপনের জন্য টেসলাকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে নয়াদিল্লি। এ নিয়ে এখনো নিজেদের পরিকল্পনা নিশ্চিত করেনি টেসলা।
‘মাগা’ আন্দোলনের প্রতি মোদির সমর্থন
বৃহস্পতিবারের বৈঠকে সৌজন্য বিনিময়ের সময় ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ (সংক্ষেপে মাগা) স্লোগানের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এর একটি ভারতীয় সংস্করণ উপস্থাপন করেন মোদি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন,“যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ বা মাগা স্লোগানের সঙ্গে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এটি ধার নিয়ে উন্নত ভারত গড়তে আমরা বেছে নিয়েছি ‘মেক ইন্ডিয়া গ্রেট অ্যাগেইন’ বা মিগা।” তিনি বলেন, ‘যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত একসঙ্গে কাজ করে, তখন মাগা ও মিগা এক করে মেগা হয়ে যায়। এটি একটি মেগা অংশীদারত্ব, যা (দুই দেশকে) সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবে।’ বিজেপির নীতিকেও ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এজেন্ডার সঙ্গে তুলনা করেন মোদি। তার দাবি, তিনিও নিজ দেশের স্বার্থকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন।
বাণিজ্য চুক্তিতে ভারতের ছাড়
ট্রাম্পের শুল্কের মুখে দেশে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে, এই আশঙ্কায় বিশ্বনেতাদের অনেকেই ট্রাম্পের দাবি মেনে নিচ্ছেন বা বিভিন্ন খাতে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন। বৃহস্পতিবার মোদিও এমন কিছু প্রস্তাব নিয়ে হাজির হন। বর্তমানে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতির জন্য ভারতের আরোপ করা শুল্ককে দায়ী করেছেন ট্রাম্প। মোদি বলেন, ‘আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ দ্বিগুণেরও চেয়েও বাড়িয়ে ৫০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি।’ ট্রাম্প আরও জানান, বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি পণ্য আমদানি বাড়াবে ভারত। প্রধানমন্ত্রী এবং আমি জ্বালানি সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিতে সম্মত হয়েছি, যা যুক্তরাষ্ট্রকে আবার ভারতের শীর্ষ তেল-গ্যাস সরবরাহকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।
‘সন্ত্রাসবাদের’ বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ওপর জোর
যদিও চীনের আন্তর্জাতিক প্রভাব মোকাবিলাই ছিল বৈঠকের সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয়, তবে আরেকটি নিরাপত্তা ইস্যু এই দুই নেতার আলোচনায় উঠে এসেছে, তা হচ্ছে ‘সন্ত্রাসবাদের’ আতঙ্ক। মুম্বাই হামলায় অভিযুক্ত শিকাগোর ব্যবসায়ী তাহাওয়ার রানাকে ভারতে প্রত্যর্পণের অনুমোদন দেন ট্রাম্প। ডেনমার্কের একটি সংবাদ সংস্থার ওপর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সহায়তার অভিযোগে ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় আদালত ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেন রানাকে। ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ থাকলেও রানাকে এখনো দোষী সাব্যস্ত করেনি আদালত। রানা ভারতে প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন। গত মাসে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট তার প্রত্যর্পণ বন্ধের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। বৃহস্পতিবার ট্রাম্পের অনুমোদনের পর এখন এটি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেল।
ইউক্রেন যুদ্ধ
সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক নয়, বারবার ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আলোচনার ব্যাপারে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে ট্রাম্পকে। বৃহস্পতিবার সকালেই ট্রাম্প জানান, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তার ‘দীর্ঘ ও বেশ ফলপ্রসূ’ একটি ফোনালাপ হয়েছে। এরপর তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গেও ফোনে কথা বলেছেন বলে জানান। ট্রাম্প বলেন, ‘রাশিয়া (ইউক্রেনের) অনেক বড় একটি অংশ দখল করে নিয়েছে। তারা প্রথমদিন থেকেই বলে আসছে—তারা ইউক্রেনকে ন্যাটোর অংশ হতে দেবে না। এটি তারা বেশ জোরালোভাবেই বলেছে। আমি বিশ্বাস করি, এজন্যই যুদ্ধটা শুরু হয়েছে।’ মোদি এই আলোচনায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বিশেষ কোনো মন্তব্য করেননি। ট্রাম্পের সাম্প্রতিক অবস্থান ভারতকে কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে। ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের শক্তিশালী সম্পর্ক আছে এবং বাইডেন প্রশাসনের সময় রাশিয়া থেকে তেল আমদানির জন্য ভারতকে চাপের মুখে পড়তে হয়েছিল।
ব্যতিক্রমী মোদি
ট্রাম্পের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে যোগ দেওয়া মোদির জন্য ব্যতিক্রমী একটি পদক্ষেপ। ওই সংবাদ সম্মেলনে অবৈধ অভিবাসন ও আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে মার্কিন বিচার বিভাগের ঘুষের অভিযোগ নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তিনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রায় ১১ বছর ক্ষমতায় রয়েছেন মোদি। ট্রাম্পের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় থাকাকালে মাত্র তিনবার সরাসরি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিলেন তিনি। মোদি কখনো একক সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেননি। এর আগে ২০১৯ সালে মোদি তার দল বিজেপির তৎকালীন প্রধান অমিত শাহর সঙ্গে একটি সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। সে সময়ে সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন অমিত শাহ। আর ২০২৩ সালে তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে একটি সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিয়ে মাত্র দুটি প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন মোদি।