বাংলাদেশ পলিটিক্যাল ইকোনমির পরীক্ষাগার ?
ড. মো. আবু হাসান । সূত্র : শেয়ার বিজ, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫

বাংলাদেশ যেন পরিণত হয়েছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পলিটিক্যাল ইকোনোমির পরীক্ষাগারে। অন্যান্য পরীক্ষার পাশাপাশি এই পরীক্ষাগারে অর্থনীতির ‘টানেল প্রভাব’কে তাত্ত্বিক কাঠামোয় ফেলে আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ও রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার আমার মতো ক্ষতিগ্রস্ত মিডিওকারদের পরিবর্তিত সহনশীলতার মাত্রা পরিমাপ চলছে। সমসাময়িক সময়ে পূর্ব এশিয়ারদেশগুলোর সাথে বাংলাদেশও একই দিকে যাচ্ছে এরকম একটি দুই লেনের টানেলেঢুকেছিলো।
টানেলের জ্যামে আটকাপরা বাংলাদেশের আপামর মানুষ ঈর্ষান্বিত হয়ে দেখতে থাকলো পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দেশপ্রেমিক ও সৎ ড্রাইভারগুলো কি দারুণ দক্ষতা আর মুন্সিয়ানায় জ্যাম কাটিয়ে মসৃণভাবে টালেন অতিক্রম করে মিরাকল ঘটিয়ে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে স্টিয়ারিংও বুকপকেটে এক সাগর রক্তের দামে অর্জিত স্বাধীনতার ব্ল্যাংক চেক আমানত রেখে এই ভূখ-ের গণমানুষ বারেবারে আশাবাদী হয়েছে এই ভেবে যে, জ্যাম শেষ করে একটু দেরিতে হলেও আমরাও এগিয়ে যাবো।
মানবসম্পদ উন্নয়নে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও গবেষণা, দক্ষ আমলাতন্ত্র, সুশাসন এবং বিশ্বায়নকে গুরুত্ব দিয়ে এক প্রজন্মের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর এবং হংকংয়ের মতো পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি চরম দারিদ্র্য থেকে উঠে এসে দ্রুত অগ্রগতি অর্জন করলো। আর, এদিকে, আমরা কয়েক প্রজন্ম আর অর্ধ-শতাব্দী অপেক্ষার পরওবুঝতে পারছি না স্বাভাবিক নিয়মে টানেলের জ্যাম থেকেপরিত্রাণ নাই। প্রশ্ন হলো, বেবি বুমারস, এক্স, ও মিলেনিয়াল জেনারেশনের সবাই কি আমৃত্যু এই জ্যামেই আটকে থাকতে চেয়েছে? অন্যদের অগ্রগতি দেখেও অন্তত ঈর্ষান্বিত হয়নি? ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেনি?
অগ্রগতির দ্বারপ্রান্তে থাকার বিষয়ে আশাবাদ পিছিয়ে থাকার ক্রোধে পরিণত হয়নি?উত্তর হলো, সকল প্রকার বৈষম্যকে লাথি মেরে একটি শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, সাম্য ও মানবিক মর্যাদাভিত্তিক সমাজ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় থেকেই ১৯৪৭ থেকে ৭১, ৯০ হয়ে শূন্য দশকের ০৭শে এই ভূখ-ের গণমানুষ তাদের সহনশীলতার বাঁধ ভেঙ্গে অযুত বলিদানের বিনিময়ে অগ্রগতির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছে। অথচ, পরিহাসের বিষয় এই যে, বিজয়ের মুনাফা ক্যাশ করার অমার্জনীয় ব্যর্থতা এবং পরিশেষে একমুখী টানেলের জ্যামে আমৃত্যু আটকে থেকে পাশের লেনের গাড়িগুলোকে এগিয়ে যেতে দেখার একরাশ হতাশা যেন এই জাতির ললাট-লিখন হয়ে আছে।
দায় কার? সেই ৯০ এর দশকে শিল্পী কবীর সুমন গানের ভাষায় উত্তর দিয়েছেন এভাবে, “ক’বার তুমি অন্ধ সেজে থাকার অনুরাগে, বলবে তুমি দেখছিলে না তেমন ভালো করে…,প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা।” নির্মোহভাবে ইতিহাস অধ্যয়ন করলে সবাই একমত হবে যে, অন্তত বিশ-ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে ১৯৭১’এ অর্জিত স্বাধীনতা ছিল এই জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় সুযোগ।
অথচ, পরিতাপের বিষয় এই যে, অসীম সম্ভাবনাটির অপমৃত্যু ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই। স্বাধীনতার ব্ল্যাংক চেক ক্যাশ করে বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, সাম্য ও মানবিক মর্যাদাকে মূলনীতি মেনে মানবসম্পদ উন্নয়নে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও গবেষণা, দক্ষ আমলাতন্ত্র, সুশাসন এবং বিশ্বায়নকে গুরুত্ব না দিয়ে শেখ মুজিব ও তার আওয়ামী লীগ বিচার বহির্ভূত হত্যা ও গুম, নির্বাচনে নোংরা হস্তক্ষেপ, বণ্টনজনিত কারণে দুর্ভিক্ষ, এবং একদলীয় বাকশাল কায়েম করে।
আধুনিক সিঙ্গাপুরের জনক লি কুয়ান ইউ তাঁর আত্মজীবনী“ফ্রম থার্ড ওয়ার্ল্ড টু ফার্স্ট: দ্য সিঙ্গাপুর স্টোরি: ১৯৬৫-২০০০” বইয়ের ৩৬৩ পৃষ্ঠার শেষ প্যারায় কানাডার অটোয়ায় ১৯৭৩ এর কমনওয়েলথ সম্মেলনে শেখ মুজিবকে দেখার স্মৃতিবর্ণনাকরেছেন। প্রোপাগান্ডা হতে পারে এই ভেবে বইটি সংগ্রহ করে পড়ার পর হতাশা আর লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে বসে ছিলাম অনেকক্ষণ। লি কুয়ান ইউ লিখেছেন, এইড চাইতে গিয়েশেখ মুজিব বোয়িং-৭০৭ প্রাইভেট বিমান ৮ দিন অলস বসিয়ে রাখে এবং গাড়িকে গাড়ি ভর্তি মালসামান সেই বিমানে তুলে বিলাসিতা করে ফিরে আসে।
যেশাসক তাঁর দলীয় নেতাদের মজুদদারি ও বণ্টনজনিত অব্যবস্থাপনার জন্য সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের পূর্বমুহূর্তে ব্যক্তিগত ভোগবিলাসিতা নিয়ে মত্ত ছিলতাঁর দ্বারা এই জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করা অসম্ভব ছিল।ফলশ্রুতিতে, একদল বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে নির্মমভাবে নিহত হওয়ায় এই ভূখ-ের মিডিওকার মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে অনন্য উচ্চতায় রেখেছে এবং শাসক মুজিবের অমার্জনীয় ব্যর্থতাকেও স্বাধীনতার ব্ল্যাংক চেকের আমানতকে খেয়ানত না ধরেই সর্বোচ্চ ক্ষমাশীলতা দেখিয়েছে তার আওয়ামী লীগকে।
শৈশব ও কৈশোরে বিশ্বায়নের আলো বঞ্চিত আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠা সকলের বিকল্পহীন ইনফ্লুয়েন্সার ছিল তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, সিভিল সোসাইটি, মিডিয়া মুঘল ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। এই বিকল্পহীন ইনফ্লুয়েন্সারদের প্রতারণার শিকার হয়ে এক্স ও মিলেনিয়াল জেনারেশন শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ইন্ট্রেগ্রিটি ও মেরিটোক্রেসির ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ ধারণার হীরা ফেলে প্রগতিশীল-সাম্প্রদায়িক বাইনারির ট্যাগিং নির্ভর ধারণার কাচ হাতে তুলে নেওয়াকে স্মার্টনেস ভেবেছিলো। সংক্ষেপে ৮০ দশকের বৈশিষ্ট্য হলো- স্বৈরাচার এরশাদ কর্তিক বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেওয়া, শেখ হাসিনার আপোসকামিতা, বেগম খালেদা জিয়ার আপসহীন মনোভাব, তিন জোটের রূপরেখা, ও পরিশেষে ৯০ এর গণঅভ্যুত্থান।
৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের বিজয় ঘরে তুলে পরবর্তী প্রায় দুই দশকে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উন্নয়নশীল ও ইমার্জিং বাংলাদেশে রূপান্তরের পরিক্রমাকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতির ইতিহাসে স্বর্ণসময় বলা যায়। তর্কাতীতভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সফলতম অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বাংলাদেশ নামক লাইনচ্যুত ট্রেনকে শুধু উন্নয়নের ট্র্যাকে উঠিয়েই থেমে থাকেননি; উপরন্তু, গ্লোবালাইজেশনও লিবারালাইজেশন নামক উদ্দীপকের সাহায্যে উন্নয়নের গতি বাড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন।
কিন্তু, পরিহাসের বিষয় এই যে, রাজনৈতিক দলগুলোর নানা সীমাবদ্ধতা আর পারস্পরিক অবিশ্বাসের কারণে শূন্য দশকের শেষে আত্মস্বীকৃত বিদেশি চক্রান্ত ও সুশীল সমাজের অমার্জনীয় ব্যর্থতায় ইমার্জিং বাংলাদেশ নামক অসীম সম্ভাবনাময় দ্রুতগতির উন্নয়নমুখী ট্রেনটিকে টানেলে ঠেলে দেওয়া হয়। এরপর, তথাকথিত তাবৎ বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া হাউস ও সাংস্কৃতিক কর্মীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থনে গণতন্ত্র হত্যাকারী নব্য স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পরিণত হয় ফ্যাসিস্টে। শেখ হাসিনা ও তার অলিগার্ক দোসররা প্রথমে পরিবারের সকল সদস্যের জন্য উন্নত দেশে ফার্স্ট হোম নিশ্চিত করলো; এরপর, নিজ হাতে বাংলাদেশ নামক তাদের সেকেন্ড হোমকে জাহান্নামে রূপান্তর করলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনুকরণে।চৌর্যতন্ত্রের সকল উদাহরণকে লজ্জায় ডুবিয়ে পরবর্তী এক দশকে সমাজের সর্বস্তরে বৈষম্য অসহনীয় করে গণঅভ্যুত্থান অবশ্যম্ভাবী করলো।
আন্তর্জাতিক পরিম-লে সর্বজনের গ্রহণযোগ্য, মেধাবী, দেশপ্রেমিক ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টিশীল বাঙালি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে ৮৩৪ অমূল্য প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত ২য় স্বাধীনতার চেক আমানত হিসেবে তুলে দিয়ে এই ভূখ-ের আপামর জনগোষ্ঠীর সাথে আমিও আশায় বুক বেঁধেছিলাম। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা নোবেল পাওয়ারও বেশ আগে ‘পথের বাধা সরিয়ে দিন, মানুষকে এগুতে দিন’ শিরোনামের বক্তৃতার সংকলনে বাংলাদেশকে “গরিব দেশ” না বলে “মানবসম্পদ ব্যবহারে ব্যর্থ দেশ” হিসেবে বর্ণনা করে আমাদের করণীয়গুলোও পরিষ্কার করাতে চেয়েছেন।
তিনি সেখানে লিখেছিলেন, প্রত্যেক মানুষ সীমাহীন সম্ভাবনার আধার; জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং সুদক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষ যেন নিজের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে প্রকাশ করার সুযোগ পায়। অথচ, সেই তিনি রাষ্ট্র সংস্কারের ম্যান্ডেট পেয়ে শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ও মানবসম্পদ উন্নয়ন নামক উদ্দীপকের সাহায্যে বিশ্বমানের ইনোভেটিভ তরুণ সৃষ্টি করার কোনও উদ্যোগ নিলেন না। অতীতের মতোই স্পেশালাইজেশন, ডিভিশন অফ লেবার কিংবা ইফিসিয়েন্সিকে প্রাধান্য না দিয়েডানিং-ক্রুগার ইফেক্টে আক্রান্ত ব্যক্তিরাই কি বাংলাদেশের ভাগ্য বিধাতা হয়ে থাকবে?
মানবিক মূল্যবোধবিবর্জিত শিক্ষা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বলি হয়ে ‘নিজের ভালো পাগলেও বুঝে’ প্রবাদকে মিথ্যা প্রমাণিত করে স্টকহোম সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়ে ‘শেখ হাসিনাতেই আস্থা’রেখে যাবেকি একটি সম্মিলিত আত্মঘাতী প্রজন্ম? প্রধান উপদেষ্টা পারবেন কি বর্তমানের অসীম সুযোগকে ক্যাশ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উন্নত ও টেকসই বাংলাদেশ বিনির্মাণের সম্ভাবনার আলো জ্বালিয়ে রাখতে?
তর্কাতীতভাবে, সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম বড় স্ক্যাম হলো বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। এই স্বল্প পরিসরে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ব্ল্যাক বক্স খোলা সম্ভব নয়। ব্রিটিশ আমলের উত্তরাধিকার বয়ে নেওয়া বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যেনইম্পেরিয়ালিজমেরই নতুন এক নীল নকশা। স্বাধীনতার পরে অটো পাস আর অবাধ নকলনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা দিয়েপেছনে হাঁটার যে যাত্রা শুরু হয়েছিল গত দেড় দশকে তাকে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে ধ্বংসলীলার দ্বারপ্রান্তে। মানবসম্পদ উন্নয়নে বিশ্বের প্রায় সর্বনি¤œ; এমনকি, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনি¤œ ব্যয় করে জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকালের অযুত সম্ভাবনা দুপায়ে মাড়িয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনা জুমার প্রজন্মের সাথে ক্রমাগত বিদ্রুপ করে গিয়েছে।
প্রোজেক্ট আর লুটপাটকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষাক্রম নিয়ে একের পর এক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নকল প্রথার পুনঃপ্রচলন, প্রশ্ন ফাঁস, শিথিল মূল্যায়ন পদ্ধতি, এমনকি অটোপাস করিয়ে হলেও ৯০ শতাংশ জেন-জি প্রজন্মকে ন্যূনতম গ্রামের কলেজে ডিগ্রি অথবা উপজেলার কলেজে অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রী বানিয়ে ক্লাস রুমে আটকে রাখা হয়েছে। পরিণতিতে, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৪ কোটি ৫৯ লাখ কর্মহীন তরুণ ও যুবক রেখে, কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর ৮৫ শতাংশ কে অনানুষ্ঠানিক পেশায় রেখে, উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের উচ্চহার নিয়ে বাংলাদেশকে পর্যায়ক্রমে কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি ও আয়হীন কর্মসংস্থানের দেশে রূপান্তর করে হাসিনা পালিয়েছে দিল্লীতে।
২০১৯ সালে আমার সর্বশেষ প্রকাশিত মৌলিক গবেষণাটির সাইটেশন ১০০ ছুঁয়েছে। আন্তর্জাতিক মানদ-ে এটা সাধারণ অর্জন হলেও বাংলাদেশের মানদ-ে এটা গর্ব করার মতোই বিষয় কি-না তা জানতে একটি প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপকদের গুগল স্কলার প্রোফাইলে ঢু দিলাম। আমার মত মাত্র চার বছর ন; বরং, দুই-তিন দশক গবেষণা করা মাত্র ২/৩ জন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপকদের এই কীর্তি আছে।
বেশি আশ্চর্য হয়েছি এটা দেখে যে, মোট সাইটেশন বিচারে আমার চেয়ে বেশি সাইটেশন আছে মাত্র ৪/৫ জনের। অথচ, ক্যাডার সার্ভিসের সহকারী অধ্যাপক এই আমি বাংলাদেশের যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারলে ২০২০ সালে হতাম প্রফেসর। ডানিং-ক্রুগার ইফেক্টে আক্রান্ত বন্ধুর দ্বারা গ্লাস সিলিং বৈষম্যের এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে সহযোগী অধ্যাপক হতে পারলেও আমার প্রফেসর হয়ে অবসরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
অভিন্ন তীব্র প্রতিযোগিতার কয়েকটি ধাপ ও দীর্ঘ সময় (৩ বছর) মাড়িয়ে ২৭ তম বিসিএসের চূড়ান্ত রেজাল্টে আমার কোটাধারী বন্ধু বাদ পড়লেও পিএসসি আমাকে মেধা কোটায় আমার ৩য় পছন্দ সাধারণ শিক্ষায় (ক্রম-৯) সুপারিশ করেছিল। ১/১১ সরকার রেজাল্ট বাতিল করে পুনরায় ভাইভা নেয়। এবার, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে কোটা ব্যবহার করা আমার বন্ধু পুনরায় কোটার সুবিধা নিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশ পেলো; আর, আমি মেধা কোটায় একই সাধারণ শিক্ষায় (ক্রম-৫১) সুপারিশ পেয়েছিলাম।
অথচ, পরিহাস এই যে, গণিতের ভয়ে ৯ম শ্রেণিতে মানবিক বিভাগে স্থানান্তর হওয়া ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের ভর্তি বাতিল করে পরের সেশনে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাসের ছাত্র এবং পরিশেষে, ৩য় বারের মতো বিচারপতি খায়রুল কোটা ব্যবহার করে ২০২১ সালে ডিসি/শিক্ষা/স্বাস্থ্য/অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব বনে যাওয়া বন্ধুটি আমাকে বৈষম্যের চূড়ায় নিক্ষেপ করে আমাকে যেন পরিণত করেছে টানেল ইফেক্টের সহনশীলতা পরিমাপের গিনিপিগে।
বন্ধ টানেলের শেষের আলোকবিন্দুর মতো ইতিহাসের অন্যতম বড় সম্ভাবনাটি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টিশীল বাঙালি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাত ধরে মরীচিকায় মিলিয়ে গেলে বাংলাদেশ পরিণত হবে শুধু মিডিওকারদের দেশে। যে দেশে অতীতের মতোই পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব উপেক্ষা করে অন্ধ আনুগত্য আঁকড়ে ধরা স্টকহোম সিনড্রোমে আক্রান্ত মিডিওকারদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে সোশ্যাল ক্যাপিটাল আর ভাগ্যের জোরে দেশের সম্পদ ভোগ করে যাবে কিছু মিডিওকার।
আর, আন্তর্জাতিক মানদ-ে এবাভ-এভারেজ মানবসম্পদের একমাত্র স্বপ্ন হবে বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া। শিক্ষা খাতের ব্ল্যাক বক্স উপচে পড়া বৈষম্যের নমুনা ব্যবচ্ছেদ করে ‘হকার’ সাংবাদিক ময়ূখ রঞ্জনের মতো করে বলতে চাই, বাংলাদেশে শিক্ষা থাকবে না! থাকবে না ইনোভেশন! ম্যাক্সিমের ভাষায় কারণ বলে দিয়েছেন সম্প্রতি উপসচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত প্রশাসন ক্যাডারের আমলা, প্রিয় কবি, ইমতিয়াজ মাহমুদ, এভাবে, “এদেশ মানুষ হবে না, আজ বা কাল, মাকড়শা বুনে যাবে চক্রান্তের জাল।”
বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা), অর্থনীতির শিক্ষক ও গবেষক