কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

আসন্ন নির্বাচনে বিতর্ক এড়াতে হবে ড. সুলতান মাহমুদ রানা

[সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫]

আসন্ন নির্বাচনে বিতর্ক এড়াতে হবে ড. সুলতান মাহমুদ রানা

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের দোরগোড়ায়। সাধারণত প্রতিটি নির্বাচনের আগেই যেমন উত্তেজনা, প্রত্যাশা আর রাজনৈতিক অস্থিরতার ছায়া ছড়িয়ে থাকে, এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এবার পরিস্থিতি আগের অনেক নির্বাচনের তুলনায় বেশি জটিল এবং অনেক বেশি প্রক্রিয়াগতভাবে সংকটময়। কেননা এবার একসঙ্গে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

 
 

 

 

 

কয়েক সপ্তাহ ধরে নির্বাচন কমিশনের ভেতরে যে ব্যস্ততা চলছে, তা সংবাদমাধ্যমে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে ভোটকেন্দ্র চিহ্নিতকরণ, ভোটকক্ষ বৃদ্ধি, প্রয়োজনীয় উপকরণ মুদ্রণ, মনোনয়নপত্র প্রস্তুত, প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা এবং আইনগত অন্যান্য কাজ—সব মিলিয়ে কমিশন এক ধরনের চাপের মধ্যে রয়েছে।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

এদিকে বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের নেতারা অভিযোগ তুলেছেন যে এখনো ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি হয়নি। তাঁরা মনে করেন, মাঠের সমীকরণ বা প্রতিযোগিতার সুযোগ-সুবিধা এখনো সমান নয়। এ ধরনের দাবি এবং বক্তব্য কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের নয়, বরং সামগ্রিকভাবে রাজনীতিতে যে আস্থাহীনতা রয়েছে, তারই প্রতিফলন। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের অভিযোগ আরো বাড়তে পারে, যদি না কমিশন ও প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে।

 

 

এবারের নির্বাচনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো গণভোট। এই গণভোটের প্রশ্নটিই আসলে পুরো রাজনৈতিক পরিবেশকে আরো জটিল করেছে। ভোটারদের জন্য এটি হবে দ্বৈত দায়িত্ব, আর প্রশাসনের জন্য দ্বৈত দায়বদ্ধতা। গণভোটের ব্যালট ব্যাখ্যা করা থেকে শুরু করে গোপন কক্ষে ভোট দেওয়ার সময়, ব্যালট গণনা, ফলাফল প্রক্রিয়া—সবকিছুতেই বাড়তি সময় ও বাড়তি কর্মীর প্রয়োজন হবে। এর সঙ্গে যোগ হবে শীতকালীন সকাল, নির্বাচনী কেন্দ্রে ভিড়, সম্ভাব্য পরিবহনজট, যোগাযোগ সীমাবদ্ধতা—এসব বাস্তবতা ভোটগ্রহণকে কঠিন করে তুলতে পারে।

 

 

শুধু তা-ই নয়, ভোটারদের মনস্তত্ত্বও এ সময়ে ভিন্নভাবে কাজ করবে। সাধারণ নির্বাচনের ভোটার আচরণ অনেকটাই দলীয় প্রতীক ও প্রচারণার ওপর নির্ভর করলেও গণভোটে ভোটারদের ভাবতে হয় আলাদা যুক্তিতে। কিন্তু দেশের ভোটারদের বড় অংশ গণভোটের অভিজ্ঞতায় অভ্যস্ত নয়। ফলে ভোট বুঝতে ভুল হওয়া, ব্যালট বাতিল হওয়া—এসবও বাড়তে পারে। কমিশনকেই তাই সচেতনতা ও ব্যাখ্যা প্রচারে আরো বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

 

 

নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় বা পাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্যবিভ্রান্তি, গুজব, অনুমান ও অপপ্রচার—সবকিছুই পরিবেশকে উত্তপ্ত করে তোলে। বিশেষ করে তফসিল ঘোষণা, ভোটের ধরন, আইন ও নিয়মের পরিবর্তন—এসব বিষয়ে ভুল তথ্য ছড়ানো হলে মাঠ পর্যায়ে বিভ্রান্তি তীব্র হতে পারে। নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে ভুল তারিখ প্রচার নিয়ে সতর্ক করেছে, যা দেখাচ্ছে যে তথ্য বিকৃতি এখনই শুরু হয়ে গেছে।

 

 

তার পরও সম্ভাবনার জায়গা ছোট নয়। এবারকার নির্বাচন প্রবাসী ভোটারদের জন্য একটি নতুন সুযোগ নিয়ে আসছে। পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে দেশ থেকে দূরে থাকা লাখো মানুষ প্রথমবারের মতো প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পাবে, যার রাজনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব বিশাল। অন্যদিকে পুরনো ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ নির্বাচিত হওয়ার পথ বন্ধ হওয়ায় প্রতিটি আসনে প্রতিযোগিতা থাকবে, যা নির্বাচনী বৈধতা বাড়াতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি অংশগ্রহণ বাড়ছে নারীদের, তরুণদের, প্রথমবার ভোটারদের, যা ভোটের চিত্রকেই আলাদা করে দিতে পারে।

 

 

সামগ্রিকভাবে আসন্ন নির্বাচনটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রায় একটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে দেশকে। এই নির্বাচন কি নতুন আস্থার জন্ম দেবে, নাকি আরো একটি বিতর্কের অধ্যায় তৈরি করবে, তা এখনো বলা কঠিন। তবে রাজনীতির মাঠে যে সন্দেহ, অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ—এসব যত বাড়বে, কমিশনের দায়িত্বও তত বাড়বে। কারণ জনগণের আস্থা ছাড়া কোনো নির্বাচনই কার্যকর হয় না। এক অর্থে সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ‘বিশ্বাস’। রাজনৈতিক দল, ভোটার, প্রশাসন ও নির্বাচনী কর্তৃপক্ষ—এই চার পক্ষের পারস্পরিক বিশ্বাসই নির্ধারণ করবে নির্বাচন কতটা গ্রহণযোগ্য হবে। তাই নির্বাচনী প্রস্তুতিতে যত দৃশ্যমান আলোই দেখা যাক না কেন, এই আলোর ছায়ায় যে শঙ্কাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে, সেগুলো এড়ানো যাবে না, বরং সেগুলোকে সামনে রেখেই বাংলাদেশকে এগোতে হবে আরো স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের দিকে।

 

 

তবে নির্বাচনকে অর্থবহ করতে হলে সব পক্ষকে একই মানসিকতা নিয়ে এগোতে হবে। এমনকি রাজনৈতিক দল ও সরকার উভয় পক্ষকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা রাখতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভোটাররা যাতে কোনো ভয় বা চাপ ছাড়াই ভোট দিতে পারেন, সেই পরিবেশ নিশ্চিত করা। অন্যথায় আগামী নির্বাচন হতে পারে আরেকটি বিতর্কিত রাজনৈতিক অধ্যায়।

 

 

লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়