কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

আমরা কি বৈশ্বিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে

জ্যাষ্টিন গোমেজ [সূত্র : জনকণ্ঠ, ২২ জুন ২০২৫]

আমরা কি বৈশ্বিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে

ইতিহাসে কিছু মুহূর্ত আসে, যখন পুরো পৃথিবী প্রায় দম বন্ধ করে থেমে থাকে। তখন আমাদের জীবন-যাপনে স্বাভাবিক ছন্দের পতন ঘটে আর কানে ভেসে আসে ক্ষেপণাস্ত্রের গর্জন, বিশ্ব কূটনীতির নীরবতা, আর ধ্বংসের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া অসহায় মানুষের কান্না। ২০২৫ সালের জুন মাস, হয়তো এমনই এক ভয়ানক মুহূর্ত হয়ে থাকবে। ইরানের তেহরানের জ্বলন্ত আকাশ এবং গাজার মৃতদেহ-ভর্তি রাস্তা, রাশিয়ার কিয়েভের নিঃশব্দ শোক থেকে জাতিসংঘের বিভক্ত সভাকক্ষে পৃথিবী আজ এক ভয়ংকর বিভক্তির প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।

 


ইসরায়েলের নজিরবিহীন হামলা এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা তৈরি করেছে। আকাশ ভরে উঠেছে শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রে। পারমাণবিক স্থাপনাগুলো, যা একসময় যুদ্ধের বাইরে ছিল, আজ সেগুলোকেই লক্ষ্য করা হচ্ছে। আর এদিকে, গাজা নীরবে রক্তাক্ত হচ্ছে অনাহার, ধ্বংস আর নিঃসঙ্গতায়। একই সময়ে, ইউক্রেনে চলছে অবিরাম যুদ্ধ। বিশ্বের কূটনীতি স্তব্ধ, আন্তর্জাতিক আইন উপেক্ষিত, নেতৃত্ব বিভক্ত। এই ভয়ের মধ্যে, বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা আর কল্পনা নয়, যেন এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার দিনক্ষণ গণনা। কেননা যুদ্ধ, পারমাণবিক হুমকি, প্রক্সি সংঘর্ষ এবং কূটনৈতিক ব্যর্থতার এক জটিল জালে মানবজাতি প্রবেশ করছে ইতিহাসের এক বিপজ্জনক অধ্যায়ে। তেহরান থেকে গাজা, কিয়েভ থেকে জাতিসংঘের সদর দপ্তর, সবখানেই এক প্রশ্ন যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে- আমরা কি বৈশ্বিক বিপর্যয়ের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি?

 

 

একটি হামলা কাঁপিয়ে দিয়েছে বিশ্বকে



১৩ জুন, ইসরায়েল একটি বড়সড় সামরিক অভিযান চালায় ইরানের ভেতরে। হামলায় টার্গেট করা হয় গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো, উচ্চপর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের। একটি পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র ছিল অন্যতম লক্ষ্য। এই হামলা ইরান-ইসরায়েল সম্পর্কে এক নতুন উত্তেজনার সূচনা করে। জবাবে, ইরান ইসরাইলে শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে দেয়। যার ফলে ঠান্ডা সংঘর্ষ সরাসরি যুদ্ধের রূপ নেয়। এই যুদ্ধ এখন আর শুধু দুই দেশের সীমাবদ্ধ নয়।

 

 

হিজবুল্লাহ প্রসঙ্গ ও যুক্তরাষ্ট্রের হুঁশিয়ারি

যুদ্ধের উত্তাপ বাড়ার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত থমাস ব্যারাক বৈরুত পৌঁছান। লক্ষ্য ছিল ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে এই যুদ্ধে জড়ানো থেকে বিরত রাখা। ব্যারাক স্পষ্ট বলেন, এটা হবে খুবই খারাপ সিদ্ধান্ত। হিজবুল্লাহ যুদ্ধে জড়ালে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়তে পারে লেবানন, সিরিয়া ও ইরাক জুড়ে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, যদি সংঘর্ষ আরও বাড়ে, তাহলে কেবল মধ্যপ্রাচ্য নয়, পুরো বিশ্ব বিপদে পড়তে পারে।

 

 


জাতিসংঘের তীব্র নিন্দা ও উদ্বেগ

 

অনেকেই আশঙ্কা করছেন, যদি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির সরকার এই যুদ্ধে পর্যুদস্ত হয়, তবে সেখানে গণতন্ত্র নয় বরং গৃহযুদ্ধ শুরু হবে। আরও বড় ভয় হলো পারমাণবিক দুর্ঘটনার। পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর হামলা কেবল যুদ্ধ নয়, এটি মানবজাতির ভবিষ্যতের সঙ্গে এক ভয়ংকর খেলা। ২০ জুন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে চীন, পাকিস্তান, রাশিয়া ও আলজেরিয়ার আহ্বানে এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে স্পষ্ট করে বলা হয়, ইসরায়েলের এই হামলা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন এবং বিশ্বশান্তিকে হুমকির মুখে ফেলেছে। রাশিয়ার প্রতিনিধি ভাসিলি নেবেনজিয়া বলেন, ‘ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলো বারবার টার্গেট হচ্ছে। এটি পুরো মানবজাতিকে এক ভয়ংকর বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে।’ চীনের প্রতিনিধি ফু কং বলেন, ‘এই হামলা আন্তর্জাতিক আইন ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে।’ পাকিস্তান ও আলজেরিয়াও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং গাজার মানবিক সংকটের কথাও উল্লেখ করে। এমনকি যুক্তরাজ্যও কূটনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানায়। ব্রিটিশ প্রতিনিধি বারবারা উডওয়ার্ড বলেন, ‘সামরিক পদক্ষেপে ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম বন্ধ হবে না, এই সংকটের সমাধান কেবল কূটনীতির মাধ্যমেই সম্ভব।’

 

 

গাজায় মানবিক বিপর্যয়

 

যখন ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ নিয়ে বিশ্ব দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, তখন গাজায় চলমান ধ্বংসযজ্ঞ যেন আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক বার্তা-সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে গত ২৪ ঘণ্টায় গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছে কমপক্ষে ১৪০ জন। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে হামাসের আক্রমণের পর থেকে ইসরায়েলি অভিযানে গাজায় এখন পর্যন্ত ৫৫,৬০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। প্রায় পুরো জনগোষ্ঠী বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং ভয়াবহ খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডঋচ) জানিয়েছে, গত এক মাসে তারা গাজায় যে পরিমাণ খাদ্য সহায়তা পাঠিয়েছে, তা প্রয়োজনের সামান্য অংশ মাত্র। অনেক ফিলিস্তিনি এখন মনে করছেন, তাদের দুর্ভোগ যেন পুরোপুরি ভুলে গেছে বিশ্ব।

 


ইউক্রেনে আরেকটি যুদ্ধ

 

 

এদিকে ইউরোপের আরেক প্রান্তে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও থামার কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে না। ১৮ জুন, রাশিয়া কিয়েভে চালায় বছরের সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা, যাতে প্রাণ হারান ২০ জনের বেশি। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেন, এই হামলায় ৪৪০টি ড্রোন ও ৩২টি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। রাশিয়া জানিয়ে দিয়েছে, তাদের শর্ত পূরণ না হলে হামলা থামবে না। অন্যদিকে ইউক্রেন বলছে, রাশিয়ার এই শর্তগুলো ‘একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।’

 


যদি আজকের বিশ্বের পরিস্থিতির দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে, প্রতিটি সংকট আরও একটি সংকটের জন্ম দিচ্ছে। প্রতিটি নীরবতা আরও একটি সহিংসতাকে উস্কে দিচ্ছে। প্রতিটি বিলম্ব আমাদের একধাপ এগিয়ে দিচ্ছে আরও ধ্বংসের দিকে। আর এগুলো হচ্ছে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ, পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর হামলা, গাজায় মানবিক বিপর্যয় ও গণহত্যা, ইউক্রেনে যুদ্ধ আর জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অকার্যকর নীরবতার জন্য।

 

 

সময় ফুরিয়ে আসছে

 

দশক ধরে আমরা বিশ্বাস করেছি, কূটনীতি, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বযুদ্ধ ঠেকাতে পারে। কিন্তু আজ সেই নিরাপত্তা বেষ্টনী একের পর এক ভেঙে পড়ছে। যদি কূটনীতির পরিবর্তে সামরিক শক্তিই হয়ে ওঠে সমাধান, যদি আইনের বদলে চলে আধিপত্যের রাজনীতি, যদি আশার জায়গা দখল করে নেয় ভয়, তাহলে বিশ্বব্যাপী বিপর্যয় হবেই হবে। এই পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য আমাদের একসঙ্গে, এখনই কাজ শুরু করতে হবে। না হলে, আমরা হয়তো শান্তির মৃত্যু-ঘণ্টা শুনেও কিছু করতে পারব না। কেননা পৃথিবীর আকাশ আজ ভারী হয়ে আছে ধোঁয়া, ধ্বংস আর নীরবতায়। প্রতিদিন নারী ও শিশু মারা যাচ্ছে, পরিবার বিধ্বস্ত হচ্ছে, শহর কাঁপছে অনিশ্চয়তায়। আর আমরা তাকিয়ে আছি, কিছুটা অসহায়, কিছুটা উদাসীন, আর কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে।

 


আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ইতিহাস কিন্তু কখনো চুপ থাকে না। আজ যে আগুন আমরা দূর থেকে দেখছি, কাল সে আমাদের দরজায় কড়া নাড়বে। এখন প্রশ্ন একটাই- আমরা কি দাঁড়িয়ে থাকব নীরব দর্শক হয়ে, নাকি কণ্ঠ তুলব শান্তির পক্ষে, মানবতার পক্ষে? এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আমাদের কণ্ঠ, বিবেক এবং সাহস। যদি এখনো ঘুমিয়ে থাকি, তবে হয়তো সেই ঘুম আর জেগে ওঠার মতো থাকবে না। যদি এখনই না বলি ‘এই যুদ্ধ আমরা চাই না’, তবে একদিন হয়তো কেউই বাকি থাকবে না এই কথা বলার জন্য। এখনই সময়, শান্তির পাশে দাঁড়ানোর। এখনই সময় মানবতার ডাক শোনার। এখনই সময়, পৃথিবীকে বাঁচানোর। পৃথিবীর ভাগ্য এখন আর কেবল রাষ্ট্রনেতাদের হাতে নয়, এটা আমাদের সবার হাতেই। তাই চলুন, আমরা একসঙ্গে বলি, যুদ্ধ নয়, আমরা শান্তি চাই।

 

লেখক : সাংবাদিক