বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ কার?
মঞ্জুরুল আলম পান্না । সূত্র : দেশ রূপান্তর, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সম্প্রতি ওয়াশিংটনে ডোনাল্ড ট্রাম্প আর নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের পর নতুন করে আবিষ্কৃত হলো বাংলাদেশের অবস্থান। বাংলাদেশের ভাগ্যের পরিবর্তন যে এদেশের মানুষের হাতে নেই, তা আরও একবার স্পষ্ট হলো। এটি একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য চরম অবমাননাকর। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ভারতের চোখে দেখে কি না, সেই প্রশ্নও সামনে চলে এলো আরও একবার। শুক্রবার দিনভর সারাদেশের মানুষের মুখে মুখে ছিল ট্রাম্পের বক্তব্যের নানা বিশ্লেষণ। এ আলোচনা থেকে দূরে থাকেনি, শীর্ষস্থানীয় সব গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা পর্যন্ত।
প্রথমেই বলে রাখি, দুই রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানদের মধ্যে এই বৈঠকের মূল লক্ষ্য চীনকে প্রতিরোধে নিজেদের মধ্যে সামরিক সহযোগিতার চুক্তি। আর এই অঞ্চলে চীনকে প্রতিরোধ করতে গেলে খুব স্বাভাবিকভাবেই ভূ-কৌশলগতভাবে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ চলে আসে। ট্রাম্প-মোদির বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতীয় এক সাংবাদিকের প্রশ্ন এবং ট্রাম্পের উত্তরে বোমা পড়ে বাংলাদেশে। ভারতের গণমাধ্যমেও তার বয়ান প্রচারে বয়ে যায় সুনামি। ওই সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল- বাংলাদেশে ক্ষমতার পালা বদলে বাইডেন প্রশাসনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ স্টেটের কোনো ভূমিকা ছিল কি না? মার্কিন ধনকুবের জর্জ সোরেসের পুত্র এলেক্স সোরেস যে ড. মুহম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, সেই দিকটা ইঙ্গিত করে প্রশ্ন করা হয় বাংলাদেশ নিয়ে ট্রাম্পের ভাবনা কী?
খুব স্বাভাবিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ স্টেটের বিষয়টি নাকচ করার পর, বাংলাদেশ প্রসঙ্গটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওপর ছেড়ে দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তার এই অংশের বক্তব্য ছিল হুবুহু এ রকম ‘বাংলাদেশের বিষয়টি আমি (ভারতের) প্রধানমন্ত্রীর ওপরই ছেড়ে দেব’। ট্রাম্পের ওই এক কথাতেই হইচই পড়ে যায় বাংলাদেশ জুড়ে। ফাল্গুন আর ভ্যালেন্টাইন ডেতে আওয়ামী সমর্থকদের উষ্ণ ভালোবসায় সিক্ত হন ডোনাল্ড ট্রাম্প! এতদিন বুঝি এমন কথার আশাতেই ছিলেন তারা। আওয়ামী শিবির বলতে চাইল, মার্কিন মুল্লুকের অধিপতি বাংলাদেশ বিষয়ে সব কিছুর ভার অর্পণ করেছেন ভারতের হাতে। ভারত যা চাইবে তাই হবে। অতএব সগৌরবে ঘটতে যাচ্ছে শেখ হাসিনার পুনরুত্থান। বিপরীতে জাত গেল, সব গেল বলে ‘হায় হায়’ করে প্রতিবাদ করে আওয়ামীবিরোধী শিবির। আওয়াজ উঠতে থাকে ‘না, যুক্তরাষ্ট্র’ এ কথা বলতেই পারে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প বরং ওই সাংবাদিকের প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন। অর্থাৎ বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মাথাব্যথাই নেই। এতে মোদির গালে চপেটাঘাত পড়েছে।
দেশের গণমাধ্যমগুলোতেও দেখা গেল বিভক্তির সংবাদ। একপক্ষের শিরোনামে মনে হলো যে, বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতই সবকিছুর নিয়ন্তা। আরেকপক্ষ দেখাতে চাইল, এ সংক্রান্ত মোদির প্রত্যাশাকে তুরি মেরে উড়িয়েছেন ট্রাম্প। আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলও তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে আরেকজনের পোস্ট শেয়ার করে সহমত পোষণ করে বলার চেষ্টা করলেন ট্রাম্প এমন কোনো কথা বলেননি। প্রমাণ করতে চাইলেন, ড. ইউনূস সরকার চাপমুক্ত। নতুন মার্কিন সরকার আসলে বাংলাদেশ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। মোদির আশার গুড়েবালি। এর মানে কী? অন্তর্বর্তী সরকার কি সত্যিই কোনো দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিল, আলোচিত ওই বৈঠক নিয়ে? অথবা এখনো রয়েছে ভয়ংকর কোনো দুর্ভাবনায়? যে যেভাবেই ট্রাম্পের বক্তব্য ব্যাখ্যা করুক না কেন, সরকারের দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তির এ বিষয়ে কথা বলার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এসব আলোচনা থেকে বোঝা যায়, আমরা সবাই এই ভূখ-ের ভাগ্যের জন্য এখনো তাকিয়ে রয়েছি পরাশক্তির মুরব্বিদের ওপর। স্বীকার করে নিচ্ছি খেলা চলছে অদৃশ্য সুতায়।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ ইস্যুতে আসলে কোনো সমঝোতায় কি পৌঁছেছে দুই রাষ্ট্র? প্রথম কথা হচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ স্টেটের কথা অস্বীকার করেছেন ঠিকই। কিন্তু ভারত যে এ বিষয়ে শত বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রকারন্তরে বুঝিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে দিল্লিই বেশি অভিজ্ঞ। অতএব তার ওপরেই আস্থা যুক্তরাষ্ট্রের। বিশেষভাবে আবারও উল্লেখ করতে চাই, প্রশ্নকর্তা সাংবাদিক কিন্তু জর্জ সোরেসের প্রসঙ্গটি তুলে ধরেছেন বিশেষ উদ্দেশ্যে। জর্জ সোরেস একজন হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন ধনকুবের। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, এনজিও সিভিল রাইটস গ্রুপের অর্থদাতা।
নিজেদের প্রয়োজনে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকার পরিবর্তনে ডিপ স্টেটের ভূমিকা পালন করে এসব প্রতিষ্ঠান। কিছুদিন আগে ওসিসিআরপি নামে যে প্রতিষ্ঠানটি মোদির ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গৌতম আদানির দুর্নীতির খবর প্রকাশ করেছিল, সেটি জর্জ সোরেসের টাকাতেই চলে বলে অভিযোগ রয়েছে। জর্জ সোরেস আমদানিকা- নিয়ে মন্তব্য করেন, ‘এই ঘটনায় ভারত সরকারের ওপর নরেন্দ্র মোদির নিয়ন্ত্রণ শিথিল করবে। আমি ভারতে গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান আশ করছি।’ আর তা নিয়ে তোলপাড় হয়ে ওঠে ভারত।
বাংলাদেশের বিষয়টি ভারতের ওপর ছেড়ে দেওয়ার অর্থ যদি ট্রাম্পের পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়, তাতেও বিষয়টি প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশ বিষয়ে মোদি যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের সিদ্ধান্ত বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। ভারতের শীর্ষ কূটনীতিকরা বলছেন, তাদের ঘরের পাশে শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল এবং সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ দেখতে চান মোদি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে এমনটাই জানানো হয়েছে এবং তিনিও দিল্লির এই নীতির প্রতি পুরোপুরি সমর্থন জানিয়েছেন। এটি মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, বেশ ভালো হোমওয়ার্ক করে ওভাল অফিসের ভারতীয় বংশোদ্ভূত কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠকের পরেই ট্রাম্পের সামনে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। মোদি আলাদা আলাদা বৈঠক করেন মার্কিন ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্সের প্রধান বহুল আলোচিত তুলসী গ্যাবার্ড, প্রভাবশালী উদ্যোক্তা বিবেক রামাস্বামীসহ আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) মাইক ওয়ালজের সঙ্গেও। এসব গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকেও আলোচিত হয়েছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। তারাও আগে থেকে বুঝিয়ে রেখেছেন ট্রাম্পকে।
সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বেশি কথা না বলে বলটি তাই ছুড়ে দেওয়া হয়েছে মোদির কোটে। আমাদের মনে রাখা দরকার, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি বাস্তবায়ন করতে হলে ভারতকে অবশ্যই দরকার। এ কথা তো সত্য, ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে টু প্লাস টুর বৈঠকে ওয়াশিংটনকে দিল্লি বার্তা দিয়ে রেখেছিল এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আওয়ামী লীগের বিকল্প নেই। বাইডেন প্রশাসন সর্বান্তকরণে তা মেনে নিতে না পারলেও পরে আর কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। ৭ জানুয়ারির তুমুল প্রহসনের ডামি নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হতে পেরেছিল এ কারণেই। বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র দুটি বিষয়ে সবসময় একমত পোষণ করে। তা হলো, কথিত ইসলামি জঙ্গি ঠেকানো এবং চীনের আগ্রাসন আটকানো। সেই জায়গা থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের জন্য দেশটি দিল্লিকেই তাদের লোকাল এজেন্ট বলে মনে করেন অনেকে।
ট্রাম্প-মোদির বৈঠক নিয়ে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলছেন, জো বাইডেনের শাসনামলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তা অব্যাহত রাখতে এখনকার দুপক্ষই একমত। এতে প্রাধান্য পাচ্ছে প্রযুক্তি এবং প্রতিরক্ষা খাত। সেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ থেকেই বাংলাদেশ ইস্যুতে তারা একবিন্দুতে থাকবে বলে মনে হয় আমার কাছে। বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের চোখে দেখে না, এমন কথা মার্কিন কর্তাব্যক্তিরা অনেকবার উল্লেখ করেছে ঠিকই।
কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থাকা সত্ত্বেও ভারতের সিদ্ধান্তকেই শেষমেশ গুরুত্ব দিতে দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রকে। বৈঠকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আদায়ে ভারত সফল হয়েছে কি না তা মোটামুটি আরও স্পষ্ট হয় সাউথ ব্লকের কর্তাব্যক্তি বিক্রম মিশ্রির সংবাদ সম্মেলনে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানান, ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে উদ্বেগের কথা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে তুলে ধরেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি না হলে মিস্টার মিশ্রি এত সাবলীলভাবে বিষয়টি সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরতেন না। বরং তা এড়িয়ে যাওয়া হতো সুকৌশলে।
এখন প্রশ্ন বাংলাদেশের বিষয় যুক্তরাষ্ট্র মোদির ওপরে ছেড়ে দিলেই কি শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে বসে যাবেন! এমনটা যারা ভাবছেন, সত্যিই তাদের জন্য করুণা হয়। তবে এমন কিছু হলে দ্রুত আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়ানোটা অনেক বেশি সহজ হয়ে উঠবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে তাকে নিষিদ্ধ করা হবে কঠিন। আগামী নির্বাচন হয়ে উঠবে অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। পাশাপাশি ট্রাম্পের মন্তব্য যদি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যে কোনো সিদ্ধান্তে ভারতকে লাইসেন্স দেওয়ার মতো কিছু হয়ে থাকে, তা হবে অত্যন্ত লজ্জার। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের অবস্থান যে কতটা নাজুক, তা ভেবে আমাদের কুণ্ঠিত হতে হয়। বাংলাদেশকে নিয়ে খেলায় পরাশক্তিগুলো এখনো সাবলীলভাবে প্রকাশ করে যাচ্ছে তাদের ঔদ্ধত্য। এটি নিশ্চিতভাবে আমাদেরই কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যর্থতা। ভারত তার নিজ স্বার্থে নোংরা খেলা থেকে যে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি, সেটিও প্রমাণ করল।
অপ্রিয় বাস্তবতা হলো বাংলাদেশের সঙ্গে ৫ হাজার ৮৩১ কিলোমিটারের দীর্ঘ সীমান্তে নিজেকে নিরাপদ রাখতে দিল্লি শেষ পর্যন্ত ভয়ংকর খেলা খেলে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এ নিয়ে দেশটির নিজের ভেতরেও রয়েছে মতপার্থক্য। এককভাবে বিশেষ একটি দলের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে থাকাটা, ভারতের জন্য আরও ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, দুদিন আগে কংগ্রেসের শীর্ষনেতা শশী থারুরও তা মনে করিয়ে দিয়েছেন। ট্রাম্প যদি ভারতকে এমন কোনো পাওয়ার দিয়েই থাকে বাংলাদেশের জন্য তা আরও অনেক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে উঠবে নিশ্চয়। লেখা শেষ করব, একটি প্রশ্ন দিয়ে। আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা কি এখনো ভারতের ওপরে ভর করেই আগামীর পথে হাঁটতে চাইছে? এমন কিছু হলে উপমহাদেশের প্রাচীন দলটি কি আরও বেশি অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল হবে না? আসলে বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ কার!
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক