কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

আরেক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে মধ্যপ্রাচ্য

সাখাওয়াত হোসেন সুজন । সূত্র : দেশ রূপান্তর, ০১ মার্চ ২০২৫

আরেক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে মধ্যপ্রাচ্য

এখনো গাজাবাসীর হাহাকার থামেনি। নিজ বাসভূমে তারা পরবাসী। ধ্বংসস্তূপে পরিণত গাজার কোনো শিশুর নিষ্পাপ ছবির দিকে তাকালে নিতান্ত পাষাণ না হলে যে কারও চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরবে। গৃহহারা মানুষের আর্তনাদ তাদের হাহাকার-চিৎকার ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের সব বিবেকবান মানুষের হৃদয়কে নাড়া দেয়। কিন্তু কথিত মানবতার ফেরিওয়ালাদের সেদিকে নজর নেই। ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ড তাদের এত প্রয়োজন যে, তারা যে কোনো উপায়ে দখল করতে মরিয়া।

 

 

আবার ইসরায়েল এখন হাত বাড়িয়েছে সিরিয়ার দিকে। দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসানের পর দেশটি যখন স্থিতিশীলতার পথে যাত্রা শুরুর অভিপ্রায়ে পুনর্গঠনমূলক কার্যক্রমের পথে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে, ঠিক সেই সময়ে ঠুনকো অজুহাতে কয়েকদিন আগে দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এর ফলে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। এরই মধ্যে সিরিয়া সীমান্তে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবস্থান নিয়েছে ইসরায়েলি সেনারা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল ক্যাটজ বলেছেন, সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট আহমাদ আশ-শারার ওপর আমাদের আস্থা নেই। আমরা শুধু আমাদের বাহিনীর ওপরই বিশ্বাস করি।

 

 

যদিও এ ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ জানাচ্ছে খোদ জাতিসংঘ। তারপরও এ কথা সহজেই অনুমেয়, কাগুজে বাঘের তর্জন-গর্জনে অতীতেও খুব একটা লাভ হয়নি, ভবিষ্যৎও অনির্ধারিত। এ কথা বলতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। সহজেই বলা যায় নতুন করে আরেকটি যুদ্ধে হতে যাচ্ছে। ইসরায়েলি সেনারা সিরিয়ার যত গভীরে প্রবেশ করছে দামেস্ক ও তেল আবিবের মধ্যে উত্তেজনা ততই বাড়ছে। এদিকে সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট আহমাদ আশ-শারা নিজ দেশে ইসরায়েলি সেনাদের প্রবেশের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। অবিলম্বে ইসরায়েলি সেনাদের প্রত্যাহারে দাবি জানিয়ে বলেছেন, এজন্য তাদেও চড়া মাশুল দিতে হবে। গত মঙ্গলবার জাতীয় সংলাপ সম্মেলন আয়োজনের পরপরই সিরিয়া এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে।

 

 

 

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, সিরিয়াকে দুই ভাগ করার অভিপ্রায় রয়েছে ইসরায়েলের। গত ডিসেম্বরে আল-শারার নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল শাম-এইচটিএস সিরিয়ার দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসক বাসার আল আসাদকে উৎখাতের পরপরই নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে দেশটির সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায় অনুপ্রবেশ করতে শুরু করে ইসরায়েলি সেনারা। বর্তমানে জাতিসংঘের নজরদারিতে থাকা সিরিয়ার গোলান হাইটস অঞ্চলের বাফার জোনের একাংশ দখলে রেখেছে তারা। বলা হচ্ছে, সিরিয়ার সংখ্যালঘু দ্রুজ জনগোষ্ঠীর সহায়তায় দেশটিকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র করছে ইসরায়েল। তবে এ ধরনের ষড়যন্ত্র কখনোই সফল হতে দেওয়া হবে না বলে ইসরায়েলকে সতর্ক করেছে রাশিয়াও।

 

 

 

সম্প্রতি ইরান সফরকালে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, সিরিয়াকে ভাঙার যে কোনো রকম পরিকল্পনা অগ্রহণযোগ্য ও বিপজ্জনক। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা দক্ষিণ সিরিয়ার সেসব সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে আঘাত করেছে যেগুলো কমান্ড সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং যেগুলোতে ভারী অস্ত্রশস্ত্র রাখা আছে। যদিও তারা জায়গাগুলোর সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানায়নি। দামেস্কের স্থানীয়রা জানিয়েছেন, তারা রাজধানীর আকাশে খুব কাছ থেকে বিমান ওড়ার আওয়াজ পেয়েছেন। সেই সঙ্গে একাধারে বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন। মুহুর্মুহু বোমাবর্ষণের শব্দে তারা রীতিমতো আতঙ্কে আছেন।

 

 

 সিরিয়া যখনই দেশটির দক্ষিণে ইসরায়েলি বাহিনীর অনুপ্রবেশের নিন্দা এবং তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বোমাবর্ষণ শুরু হয়। নিজেদের জাতীয় সংলাপের সমাপনী বিবৃতিতে এ দাবি জানায় দেশটি। গত বছরের ডিসেম্বরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদের পালানোর পর দেশটির নতুন সরকার জাতীয় রাজনীতির রোডম্যাপ প্রস্তুতের লক্ষ্যে এই শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করে। আসাদ সরকারের অপসারণের পর ইসরায়েল সিরিয়ার ওই অঞ্চলে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে যে অঞ্চলকে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নিরস্ত্রীকরণ করা হয়েছিল। যা ১৯৭৪ সালের নিরস্ত্রীকরণ চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ চুক্তির তোয়াক্কাই করেনি ইসরায়েল। এদিকে গত রবিবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দক্ষিণ সিরিয়াকে ‘অসামরিকীকরণের’ আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, তারা নতুন করে সিরিয়ান আর্মিকে দামেস্কের দক্ষিণ অঞ্চলের দিকে সামরিক অভিযানের সম্মতি দেবে না।

 

 

নেতানিয়াহুর এমন হুংকারের ফলে ধারণা করা হচ্ছে, এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আরও হুমকির মুখে পড়বে। এর ফলে সংঘাত আরও বাড়তে পারে। এদিকে জর্ডানের বাদশা আব্দুল্লাহ সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। গত বুধবার আম্মানে এক বৈঠক শেষে সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল শারাকে তিনি এ কথা জানান। দেশটির রাজপ্রাসাদের বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে ইসরায়েলের এ আগ্রাসনকে জর্ডানও ভালো চোখে দেখছে না। ইসরায়েলকে তারা নিজেদের জন্যও ক্ষতিকর ভাবছে। ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ‘কড়া শব্দে’ এই বিমান হামলার নিন্দা জানিয়েছে।

 

 

তারা একে ‘সিরিয়ান সার্বভৌমত্বের ওপর নৃশংস আক্রমণ’ এবং আরব দেশগুলোর ওপর ইসরায়েলি আগ্রাসনের ধারাবাহিকতা বলে অভিহিত করেছে। গাজা উপত্যকাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার জন্য তারা ইসরায়েলকে এককভাবে দায়ী করে। হামাস মনে করে ইসরায়েল গোটা মুসলিম বিশ্বের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরাকে মার্কিন হামলার জন্য অজুহাত হিসেবে বলা হয়েছিল, ইরাকে জনবিধ্বংসী অস্ত্রের মজুদ রয়েছে। পরে দেখা গেছে, সে রকম কিছুর অস্তিত্ব ইরাকে নেই। সিরিয়ার ক্ষেত্রে ইসরায়েলিরা যা করছে, তার উদ্দেশ্য তাৎপর্যহীন নয়। অন্যদিকে দামেস্ক ও তেল আবিবের মধ্যে এমন সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ। অবিলম্বে গোলান হাইটস থেকে ইসরায়েলকে সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে তারা। জাতিসংঘ আরও বলেছে, সিরিয়ার স্থিতিশীলতার প্রশ্নে আগামী কয়েক সপ্তাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। (আল-জাজিরা অবলম্বনে)

 

লেখক : সাংবাদিক