বাংলাদেশ এবং বৈষম্যের বেড়াজাল
আব্দুল বায়েস । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৪ মার্চ ২০২৫

পাঠকের নিশ্চয়ই দারিদ্র্য ফাঁদের কথা মনে আছে, তেমনি এক ফাঁদ বৈষম্য—ফাঁদ, যা প্রজন্মে স্থানান্তরিত হতে পারে কিংবা মাকড়সার জালের মতো বৈষম্য ধরে রাখে। পুরুষশাসিত সমাজে একজন নারীর অবস্থানের কথা ধরা যাক, যেখানে একজন নারী সম্পত্তি এবং উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত। তাদের চলাচলের স্বাধীনতা সীমিত। কারণ সামাজিক নিয়ম ‘ভিতর’ ও ‘বাহির’ হিসেবে কাজ শনাক্ত করে দিয়েছে।
এমন অসম সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামো অতি সহজে পুনরুৎপাদিত হতে থাকে।
দুই.
প্রেক্ষিত বাংলাদেশ। আদিকাল থেকে অর্থনীতিবিদদের কাছে প্রবৃদ্ধির পরিমাণগত দিকটা অধিকতর গুরুত্ব পেয়ে আসছে, যদিও সাম্প্রতিক দশকগুলোতে সে ধারার কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে।
তিন.
কিন্তু যতটা ভাবা যায় সম্পর্কটা আবার ততটা সরলরৈখিক নয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেশি হলে দারিদ্র্য হ্রাস দ্রুত না-ও হতে পারে এবং প্রবৃদ্ধিবৈষম্য ও দারিদ্র্য সম্পর্ক নিয়ে আমরা এর আগে আলোচনা করেছি। লক্ষ করা গেছে, এ বিষয়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা অন্যান্য দেশ থেকে খুব একটা ভিন্নতর নয়। এখানেও ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য দারিদ্র্য হ্রাসের ওপর প্রবৃদ্ধির প্রভাবকে সংকুচিত করে রাখছে। যদি বৈষম্যের কথাই বলি, গিনি সহগ ১৯৮৩/৮৪ সালের ০.৩৯ থেকে ২০২৪ নাগাদ ০.৪৯-তে গড়ায়। বৈষম্যের এই বিস্তার শুধু দারিদ্র্য হ্রাসের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলেনি, ক্রমবর্ধিষ্ণু বৈষম্য সমাজে একটি ক্ষুদ্র অংশের হাতে আয় পুঞ্জীভূত করে আপেক্ষিক বঞ্চনার জন্ম দিয়ে চলছে। এই রূঢ় বাস্তবতা আমাদের সামনে আজ এক সামাজিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্রকটভাবে উপস্থিত। আর নাগরিকদের জীবনমানের বেলায় পর্বতপ্রমাণ বৈষম্য যে কী ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, তার ভূরি ভূরি প্রমাণ তো ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছেই। তবে বৈষম্যতাড়িত অসন্তোষ কখন দানা বেঁধে ‘গণবিপ্লবে’ রূপ নেবে, তা নির্ভর করে সমাজের আয়বৈষম্য সহ্য করার ক্ষমতার ওপর; যেমন—বাংলাদেশের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে তীব্র বৈষম্যের ভূমিকা খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।
চার.
তবে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই যে বেড়ে ওঠা আয়বৈষম্য শুধু বাংলাদেশেরই সমস্যা। উদাহরণ হিসেবে ভারত ও চীনের কথা উল্লেখ করা যায়। সেখানে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেমন ঘটেছে, তেমনি বাড়ছে বৈষম্য। আর অর্থনৈতিক অধ্যয়নে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ সাইমন কুজনেটসের সাড়া-জাগানো ইনভারটেড ইউ হাইপোথেসিসের কথা নিশ্চয় মনে আছে। তাঁর মতে, প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৈষম্য (বিশেষত আয়বৈষম্য) বৃদ্ধি পায়, তবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর পর বৈষম্য ক্রমাগতভাবে হ্রাস পেতে থাকে। এটি ঘটে মূলত এ কারণে যে দরিদ্র জনগণ দীর্ঘ সময়ে প্রবৃদ্ধিজনিত উপচে পড়া প্রভাবগুলো থেকে ক্রমেই লাভবান হতে থাকে। হতে পারে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি ও বৈষম্যের মধ্যে বিরাজমান এই বিপরীতমুখী সম্পর্ক কুজনেটসের প্রতিপাদ্যের প্রতি কিছুটা হলেও সমর্থন জানায়। তবে এ প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার যে ধারণাটি এরই মধ্যে প্রচুর বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং প্রশ্ন উঠেছে, নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে কি তাহলে এই প্রবণতা অবশ্যম্ভাবী? এ নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা হয়েছে, যদিও বা শেষ হয়েছে কোনো উপসংহার ছাড়াই। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন যে আপাতদৃষ্টিতে প্রবৃদ্ধি ও বৈষম্যের মধ্যে বিপরীতমুখী সম্পর্ক থাকার তেমন কোনো কারণ নেই। অনেক দেশে সম্পদের প্রারম্ভিক বিতরণ তির্যকভাবে অসম থাকার ফলে এবং ওই দেশগুলোতে বৈষম্য হ্রাস সংক্রান্ত কৌশল ও নীতিমালার ব্যর্থতাই এ ধরনের বৈষম্য সৃষ্টির পেছনে ইন্ধন জোগায়। যা হোক, আয়ের পুনর্বণ্টন দুটি উপায়ে দারিদ্র্য হ্রাসের পথ প্রশস্ত করে। প্রথমত, আয়ের স্থায়ী পুনর্বিন্যাস বিতরণ প্রভাবের মাধ্যমে তাত্ক্ষণিকভাবে দারিদ্র্যের প্রকোপ কমাতে সাহায্য করে। দ্বিতীয়ত, এটি প্রবৃদ্ধি সাপেক্ষে দারিদ্র্য প্রভাবগ্রাহকতা বা স্থিতিস্থাপকতাকে স্থায়ীভাবে বৃদ্ধি করে এবং এর ফলে যেকোনো প্রবৃদ্ধির হারের মাত্রায় দারিদ্র্য হ্রাসের বেগ বেড়ে যায়। অর্থাত্ এজাতীয় পুনর্বিন্যাস তখন দ্বৈত পুরস্কার বা ডাবল ডিভিডেন্ড বয়ে আনে : একদিকে প্রবৃদ্ধি নিজেই দ্রুততর হয় আর অন্যদিকে যে গতিতে প্রবৃদ্ধি দারিদ্র্য হ্রাস ঘটায়, তা-ও বেগবান হতে থাকে।
পাঁচ.
গিনি সহগ নিচে নামিয়ে আনতে গেলে বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিষোদগার যথেষ্ট নয়, চাই একটি সুদৃঢ় রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের ঊর্ধ্বে উঠে ‘পাপীদের’ জন্য যথাযথ শাস্তির বিধান করা। আর তাহলেই বৈষম্য নামক ‘পাপের’ মাত্রার পরিসমাপ্তি না ঘটলেও তা যে অনেকখানি হ্রাস পাবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিরাজমান প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল সংস্কার ছাড়া বৈষম্য কমানোর প্রচেষ্টার মানে দাঁড়ায় পেটে কৃমি দূর না করে পুষ্টিকর খাবার ভক্ষণ করা। কিন্তু এই অভাগা বাংলাদেশে তা কতটা সম্ভব সে প্রশ্ন উঠছে প্রতিনিয়ত।
বিরাজমান ব্যবস্থায় এই কাজটি করা খুব কঠিন। এর জন্য প্রয়োজন হবে করকাঠামোতে বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা ও দুর্বলতা দূর করে কর ফাঁকি রোধ করা, সাধারণভাবে সম্পত্তি কর পদ্ধতি গ্রহণ করা এবং কর ব্যবস্থাপনায় উন্নতি ঘটানো। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সাদেক আহমেদের মতে, সরকারি ব্যয় পুনর্বিন্যাসের প্রভাব থেকে আসবে জিডিপির ২ শতাংশ এবং অতিরিক্ত করের জোগান থেকে ২.৫ শতাংশ দিয়ে সামাজিক সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন জিডিপির ৪ শতাংশ জোগান দেওয়া যেতে পারে। এর সঙ্গে যুক্ত থাকবে বিভিন্ন ধরনের অপচয় থেকে অবমুক্ত অর্থ। এবং সেটি করতে পারলে প্রবল রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিজনিত বিস্তারিত পরিকল্পনা আয় বিতরণ ব্যবস্থায় উন্নতি ঘটিয়ে অপেক্ষাকৃত অধিকতর সমতা বিধান করতে সক্ষম হবে বলে ধারণা করা যায়।
তা ছাড়া সুশাসনের মাধ্যমেও কিন্তু আয়বিন্যাসে উন্নতি ঘটানো যায়। আইনের শাসনের উপস্থিতি, যথাযথ বিধিমালা, ব্যবস্থা এবং বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে চলতে এবং কাজ করতে দেওয়ার মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সমতা বিধানের স্বার্থে রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি এবং দম্ভ ও ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা এবং এই ঋণ পরিশোধ না করে ‘খাজনা’ খোঁজার প্রবণতা অবশ্যই রুখতে হবে। অন্যদিকে একটি অপেক্ষাকৃত ন্যায়সংগত সমাজ বাস্তবায়িত করতে হলে শেয়ারবাজারে অনৈতিক বাণিজ্য এবং অন্যান্য বিকৃতি, কর ফাঁকি, সরকারি ক্রয়ে দুর্নীতি, জোর করে জমি দখল ইত্যাদি রোধ করার মাধ্যমে সমাজের উঁচু ৫ শতাংশের হাতে কুক্ষিগত এসব আয় কিছুটা হলেও কমানো যেতে পারে। বলতে দ্বিধা নেই, কুক্ষিগত সম্পদের পেছনে (এবং বিরাজমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের পেছনে) কাজ করছে বলিষ্ঠ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, যা বন্ধ না হলে বৈষম্য কমবে বলে মনে হয় না। কিছু প্রতিষ্ঠান; যেমন—কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক, রাজউক, কর বিভাগ, পৌরসভা ইত্যাদিকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মুক্ত রেখে দেয় নিয়ম-কানুন ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে চলতে দিলেই একদিকে যেমন অর্থনৈতিক নৈরাজ্য নির্বাসিত হতে পারে, তেমনি আয়বিন্যাসের উন্নতি ঘটবে বলে আশা করা যায়।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়