কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা ঘিরে নতুন সংকট

[সূত্র : বণিক বার্তা অনলাইন, ১১ জুন ২০২৫]

আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা ঘিরে নতুন সংকট

বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ সমুদ্র যা কোনো দেশের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়, সেই এলাকাগুলোর টেকসই ব্যবহার ও সংরক্ষণের জন্য হাই সি-স চুক্তিটি অতি জরুরি। এর আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক জলসীমার ৩০ শতাংশ এলাকাকে সংরক্ষিত ঘোষণা করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

 

 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক নির্বাহী আদেশ আন্তর্জাতিক সমুদ্রজুড়ে নতুন এক উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। গত এপ্রিলের শেষ দিকে নির্দেশে স্বাক্ষর করে আন্তর্জাতিক জলসীমায় গভীর সমুদ্রের তলায় খনিজ আহরণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে লাইসেন্স দেয়ার অধিকার দাবি করেন ট্রাম্প। ফ্রান্সের নিস শহরে চলমান সমুদ্র সম্মেলনে ট্রাম্পের সেই সিদ্ধান্তের সমালোচনায় মুখর হয়েছে চীনসহ একাধিক দেশ ও পরিবেশবাদী গোষ্ঠী। তাদের ভাষ্য, যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইনকে পাশ কাটিয়ে সামুদ্রিক পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে। খবর এফটি।

 

 


আন্তর্জাতিক সমুদ্র তল ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের (আইএসএ) মহাসচিব লেটিসিয়া রেইস দে কারভালহো এই পদক্ষেপকে ‘বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত’ আখ্যা দিয়ে বলেন, এটি সমুদ্র পরিচালনার বৈশ্বিক কাঠামোকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। এমন উত্তেজনার মধ্যেই শুরু হয়েছে জাতিসংঘের মহাসাগর বিষয়ক সম্মেলন, যেখানে প্রায় ২০০টি দেশের প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন।

 

 


সমুদ্র সম্মেলন (1)

 


তবে ট্রাম্পের এই হস্তক্ষেপের অনেক আগেই সমুদ্র সংরক্ষণের পথে অগ্রগতি ছিল হতাশাজনক। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলোতে সমুদ্রের টেকসই ব্যবহার ও সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বাস্তবতায় দেশগুলো একমত হতে পারেনি। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ ও অতিরিক্ত মাছ ধরা সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রকে ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

 

 

ফ্রান্স ও কোস্টারিকার যৌথ আয়োজনে নিস শহরের এই সম্মেলনের মূল লক্ষ্য ২০২৩ সালে গৃহীত ‘উচ্চ সমুদ্র চুক্তি’কে কার্যকর করা। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ সমুদ্র যা কোনো দেশের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়, সেই এলাকাগুলোতে টেকসই ব্যবহার ও সংরক্ষণের জন্য এই চুক্তিটি একটি আইনি কাঠামো প্রদান করে। এর আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক জলসীমার ৩০ শতাংশ এলাকাকে সংরক্ষিত ঘোষণা করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

 

 

কিন্তু এখনো পর্যাপ্ত সংখ্যক দেশ এই চুক্তিতে অনুমোদন না দেওয়ায় তা কার্যকর হয়নি। অনেক দেশই সমুদ্র সংরক্ষণের গুরুত্ব বোঝা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করছে। এদিকে বিজ্ঞানীরা বারবার সতর্ক করে বলছেন, সমুদ্রের উষ্ণতা রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে, অ্যাসিডিফিকেশন বা অম্লতা বাড়ছে, প্রতি বছর প্রায় ২ কোটি টন প্লাস্টিক পানিতে প্রবেশ করছে।

 

 

মৎস্যসম্পদ নিয়েও সংকট গভীরতর হচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মাছের প্রজাতি অতিমাত্রায় আহরণ করা হচ্ছে। এই সমস্যা মোকাবিলায় ২০২২ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা একটি প্রাথমিক চুক্তিতে পৌঁছালেও অধিকাংশ দেশ এখনো তা অনুমোদন করেনি।

 

 

সমুদ্র সংরক্ষণে অর্থায়নও অত্যন্ত সীমিত। গবেষণা বলছে, প্রতিবছর পরিবেশ খাতে যে অর্থ ব্যয় হয়, তার সামান্য অংশ সমুদ্রভিত্তিক প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ থাকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইন্দোনেশিয়া ও বারবাডোসের মতো দেশ ও ডেনিশ কোম্পানি ওরস্টেড ‘নীল বন্ড’ ইস্যু করেছে, যার মাধ্যমে এই খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। বিশ্বব্যাংকও ইতিমধ্যে শতাধিক দেশে প্রকল্পে ১৮ কোটির বেশি ডলার বরাদ্দ দিয়েছে।

 

 

এই প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস নিস সম্মেলনে এক বার্তায় হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ‘সমুদ্র কোনো ওয়াইল্ড ওয়েস্ট বা আইনের উর্দ্ধ এলাকা হতে পারে না।’ তাঁর ভাষায়, ‘আমরা যেন ভুলে না যাই—সমুদ্র কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। এটি মানবজাতির যৌথ উত্তরাধিকার, এর ব্যবস্থাপনাও হতে হবে সমন্বিত ও বহুপাক্ষিক কাঠামোর মাধ্যমে।’

 

 

গুতেরেসের এই বক্তব্য মূলত গভীর সমুদ্র খনিজ আহরণের বিষয়ে যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, তাকে রুখতেই দেওয়া। তিনি বলেন, ‘জলসীমায় একতরফা সিদ্ধান্ত ও জাতীয় স্বার্থে চালিত উদ্যোগ আমাদের সবাইকে বিপদে ফেলবে।’

 

 

এই বার্তার প্রতিধ্বনি মেলে জাতিসংঘের সমুদ্রবিষয়ক বিশেষ দূত পিটার থমসনের বক্তব্যেও। তিনি বলেন, ‘আমাদের সমুদ্র ব্যবস্থাপনা ঠিক ততটাই আন্তঃসম্পর্কযুক্ত হওয়া উচিত, যতটা সমুদ্র নিজে।’

 

 

বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি বৈশ্বিক সমুদ্র শাসনব্যবস্থা আরো বিলম্বিত ও দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে ভবিষ্যতে এই বিপুল জলরাশি শুধুই পরিণত হবে ‘জেলিফিশ আর ব্যাকটেরিয়ার রাজত্বে।’