কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

আসাদ কে, বিদ্রোহী কারা

সূত্র : দেশ রূপান্তর, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪

আসাদ কে, বিদ্রোহী কারা

সিরিয়া এখন কর্র্তৃত্ববাদী শাসক বাশার আল আসাদমুক্ত। বিদ্রোহীরা মাত্র কয়েক সপ্তাহে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। বিস্তারিত লিখেছেন শারমিন নাহার

 

সিরিয়ার কর্র্তৃত্ববাদী শাসক বাশার আল আসাদ বিমানে দেশ ছেড়ে অজ্ঞাত স্থানে পালিয়েছেন। বিদ্রোহী বাহিনীর দখলে এখন দেশটির রাজধানী দামেস্ক। এক টেলিভিশন ঘোষণায় তারা বলেছে, শহর মুক্ত করা হয়েছে, অত্যাচারী বাশার আল আসাদকে উৎখাত করা হয়েছে। সব সম্প্রদায়ের সব সিরীয়দের জন্য একটি মুক্ত ও স্বাধীন সিরিয়া দীর্ঘজীবী হোক। বিবিসি জানিয়েছে, আবু মোহাম্মদ আল-জাওলানির নেতৃত্বে বিদ্রোহীদের এই বজ্রপাতের মতো আক্রমণ নভেম্বরের শেষ দিকে হঠাৎ আলেপ্পো দখলের মাধ্যমে শুরু হয়। যে বিদ্রোহ দুই সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে শাসনের অবসান ঘটিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে এমন প্রতিবেদনও দেওয়া হয়েছে যে, সিরিয়ার সামরিক বাহিনী হয় তাদের পদত্যাগ করেছে বা বিরোধীদের সঙ্গে চলে গেছে। এই বিদ্রোহ করেছে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস), যাদের সিরিয়ার সংঘাতে জড়িত থাকার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এইচটিএস জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক এবং অন্যান্য দেশ দ্বারা সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত।

সিরিয়ায় বাশারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয় মার্চ ২০১১ সালে। দেশটির দক্ষিণের শহর ডেরায় গণতন্ত্রপন্থি বিক্ষোভের মাধ্যমে। সিরিয়ার সরকার ভিন্ন মত দমনের জন্য মারাত্মক শক্তি প্রয়োগ করলে, প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে দেশব্যাপী বিক্ষোভ শুরু হয়। যে অশান্তি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং দমন-পীড়ন তীব্র হয়। বিরোধী সমর্থকরা অস্ত্র তুলে নেয় প্রথমে আত্মরক্ষার জন্য। পরে তা সরকারি বাহিনীর হাত থেকে নিজের এলাকা মুক্ত করার যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। বাশার আল আসাদ যাকে বিদেশি সমর্থিত সন্ত্রাসবাদ বলে আখ্যায়িত করে তা দমনের অঙ্গীকার করেন। এর ফলে শত শত বিদ্রোহী গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। বিভিন্ন বিদেশি শক্তি পক্ষ নিতে শুরু করে এবং ইসলামিক স্টেট (আইএস) গ্রুপ এবং আল-কায়েদার মতো চরমপন্থি সংগঠন এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। সহিংসতা দ্রুত বাড়তে থাকে এবং দেশটির গৃহযুদ্ধ আঞ্চলিক ও বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্র হয়ে পড়ে। অর্ধ মিলিয়নেরও বেশি লোক নিহত হয় এবং ১২ মিলিয়ন তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। যাদের মধ্যে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন শরণার্থী বা বিদেশে আশ্রয়প্রার্থী।

এইচটিএস

২০১১ সালে আল-কায়েদার সরাসরি সহযোগী হিসেবে এইচটিএস আরেকটি ভিন্ন নাম, জাভাত আল-নুসরার অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্বঘোষিত ইসলামিক স্টেট (আইএস) গ্রুপের নেতা আবু বকর আল-বাগদাদিও এর গঠনে জড়িত ছিলেন। এটিকে প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে থাকা গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর ও মারাত্মক হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু সংগঠনটি জিহাদের পরিবর্তে বিপ্লবী মতাদর্শে পরিচালিত হতে থাকে। ২০১৬ সালে এ গ্রুপের নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জাওলানি প্রকাশ্যে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তিনি জাভাত আল-নুসরাকে বিলুপ্ত করেন এবং একটি নতুন সংগঠন তৈরি করেন, যা হায়াত তাহরির আল-শাম নামে পরিচিতি লাভ করে। তখন এটি আরও কয়েকটি অনুরূপ সংগঠনের সঙ্গে একীভূত হয়। কিছু সময়ের জন্য এইচটিএস উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ ইদলিবে তার ক্ষমতার ভিত্তি স্থাপন করে। তারা স্থানীয় প্রশাসন তৈরি করে। যদিও বৈধতা পায়নি। এটি অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে কিছু তিক্ত দ্বন্দ্বেও জড়িত ছিল। তবে ইদলিবের বাইরে নিজেদের দখল কায়েমের জন্য এর উচ্চাকাক্সক্ষা অস্পষ্ট ছিল। আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর থেকে এর লক্ষ্য সিরিয়ায় বৃহত্তর খিলাফতের পরিবর্তে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

আসাদের উত্থান

বিবিসি জানিয়েছে, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত এসেছে। তবে একটি গাড়ি দুর্ঘটনা সম্ভবত তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রভাবক ছিল। ক্ষমতার পথে আসাদের যাত্রা শুরু হয় তার বড় ভাই বাসেলের গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর। ১৯৯৪ সালে দামেস্কের কাছে ওই দুর্ঘটনা যখন ঘটে, আসাদ তখন লন্ডনে চক্ষুবিজ্ঞান নিয়ে পড়ছিলেন। বাসেলের মৃত্যুর পর আসাদকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা শুরু হয়। পরে তিনি দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। যে যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছেন, বাস্তুচ্যুত হয়েছেন অনেকে। আসাদের বাবা হাফিজ আল আসাদ প্রায় ৩০ বছর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৬৫ সালে বাশার আল আসাদের জন্মের সময়ও সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যে নাটকীয় ঘটনা ঘটে। ওই সময়ই মিসর ও সিরিয়া মিলে স্বল্পকালের যে আরব প্রজাতন্ত্র করেছিল তা ভেস্তে যাওয়ার পর বাথ পার্টি ক্ষমতা দখল করে। অন্য আরব দেশের মতো সিরিয়ায়ও গণতন্ত্র ছিল না এবং বহুদলীয় নির্বাচন হতো না। আঞ্চলিক রাজনীতিতে সেখানকার সব দেশে আরব জাতীয়তাবাদ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিল। আসাদের পরিবার যে সম্প্রদায়ের ছিলেন, তারা ছিলেন সিরিয়ার খুব অনগ্রসর একটি সম্প্রদায়। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তাদের অনেক সদস্য সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। হাফিজ আল আসাদ সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে উঠে আসেন। ১৯৬৬ সালে তিনি বাথ পার্টির সরকারে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হন। পরে দেশের প্রেসিডেন্ট হন ১৯৭১ সালে। এরপর ২০০০ সালে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ওই পদেই বহাল ছিলেন। তার সময়ে অনেক সামরিক অভ্যুত্থান হলেও তা সফল হয়নি। বরং বিরোধীদের দমন ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে তিনি কঠোর হাতে দেশ শাসন করেছেন।

বিবিসি আরও জানিয়েছে, রাজনীতি ও সামরিক বাহিনী থেকে দূরে থাকতে বাশার আল আসাদ ডাক্তার হিসেবেই তার ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিলেন। দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষে তিনি ১৯৯২ সালে যুক্তরাজ্যে যান লন্ডনের ওয়েস্টার্ন আই হসপিটালে চোখের ডাক্তার হিসেবে পড়ালেখার জন্য। এ সময় তিনি ইংরেজ গায়ক ফিল কলিন্সের অনুরক্ত হন ও পশ্চিমা সংস্কৃতিতে উদ্বুদ্ধ হন। লন্ডনেই আসমা আল আখরাসের সঙ্গে তার দেখা হয়। পরবর্তী সময় তারা বিয়ে করেন। আসমা কিংস কলেজে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়তেন। তিনি হার্ভার্ডে ভর্তির জন্য বিবেচিত হয়েছিলেন। কিন্তু বাশার আল আসাদের জীবনের গতিপথ পাল্টে যায় বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর। ওই মৃত্যুই মূলত বাশার আল আসাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তৎক্ষণাৎ তাকে ফিরে যেতে হয় সিরিয়ায় এবং এরপর তাকে সিরিয়ার পরবর্তী নেতা হিসেবে প্রস্তুত করার কাজ শুরু হয়। বাশার সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন এবং ভবিষ্যতের জন্য জনগণের সামনে নিজের ইমেজ তৈরির প্রস্তুতি নিতে থাকেন। বাশার আল আসাদের শাসনের প্রথম দশকে ইরান, কাতার এবং তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হয়। সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধকে ঘিরে বাশার আল আসাদের সঙ্গে পশ্চিমাদের সম্পর্কের অবনতি হয়। তিনি ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের বিরোধিতা করেছিলেন। সম্ভবত তার আশঙ্কা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর পরবর্তী টার্গেট সিরিয়া হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র সে সময় ইরাকে তাদের বিরোধীদের কাছে অস্ত্র চোরাচালানে সহায়তার জন্য দামেস্ককে দায়ী করছিল। সে সময় ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।

পতনের পর

সেই বাশার আল আসাদের পতন মাত্র এক সপ্তাহ আগেও ছিল প্রায় কল্পনাতীত। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে বিদ্রোহীরা সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিম ইদলিবে তাদের ঘাঁটি থেকে সরকারের বিরুদ্ধে বিস্ময়কর অভিযান শুরু করে। যা সিরিয়ার ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট হয়ে থাকবে। আসাদ তার বাবা হাফেজের মৃত্যুর পর ২০০০ সালে ক্ষমতায় আসেন। আসাদ তার বাবার মতো নিয়ন্ত্রিত এবং দমনমূলক রাজনৈতিক কাঠামোর উত্তরাধিকারী হন। যেখানে বিরোধিতা সহ্য করা হতো না। যদিও শুরুর দিকে মনে হয়েছিল আসাদ কম নৃশংস। কিন্তু তা ছিল স্বল্পস্থায়ী। আসাদ চিরকাল সেই ব্যক্তি হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, যিনি ২০১১ সালে তার শাসনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকে সহিংসভাবে দমন করেন। যা দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে পরিচালিত করে। রাশিয়া ও ইরানের সহায়তায় তিনি বিদ্রোহীদের দমন করেও বেঁচে যান। আসাদ পরিবারের পাঁচ দশকের শাসনের অবসান ওই অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্যকে পুনরুজ্জীবিত করবে। ইরান যার ফলে উল্লেখযোগ্য ধাক্কা খেয়েছে। আসাদের অধীনে সিরিয়া ইরানি এবং হিজবুল্লাহর মধ্যে সংযোগের মাধ্যম ছিল। এই পথ ওই গোষ্ঠীর কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ স্থানান্তরের চাবিকাঠি ছিল। ইসরায়েলের সঙ্গে বছরব্যাপী যুদ্ধের পর হিজবুল্লাহ নিজেই মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ইরান সমর্থিত আরেকটি উপদল ইয়েমেনের হুথিরা বারবার বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ইরাকের মিলিশিয়া বাহিনী, গাজায় হামাসসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সিরিয়ার মধ্য দিয়ে সহায়তার ব্যবস্থা নতুন পরিস্থিতিতে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি ইসরায়েলে উদযাপন করবে এবং ইরানকে অস্তিত্বের হুমকি দেবে। অনেকে মনে করেন তুরস্কের আশীর্বাদ ছাড়া এই আক্রমণ ঘটতে পারত না। সিরিয়ার কিছু বিদ্রোহীর সমর্থনকারী তুরস্ক এইচটিএসকে সমর্থনের কথা যদিও অস্বীকার করেছে। অন্তত তিন মিলিয়ন সিরিয়ার নাগরিক তুরস্কে রয়েছে। যা দেশটির জন্য একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এরদোয়ান তাদের ফিরিয়ে দিতে চাইলেও আসাদ তা করতে অস্বীকার করেন। এ কারণে তুরস্ক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করতে পারে বিদ্রোহীদের। কিন্তু এরপর কী হবে, এইচটিএস কী করবে, তা আসলে অজানা। তারা গত কয়েক বছরে নিজেদের জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে পুনর্বিন্যাসের চেষ্টা করেছে। তাদের সাম্প্রতিক বার্তাগুলোর মধ্যে একটি কূটনৈতিক এবং সমঝোতামূলক সুর রয়েছে। কিন্তু অনেকে আশ^স্ত হতে পারছেন না। বরং তারা উদ্বিগ্ন যে, আসাদের শাসনের পতনের পরে কী পরিকল্পনা আছে বিদ্রোহীদের মনে। তাদের শঙ্কা, নাটকীয় পরিবর্তন বিপজ্জনক শূন্যতার দিকে নিয়ে যেতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত বিশৃঙ্খলা, এমনকি আরও সহিংসতার কারণ হতে পারে।