কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ইতি-নেতি

দিলীপ কুমার সরকার । সূত্র : সময়ের আলো, ২৫ মার্চ ২০২৫

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ইতি-নেতি

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর সবচেয়ে আলোচিত একটি রাজনৈতিক সংস্কার প্রস্তাব ছিল আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় বিষয়টি শেষ পর্যন্ত চাপাই পড়ে গেল। অনেক আগে থেকেই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তনের দাবি করে আসছিল বাংলাদেশের বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় জাতীয় পার্টি। ড. আকবর আলি খান রচিত ‘অবাক বাংলাদেশ : বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ গ্রন্থেও এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

 



বিশিষ্ট সাংবাদিক মাহবুব কামাল বিষয়টি নিয়ে দৈনিক যুগান্তরে নিবন্ধ লিখেছিলেন ২০২৩ সালের আগস্টে। এ নিয়ে আমার একটি নিবন্ধ দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত হয়েছিল ২৯ এপ্রিল ২০২৪-এ। তবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ব্যতীত প্রায় সব রাজনৈতিক দলই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতির পক্ষে বলে জানা গেছে। বিষয়টি নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে বিস্তর। সাম্প্রতিককালে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত যাদের নিবন্ধ বা সাক্ষাৎকার আমার চোখে পড়েছে, তারা হলেন—সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল, এশীয় প্রবৃদ্ধি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, সাংবাদিক ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব জেনারেল এডুকেশনের সহকারী অধ্যাপক ড. সৌমিত জয়দ্বীপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাসবিষয়ক গবেষক আলতাফ পারভেজ, শিক্ষক, লেখক ও গবেষক হেলাল মহিউদ্দীন, সাংবাদিক ও লেখক কামরান রেজা চৌধুরী, সাংবাদিক রিয়াদুল করিম, প্যারিস সায়েন্স অ্যান্ড লেটারস ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক ইশতিয়াক আকিব প্রমুখ। ধারণা করছি আরও অনেকেই এ নিয়ে লেখালেখি করেছেন। উপরিল্লিখিতদের লেখা ও আলোচনা থেকে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হলো।

 



আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, যে দল শতকরা যত ভাগ ভোট পায়, শতকরা তত ভাগ আসনও পায় সেই দল। বিশ্বের শতাধিক দেশে এই পদ্ধতি চালু রয়েছে। কোনো কোনো দেশে ফার্স্ট-পাস-দ্য-পোস্ট (এফপিটিপি) এবং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন পদ্ধতির সমন্বয়ে মিশ্র পদ্ধতির নির্বাচন ব্যবস্থায় চালু রয়েছে।

 



আনুপাতিক নির্বাচনের পদ্ধতিসমূহ
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব সাধারণত তিন ধরনের—দলীয় তালিকা, মিশ্র পদ্ধতি ও একক হস্তান্তরযোগ্য ভোট পদ্ধতি। দলীয় তালিকা দুই ধরনের—বদ্ধ তালিকা ও উন্মুক্ত দলীয় তালিকা। বদ্ধ তালিকার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনের আগেই তালিকা তৈরি করে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করতে হয়। নির্বাচনের পর যে দল ভোট প্রাপ্তির হিসেবে যতজন সদস্য পায়, তা তালিকার ক্রমানুসারে বণ্টন করা হয়। উন্মুক্ত দলীয় তালিকার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল আগে থেকেই প্রার্থী তালিকা প্রস্তুত করলেও র‌্যাংকিং করে না। ভোটের পর যে দল যতটি আসন পায়, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তা তালিকাভুক্তদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। মিশ্র পদ্ধতি ফার্স্ট-পাস-দ্য-পোস্ট ও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সংমিশ্রণ। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই নির্ধারিত হয় কতটি আসনে ফার্স্ট-পাস-দ্য-পোস্ট পদ্ধতিতে এবং কতটিতে আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে। ফার্স্ট-পাস-দ্য-পোস্ট পদ্ধতির আসনগুলোতে আমাদের দেশের প্রচলিত নির্বাচনের মতো আসনভিত্তিকভাবে যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পাবেন তিনিই বিজয়ী হবেন। অন্য সদস্যরা নির্বাচিত হবেন দলের ভোটপ্রাপ্তির অনুপাতে পূর্বনির্ধারিত তালিকা থেকে। একক হস্তান্তরযোগ্য (সিঙ্গেল ট্রান্সফারেবল) ভোট পদ্ধতিতে প্রথমে ভোটার ভোট দেওয়ার সময় পছন্দের দল বাছাই করেন এবং একই সময় পছন্দের দলের প্রার্থীদের ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভোট দেন। কোনো কোনো রাষ্ট্রে কেন্দ্রীয়ভাবে আসন বণ্টনের পাশাপাশি অঞ্চলভিত্তিকভাবেও (প্রদেশ ও জেলা) আনুপাতিক পদ্ধতির প্রয়োগ করা হয়ে থাকে, যেমন শ্রীলঙ্কা।

 



কোন পদ্ধতি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে উপযোগী
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য সর্বাপেক্ষা উপযোগী পদ্ধতি হলো প্রার্থী তালিকা পদ্ধতি। আর প্রার্থী তালিকা পদ্ধতির ক্ষেত্রে আমাদের জন্য সবচেয়ে উপযোগী পদ্ধতি বদ্ধ তালিকা পদ্ধতি। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অন্যান্য পদ্ধতি কিছুটা জটিলতাপূর্ণ।

 



আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ইতিবাচক দিকসমূহ
বদ্ধ তালিকা পদ্ধতিকে বিবেচনায় নিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনের অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে। প্রথমত এই পদ্ধতির নির্বাচনে প্রকৃত অর্থেই গণরায় প্রতিফলিত হয়। এখানে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠের (৫০ শতাংশের অধিক) ভোট পায় তারাই সরকার গঠন করে। দ্বিতীয়ত আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে একদলীয় স্বৈরতন্ত্রের উদ্ভবের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। তৃতীয়ত দলভিত্তিক জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় বলে নির্বাচনি প্রচারণায় ব্যক্তির বদলে দলীয় নীতি-আদর্শ ও নির্বাচনি ইশতেহার বেশি গুরুত্ব পায়। সঙ্গত কারণেই প্রতিটি দলকে দলীয় নীতি-আদর্শ ও কর্মসূচির বিষয়ে গুরুত্বারোপ করতে হয়। ফলে ক্রমেই আদর্শভিত্তিক জনকল্যাণমুখী সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। চতুর্থত কোনো প্রার্থীর জন্য নির্দিষ্ট নির্বাচনি এলাকা না থাকায় এলাকাভিত্তিকভাবে মরিয়া হয়ে জয়ের প্রচেষ্টা যেমন হ্রাস পায়, তেমনি নির্বাচনি প্রচারণায় আচরণবিধি ভঙ্গ, সহিংসতা ও টাকার খেলার সম্ভাবনাও হ্রাস পায়। ফলে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। 

 



পঞ্চমত কোনো সংসদ সদস্যের জন্য নির্দিষ্ট নির্বাচনি এলাকা না থাকায় স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সংসদ সদস্যদের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা হ্রাস পায় এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় সংসদ সদস্যরা দেশের আইন প্রণয়ন ও নীতিনির্ধারণসহ মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে মনোনিবেশ করতে পারে। ফলে ক্ষমতা পৃথকীকরণ নীতির বাস্তবায়ন সহজ হয়। ষষ্ঠত সংসদে দ্বিদলীয় প্রতিনিধিত্বের পরিবর্তে বহুদলীয় প্রতিনিধিত্বের পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের মূল নেতৃত্ব সংসদে আসার সুযোগ পান। গুণগত দিক থেকে সংসদের মান ও কার্যকারিতা বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি কোনো দল চাইলেই যখন-তখন সংবিধান সংশোধন করতে পারে না। ফলে সরকারপ্রধান বা কোনো দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের স্বৈরতন্ত্রী হয়ে ওঠার সুযোগ হ্রাস পায়। সপ্তমত এই পদ্ধতির প্রবর্তন হলে ‘ভোট পচে যাওয়া’র হওয়ার ধারণা থেকে ‘মন্দের ভালো’কে ভোট প্রদানের প্রবণতা থেকে ভোটাররা বেরিয়ে আসতে পারে এবং আদর্শভিত্তিক ছোট দলগুলোর ভোটপ্রাপ্তির শতকরা হার বৃদ্ধির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আদর্শভিত্তিক জনকল্যাণমুখী রাজনৈতিক শক্তির বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। অষ্টমত সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল উপস্থিতির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।

 

 

ধারণা করা হয় যে, আমাদের দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলের কারোরই জনসমর্থনে আকাশ-পাতাল ফারাক নেই। ফলে রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি হতে পারে। নবমত প্রতিটি রাজনৈতিক দল থেকে বাধ্যতামূলকভাবে কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ নারীকে মনোনয়ন প্রদানের বিধান করা হলে এবং সাধারণ ও নারী প্রার্থীদের পৃথক তালিকা করে, এই দুটি তালিকা থেকে ক্রমানুসারে আসন বণ্টন করার আইনি বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হলে নারীদের জন্য পৃথকভাবে আসন সংরক্ষণের কোনো প্রয়োজন হবে না। এলাকাভিত্তিক আসন না থাকায় দায়িত্ব পালনে এলাকাভিত্তিক দ্বৈততারও অবসান ঘটবে। দশমত কোয়ালিশন সরকার গড়ার সম্ভাবনা থাকায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয় ও সমঝোতার পরিবেশ গড়ে উঠতে পারে। ফলে আমাদের দেশে বিরাজমান পারস্পরিক বিরোধিতার রাজনীতির পরিবর্তে, পারস্পরিক সহযোগিতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠার সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হতে পারে।

 



আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনের সম্ভাব্য নেতিবাচক দিকসমূহ
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনের ইতিবাচক দিকের পাশাপাশি সম্ভাব্য নেতিবাচক কিছু দিক নিয়েও আলোচনা রয়েছে। প্রথমত কোয়ালিশন সরকার গঠনের সম্ভাবনা অধিক থাকায় সরকারের স্থায়িত্বের ঝুঁকি থাকে। ভিন্ন আদর্শের কোনো দল বা জোটের সঙ্গে এই কোয়ালিশন হলে বা ভিন্ন আদর্শের কোনো দল বা জোটের সমর্থন নিয়ে কেউ সরকার গঠন করলে এই ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ত কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলে তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা সহজ হয় না। এ ক্ষেত্রে ভিন্ন আদর্শের দলগুলোর মধ্যে একে অন্যের ওপর দায় চাপানোর প্রবণতাও দেখা দিতে পারে। তৃতীয়ত দলে গণতন্ত্রের চর্চা এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রার্থী মনোনয়নের বিধান না থাকলে দলীয় নেতৃত্বের স্বেচ্ছাচারিতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে। চতুর্থত আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচন করার সুযোগ থাকে না। কোনো কোনো নিবন্ধকার তাদের নিবন্ধে এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন হলে পতিত স্বৈরাচারের রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তনের পথ সুগম হবে। কেউ কেউ ধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তির উত্থানেরও ইঙ্গিত করেছেন।

 



আনুপাতিক পদ্ধতিকে কীভাবে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যায়
আগেই আলোচনা করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের জন্য আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা উপযোগী পদ্ধতি হলো বদ্ধ তালিকা পদ্ধতি। গণতান্ত্রিক চেতনাকে সমুন্নত রেখে এই পদ্ধতি কার্যকর করতে হলে কয়েকটি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। প্রথমত প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রতিটি দলকে বিশেষ সম্মেলন করে ক্রমানুসারে (র‌্যাংকিং) গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গোপন ব্যালটে প্রার্থী তালিকা নির্ধারণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত প্রতিটি রাজনৈতিক দল থেকে বাধ্যতামূলকভাবে কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ নারীকে মনোনয়ন প্রদানের বিধান করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ প্রার্থী ও নারী প্রার্থীদের পৃথক তালিকা করতে হবে এবং প্রতিটি দলের প্রাপ্ত মোট আসনগুলোতে সাধারণ তালিকা থেকে দুজনের বিপরীতে একজন নারীকে নারী তালিকা থেকে ক্রমানুযায়ী বেছে নিতে হবে। কোনো দল যদি মাত্র দুটি আসন পায় অথবা আসন বণ্টনকালে যদি শেষ ভগ্নাংশ হয় দুই, তবে তার একজন হবেন নারী।

 



আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বিশ্লেষণ করলে ইতিবাচক দিকের পাল্লাই ভারী বলে মনে হয়। প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থায় বড় দলগুলো অন্যায্যভাবে লাভবান হয়। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে আসন বণ্টন হয় ন্যায্যতার ভিত্তিতে। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত গণরায় প্রতিফলিত হয়। যেসব দলের জনসমর্থন বেশি তারা বেশি আসন পায় এবং যেসব দলের জনসমর্থন নগণ্য তারা স্বল্প সংখ্যক আসন পায়। প্রকৃত গণতান্ত্রিক চেতনা সমুন্নত থাকে এ পদ্ধতিতেই। তাই তুলনামূলক বিচারে আমাদের দেশের মতো বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বকেই নিঃসন্দেহে শ্রেয় বলে মনে হয়।

 



যারা আগে থেকেই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে পতিত স্বৈরাচারের ভূত দেখছেন বা ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর উত্থানের আশঙ্কা করছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আপনি যদি প্রকৃত পক্ষেই গণতন্ত্রের পূজারী বা অনুসারী হন, তবে এ ঝুঁকি আপনাকে নিতেই হবে। কেননা গণতন্ত্র হলো জনগণের সম্মতির শাসন। গণরায়ে আপনার পছন্দের দল যেমন নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পারে, তেমনি হেরেও যেতে পারে। আর যে দেশের রাজনীতিতে অবাধে ধর্মের ব্যবহারকে স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয় এবং কথায় কথায় ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত করা হয়, সে দেশে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর উত্থানও স্বাভাবিক বিষয়। কৌশলের কূটচালে অন্ধত্বকে ঠেকানো যাবে না। গাছের আগা কাটার চিন্তা করে লাভ নেই, গোড়ায় পানি দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

 



আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি আমাদের দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক মোড় পরিবর্তনকারী অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। পাশাপাশি তা বাংলাদেশে গণতন্ত্রায়ন, সুষ্ঠু নির্বাচন, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব এবং সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুতে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত বিরাজমান নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন তথা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তনের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে ভাবা। তবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হলে যেহেতু সংবিধান সংশোধন করতে হবে, তাই ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন এই পদ্ধতিতে আয়োজন সম্ভব হবে না। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন আয়োজন এই মুহূর্তে সম্ভব না হলে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের আগেই রাজনৈতিক দলগুলোকে এমনভাবে সমঝোতায় আসতে হবে, যাতে নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার সংসদে আসন পাওয়া অন্যান্য দলগুলোর সমর্থন নিয়ে সংবিধান সংশোধনের মধ্য দিয়ে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তন করতে পারে। উল্লেখ্য, সম্প্রতি সংবিধান সংস্কার কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তাদের সুপারিশ সংবলিত যে প্রতিবেদন পেশ করেছে, তাতে নিম্নকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাব করা না হলেও উচ্চকক্ষের ক্ষেত্রে কর হয়েছে। নিম্ন কক্ষেও একই পদ্ধতি প্রবর্তন করা উচিত।

 

লেখক: প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক