কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়

ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী, সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়

যেকোনো জাতির জীবনে স্বাধীনতাসংগ্রাম সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও গৌরবময় ঘটনা। উনবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে আমরা বহু জাতিরাষ্ট্রের উত্থান দেখতে পাই। জাতীয়তাবাদ এক প্রচণ্ড শক্তি হিসেবে এর পেছনে কাজ করে। বস্তুত প্রতিটি জাতির রয়েছে তার স্বাধীনতাসংগ্রামের সুদীর্ঘ ইতিহাস।

বিংশ শতাব্দীতেও এই ধারা অব্যাহত থাকে। বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ঔপনিবেশিক শাসন এবং শোষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে স্বাধীনতাসংগ্রাম সংঘটিত হয়। জাতীয়তাবাদী শক্তিতে উদ্বুদ্ধ মুক্তিপাগল মানুষের কাছে হার মানতে বাধ্য হয় উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতাসংগ্রামের সফলতা কিংবা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে ভিয়েতনামের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বিরাট সাফল্য।
এ ছাড়া বর্তমান শতাব্দীতে এশিয়া, আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে আরো অনেক জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুত্থান ঘটে।

 

ফরাসি দার্শনিক রুশো তার ‘The Social Contract’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে ‘Man is born free and he is everywhere in chains’ অর্থাৎ মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত। মহান ফরাসি বিপ্লবের উদগাতা ও প্রেরণা জোগানকারী এই দার্শনিক অষ্টাদশ শতাব্দীতে পরাধীন মানুষের, বিশেষ করে ফরাসি দেশের শোষিত, নির্যাতিত এবং শৃঙ্খলিত মানুষের স্বাধীনতার জয়গান গেয়েছিলেন। যেহেতু স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার, তাই রুশো তার গ্রন্থে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতা অর্জনের দিকে পথনির্দেশ করেন।

তার এই মর্মবাণী ফরাসি দেশের মানুষের মধ্যে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণকে বিদ্রোহ ও বিপ্লবে উদ্বেলিত করেছিল। পরিণামে ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়। রাজতন্ত্রের অবসান হয়। ফরাসি দেশের মানুষ লাভ করে স্বাধীনতা।
তারও আগে সংঘটিত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাসংগ্রাম; এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমেরিকানরা লাভ করে তাদের স্বাধীনতা। বস্তুতপক্ষে পৃথিবীর দুটি মহান স্বাধীনতাসংগ্রাম—যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং ফরাসি বিপ্লব যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের নির্যাতিত, নিপীড়িত এবং পরাধীন মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল; অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল পরাধীনতার শৃঙ্খল ভঙ্গ করে স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণের, যা মানুষের জন্মগত অধিকার।

 

ফ্যাসিবাদ, রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র এবং অভিজাততন্ত্রের যুগ পেরিয়ে আমরা প্রবেশ করেছি গণতন্ত্রের যুগে। সারা বিশ্বের মানুষ আজ স্বাধীনতা এবং সাম্যের জয়গানে মুখরিত। তাই স্বাধীনতা কথাটি সবার কাছে অতি প্রিয়। তাই বলেছিলাম, যেকোনো জাতির জীবনে বা জাতির ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং গৌরবময় অধ্যায় হলো সে জাতির স্বাধীনতাসংগ্রাম। বাংলাদেশের বাঙালি জাতির সবচেয়ে মহান অর্জন তার স্বাধীনতা। এই জাতির সবচেয়ে গর্বের বিষয় মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। স্বাধীনতাযুদ্ধ তাই আমাদের পরম গর্বের বিষয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালে সংঘটিত হলেও এর ছিল এক সুদীর্ঘ প্রস্তুতিকাল। আমার মতে, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বাংলাদেশ সংগ্রামের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের জাতির পিতা ও গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা সফরে আসেন। তখন তিনি এক সভায় ঘোষণা করেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু ঢাকার নির্ভীক তরুণ ছাত্রসমাজ এর প্রতিবাদ করে। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে এ অঞ্চলের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ছিল সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। তা ছাড়া তৎকালীন পাকিস্তানে বাংলাভাষী মানুষ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। অতএব সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর ভিন্ন একটি ভাষা চাপিয়ে দেওয়া এ দেশে অগ্রসরমাণ তরুণ ছাত্রসমাজ মেনে নিতে পারেনি। বস্তুত বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতিদান তারা সমীচীন বলে মনে করে। তাই তারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলে। অতএব ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয় পাকিস্তান সৃষ্টির এক বছরের মধ্যেই। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। ক্রমান্বয়ে এই দাবি ব্যাপকতা লাভ করে। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এই সংগ্রামকে তীব্রতর করে এবং সে বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ভাষার দাবিতে মিছিল বের করে। মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়। বরকত, সালাম, জব্বারসহ অনেকেই শহীদ হন। এই ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই আমি মনে করি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের তথা বাংলা ভাষাভিত্তিক একটি জাতীয় রাষ্ট্রের বীজ বপন করা হয়।

পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের মূল লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে পঙ্গু করে দেওয়া। তাদের শাসনামলে অর্থনৈতিক শোষণের ফলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরাট অর্থনৈতিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে অর্থকরী ফসল ছিল পাট। পাট রপ্তানি করে হাজার কোটি টাকা আয় হতো। এ ছাড়া চা, চামড়া এবং অন্যান্য দ্রব্য রপ্তানি করে যে আয় হতো তার প্রায় সবটাই পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য খরচ করা হতো। পশ্চিম পাকিস্তানের মরু অঞ্চলে সেচের অভাবে কোনো ফসল হতো না। তাই আইয়ুব সরকার সেখানে বিশাল বিশাল (যেমন—মংলা, তারবেলা) বাঁধ নির্মাণ করে সেচের ব্যবস্থা করে এবং ওই সব অঞ্চলকে করে তোলে সুজলা-সুফলা। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ তৈরি করার তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ কখনো গ্রহণ করা হয়নি। শুষ্ক মৌসুমে সেচের কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। ফলে এককালের সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা পূর্ব বাংলার গোলা ভরা ধান আর গলা ভরা গান অনেকটা রূপকথায় পরিণত হয়। ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ার বাংলাদেশের প্রাচুর্য এবং মাঠের সোনালি ফসল দেখে একদা অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে প্রবেশ করার বহু রাস্তা খোলা আছে, কিন্তু এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই।’ এর অর্থ হলো, বাংলাদেশের প্রাচুর্য এবং সৌন্দর্যে যে কেউ এমনই আকৃষ্ট হবে যে এ দেশ থেকে সে আর যেতে চাইবে না। বাস্তবিক পক্ষে, এই ছিল একদা বাংলাদেশের ছবি। কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী শাসকগোষ্ঠীর শোষণ এবং অবহেলার কারণে বাংলার প্রাচুর্য ও সৌন্দর্য হারিয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসনের বৈষম্যমূলক নীতির কারণে বাংলাদেশের মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হতে থাকে।

এ ছাড়া রাজনৈতিক নির্যাতন ও নিষ্পেষণ ছিল সীমাহীন। পাকিস্তানি শাসকরা তাদের বাঙালি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালাতে থাকে। এর ফলে পূর্ব বাংলার মানুষ পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম পরিচালনা করে। দুর্বার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ভিত্তি শক্ত ও দৃঢ় হতে থাকে এবং একটি নতুন জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টির সম্ভাবনার দ্বার প্রসারিত হতে থাকে। এ ছাড়া বাঙালি সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে ভিন্ন সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা এ দেশের জনগণ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। যেকোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের সাফল্যের পেছনে থাকে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক আন্দোলনের সাফল্যের চাবিকাঠি ছিল এক দুর্বার সাংস্কৃতিক আন্দোলন।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে অবিভক্ত ভারতে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটেছিল, তারা ছিল মূলত হিন্দু সমাজকেন্দ্রিক। তারা ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। অনুরূপভাবে ভারত বিভক্তির পর নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে মূলত একটি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান ঘটে। পাকিস্তান রাষ্ট্রে অনগ্রসর মুসলিম জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ সৃষ্টি হয়। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই বিকাশমান নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদান করে। অতএব দেখা যায়, পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে এবং এই রাষ্ট্রের অনুসৃত পদ্ধতির মধ্যে এর ধ্বংসের বীজ নিহিত ছিল। অর্থাৎ যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের সীমিত সুযোগ রাষ্ট্র করে দিয়েছিল, তারপর তার আশা-আকাঙ্ক্ষার সব পথ বন্ধ করে দেওয়ায় এই শ্রেণির নিজের আত্মবিকাশের স্বার্থে নতুন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখে। এর ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাঙন এবং অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নতে সাধারণ নির্বাচন, ছাপ্পান্নতে স্বায়ত্তশাসনের দাবি, আটান্নতে আইয়ুবের সামরিক শাসন, বাষট্টিতে শিক্ষানীতি বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন ও স্বাধিকার আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ—এসবই বাঙালির সমন্বিত মুক্তিসংগ্রামের একেকটি উজ্জ্বল অধ্যায়, যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা। তারা ছিলেন উল্লেখিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিরই অংশ। তারা ছিলেন বাঙালি জাতির বিবেক। তাই তাদের দিতে হয়েছে চরম মূল্য।

বিরাট এই পথপরিক্রমায় আমরা হারিয়েছি অসংখ্য নিবেদিতপ্রাণ বীর বাঙালিকে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিজয়ের ঠিক প্রাক্কালে আমরা যা হারিয়েছি, যে ক্ষতচিহ্ন জাতির বুকে অঙ্কিত হয়েছে, সেটি মোছার নয়। দেশের সর্বোত্কৃষ্ট এই সন্তানদের হারিয়ে জাতি হয়ে পড়েছিল অভিভাবকশূন্য, মেধাহীন। দেশকে নেতৃত্বহীন করার মানসে দেশের সন্তান এই বুদ্ধিজীবীদের একেক করে ঘর থেকে বের করে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। লাশের পর লাশে ভরে গিয়েছিল ঢাকার রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমিগুলো।

নিজ নিজ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল বিভায় অধিষ্ঠিত এই নিবেদিতপ্রাণ মনীষীর একটিই ছিল অপরাধ, সেটি হলো দেশের প্রতি তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা আর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অবিচল আস্থা। তাদের কারো কারো ভূমিকা আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী মনে হলেও দেশমাতৃকার প্রতি অপরিসীম অনুরাগ তাদের সব কিছুর ঊর্ধ্বে তুলে মহিমান্বিত এক আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পুরো ৯ মাসই হানাদার বাহিনী বাঙালি নিধন চালিয়েছে। মাঠে-ময়দানের যুদ্ধে হানাদারের বুলেট উপেক্ষা করে তাদের পরাজিত করার চেষ্টায় বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছেন। কিন্তু মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মুমূর্ষু এই অকুতোভয় বাঙালি সূর্যসন্তানরা হানাদারদেরও মোকাবেলা করেছেন। হানাদার বাহিনী যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে বাংলার গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দর, লোকালয় সর্বত্র জনবসতিতে হামলা করে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, চালিয়েছে নির্বিচার হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ। তাই বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্ম যখন কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র, তখনই পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতিকে পঙ্গু করে ফেলার জন্য চালায় ইতিহাসের ঘৃণ্যতম বুদ্ধিজীবী নিধন। চূড়ান্ত পরাজয়ের পূর্বাহ্নে রক্তলোলুপ হায়েনার দল বাঙালির মেধাবী শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশার শ্রেষ্ঠ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে।

বিজয় এবং মৃত্যু—দুটি এমনভাবেই পরস্পর সংলগ্ন ছিল বলে ডিসেম্বর আজ আমাদের কাছে হাসি-কান্নার মিলিত প্রবাহ। ডিসেম্বর মাসে যেসব বুদ্ধিজীবী শহীদ হয়েছিলেন, ডিসেম্বর এলেই তাদের কথা মনে হবে, এমন নয়। তারা মিশে আছেন আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনে, আমাদের মননে, আমাদের নিত্য প্রেরণায়। তারা আমাদের জীবনে শুধু একেকজন ব্যক্তিমাত্র নন, তারা আমাদের ঐতিহ্যের, আমাদের অগ্রগতির পথনির্দেশক আলোকবর্তিকা। উজ্জ্বলতম অংশীদার।

৯ মাস যুদ্ধের পর লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অবেশেষে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর আমরা চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করি। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের আনন্দে একদিকে যেমন আত্মহারা হই, অন্যদিকে ১৪ ডিসেম্বর প্রিয় শহীদ বুদ্ধিজীবী ও বন্ধুদের মৃত্যুতে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি। তাদের এই আত্মদান বৃথা যায়নি, বৃথা যেতে পারে না। তারা তাদের জীবনের বিনিময়ে আমাদের উপহার দিয়েছেন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র।

১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করার পর অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই আশা করা হয়েছিল যে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে বিশ্বে সাম্য ও গণতন্ত্রের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। ইতিহাসের এক পরম দুর্ভাগ্য এই যে আমাদের সেই বহুলালিত স্বপ্ন থেকে যায় সুদূর পরাহত, কোনো এক অজ্ঞাত অন্ধকারে নিমজ্জিত। এই অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির অন্যতম প্রধান কারণ গণতন্ত্রহীনতা। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে গণতন্ত্র হচ্ছে উন্নয়ন ও অধিকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাহন, যার অনুপস্থিতি বা বিকৃতি একটি রাষ্ট্র বা সমাজের প্রকৃত বন্ধনমুক্তির সব পথ রুদ্ধ করে দেয়।

বাংলাদেশে গত দেড় দশকে প্রতি মুহূর্তে প্রত্যক্ষ করেছি ফ্যাসিবাদের বিলুপ্ত প্রেতাত্মার পুনরুত্থান। এক নিষ্ঠুর ও নিকৃষ্ট ফ্যাসিবাদের কবলে পড়ে আমাদের স্বদেশ; এর স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, জনগণের মৌলিক চাহিদা তথা সামগ্রিকভাবে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক সুস্থতা। গত দেড় দশকে এই ধারা গণতন্ত্রের কবর রচনা করে জনগণের সর্বপ্রকার অধিকার হরণ করেছে। অপহরণপ্রক্রিয়ার অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে নির্বাচন চুরি।

বিশ্বের মুক্তিপাগল মানুষের মতোই বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম, ছাত্রসমাজ ও জনগণ স্বৈরাচারের শাসন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলে। সব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি, বুদ্ধিজীবী ও শ্রমিক সংগঠন, ছাত্র ও যুব সম্প্রদায়ের সঙ্গে দেশের সুধীসমাজ একযোগে এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহজুড়ে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব ও অভূতশ্রুত আন্দোলনে হাসিনার স্বৈরতন্ত্রের ঐতিহাসিক পতন ঘটে। এ জন্য ছাত্র-জনতাকে জানাই প্রাণঢালা অভিনন্দন। গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে বৈষম্যহীন এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার এই পথযাত্রা সফল হোক—এই কামনা করি।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক

উপাচার্য এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত