আরেকটি বড় যুদ্ধের ঝুঁকিতে মধ্যপ্রাচ্য
অলোক আচার্য [প্রকাশ : দেশ রূপান্তর, ১৪ জুন ২০২৫]

পৃথিবীব্যাপী তীব্র উত্তেজনার মধ্যেই ইরানে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্য আবার বড় ধরনের সামরিক ঝুঁকিতে চলে গেছে। বছরখানেক আগেও ইসরায়েল ইরানে হামলা চালায় এবং তার কিছুদিনের মধ্যে ইরানও পাল্টা হামলা করে। এরপর অবশ্য ঘটনা বেশি দূর যায়নি। তবে এবারের হামলায় ইরানের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিহত হওয়ায় এবং আরও হামলা চালানোর বার্তায় গতবারের থেকে এবারের ঝুঁকি আরও বেশি বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। হামলায় এখন পর্যন্ত ইরানের আইআরজিসি প্রধান হোসেইন সালামি ও দুই পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন।
এ ছাড়া দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি নিহত হয়েছেন। হামলার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, যত দিন প্রয়োজন তত দিন এই সামরিক অভিযান অব্যাহত থাকবে। কয়েক দিন ধরে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছিল পরমাণু ইস্যু নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার কিছুটা অগ্রগতি হলেও কাজের কাজ হয়নি। ইরানও পরমাণু কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। ইসরায়েল যেকোনোভাবে ইরানকে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে দেবে না, সে আভাস আগেও বহুবার দিয়েছে এবং প্রয়োজনে পরমাণু লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করা হবে। যদিও এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধন রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র তা অস্বীকার করেছে। তবে এটা সত্যি, ইরানের পরমাণু ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সব থেকে চিন্তিত এবং ইসরায়েলও কঠোর অবস্থানে। অবশেষে আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে এবং একটি সামরিক ঝুঁকির মুখে মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো পৃথিবী চলে গেছে।
ইসরায়েলের হামলার জবাবে এবার পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইরান। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ইরান অন্তত ১০০টি ড্রোন ছুড়েছে ইসরায়েলের দিকে। দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফও এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। আইডিএফের মুখপাত্র ইফি ডেফরিন বলেন, ‘ইরান ইসরায়েলের ভূখণ্ড লক্ষ্য করে আনুমানিক ১০০টি মানববিহীন ড্রোন ছুড়েছে।’ তবে এসব ড্রোন প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন। আগেরবার ইরানের পাশাপাশি ইরাক, ইয়েমেন ও সিরিয়া থেকেও ইসরায়েলে হামলা করা হয়েছিল। হিজবুল্লাহও সক্রিয় ছিল। হামলা-পাল্টাহামলা কি কোনো সমাধান? না বড় কোনো সমস্যার শুরু মাত্র? এই হামলা-পাল্টাহামলায় মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে যে শঙ্কা ছিল তা সম্ভবত সত্যি হতে যাচ্ছে। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্য একটি বড় ধরনের যুদ্ধের ঝুঁকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হামলার মূল উদ্দেশ্য হলো, ইরানকে পরমাণু কর্মসূচি থেকে দূরে সরানো অথবা ইরান যাতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করা। ইসরায়েলের হামলায় ইরানের ক্ষয়ক্ষতি যেমন হয়েছে, ইরানের হামলায়ও ইসরায়েলে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। তাহলে সমস্যার সমাধান কীভাবে?
এই যুদ্ধ সর্বাত্মক হবে কি না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সরাসরি হয়তো সহায়তা করবে না, তবে ইসরায়েলের ওপর বড় ধরনের আঘাত এলে বসেও থাকবে না। তা ছাড়া ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি জড়ানোর ইচ্ছা নেই। বিশ্ব কোনোভাবেই একটি বড় যুদ্ধ গ্রহণ করার মতো যথেষ্ট প্রস্তুত নয়। যদি আরেকটি যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে শুরু হয় বা ইরানের সঙ্গে বড় ধরনের সামরিক সংঘাতে রূপ নেয় তাহলে মধ্যপ্রাচ্য অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠবে। তখন যুদ্ধ শুধু ইরান আর ইসরায়েলের মধ্যেই থেমে থাকবে না। এটি আরও বিস্তৃত হবে। আর এই যুদ্ধ শুরু হলে, তা হবে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য ভয়াবহ সতর্কবার্তা। পাশাপাশি বিশ্বকেও তার খেসারত দিতে হবে। এমনিতেই মধ্যপ্রাচ্য গত কয়েক বছর ধরে বেশ উত্তপ্ত। এর মধ্যেই ইসরায়েল ফিলিস্তিনে হামলা চালালে পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। ইসরায়েলে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে বর্তমানে যে সরকার ক্ষমতায় আছে, তাকে অনেকেই সে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ‘কট্টরপন্থি’ বা হার্ডলাইন সরকার বলে বর্ণনা করে থাকেন। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন ড্রোন হামলায় সোলাইমানি নিহত হন। এই সেই কাশেম সোলাইমান, যাকে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সামরিক কর্মকান্ডের স্থপতি বলা হয়ে থাকে। সেই দাগ এখনো ইরানের মন থেকে যায়নি। সে সময় ইরান পদক্ষেপের কথা বললেও, বস্তুত তেমন কোনো কিছু করতে দেখা যায়নি অন্ততপক্ষে এবার যেভাবে সরাসরি ড্রোন হামলা চালিয়েছে।
ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরায়েলও এখন ব্যাপক চাপের মুখে রয়েছে। পুরোপুরিভাবে একঘরে না হলেও অধিকাংশ দেশই তাদের এই কর্মকান্ডকে সমর্থন করছে না। এখানেই ইসরায়েল ও ইরানের উত্তেজনার পরিসমাপ্তি হবে না। এটি কেবল শুরু মাত্র। কারণ এর নাটাই ইসরায়েলের হাতে নেই। নেপথ্যে কোনো দেশ বা গোষ্ঠী ইসরায়েলের হয়ে যুদ্ধ করছে, বিশ্ব তা জানে। এটি নতুন করে পৃথিবীকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
দুই দেশের হাতেই একাধিক বিকল্প রয়েছে সমস্যা সমাধানের। সরাসরি যুদ্ধ ছাড়াও সমাধান সম্ভব। ইরানের হামলার পর অবধারিতভাবে যুক্তরাষ্ট্র তেলআবিবকে রক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। কারণ মিত্র হিসেবে ইসরায়েল অগ্রাধিকার পাবেই। এই মুহূর্তে ইরানের আক্রমণ ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধকে বৃহত্তর ও আঞ্চলিক সংঘাতে পরিণত করতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয়, আর কোনো প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে দুই দেশ একে অপরের ওপর হামলার মতো কোনো সিদ্ধান্ত যেন বেছে না নেয়। কারণ এর ফলে বড় ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হবে বিশ্ব।
এমন যুদ্ধের প্রভাব বিশ্বে কোন ধরনের বিপর্যয় নিয়ে আসবে, তা আমরা সবাই কম-বেশি বুঝি। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে একক নেতা বা সর্বেসর্বা হওয়ার লোভ যাদের সবচেয়ে বেশি, তাদের নিয়ন্ত্রণ করার মতো একক ক্ষমতা কোনো দেশের নেই। যে কারণে সেই দেশটি নিজের মতো করে পররাষ্ট্রনীতি এবং যুদ্ধনীতি চালিয়ে যাচ্ছে। এটা চলছে যুগ যুগ ধরে। দেশটির একক দম্ভ সম্ভবত এই পাল্টাপাল্টি হামলার মাধ্যমেই ধ্বংসের শুরু ডেকে আনবে। মাঝখান থেকে ভোগান্তিতে পড়বে তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। এর চূড়ান্ত প্রভাব কী, তা নিকট ভবিষ্যতেই পরিষ্কার হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট