বাংলাদেশ-ভারত-চীন : উত্তেজনার লাভ-ক্ষতি
মীর আব্দুল আলীম । সূত্র :দেশ রূপান্তর, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫

দক্ষিণ এশিয়া একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল অঞ্চলে হয়ে উঠেছে যেখানে বাংলাদেশ, ভারত এবং চীনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা বাড়ছে। যখনই সীমান্ত বা ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কের উত্তেজনা এক চরম স্তরে পৌঁছায়, তখন যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এই লেখায় ভারত, চীন এবং বাংলাদেশের মধ্যকার উত্তেজনা যদি যুদ্ধের পর্যায়ে পৌঁছায়, তাহলে কোন দেশ কী ধরনের লাভ ও ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে, তা বিশ্লেষণ করা হবে।
প্রেক্ষাপট : বর্তমানে ভারত এবং চীনের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা চলছে বিশেষত প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (খঅঈ) এলাকায়। ২০২০ সালের গালওয়ান সংঘর্ষের পর, দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের গতি কমে গেছে। একই সময়, বাংলাদেশ এবং ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে উত্তেজনা রয়েছে। বাংলাদেশ এই সীমান্ত ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন, যেহেতু এটি স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রায় সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। এই উত্তেজনা যদি যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যায়, তাহলে তিনটি দেশেরই বিপুল পরিমাণ লাভ-ক্ষতি হতে পারে।
ভারতের লাভ ও ক্ষতি
লাভ : যদি ভারত চীন বা বাংলাদেশকে সামরিকভাবে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়, তবে তা তাদের অঞ্চলের আধিপত্য নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে। ভারত, বিশেষ করে চীনকে মোকাবিলা করতে পারলে, তারা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী দেশ হিসেবে নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে পারবে।
সামরিক শিল্পে প্রবৃদ্ধি : যুদ্ধের পরিস্থিতি ভারতের সামরিক খাতের জন্য ইতিবাচক হতে পারে। ভারতের অস্ত্র শিল্প এবং প্রতিরক্ষা খাতে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি দেখা যেতে পারে, কারণ তাদের সামরিক সরঞ্জাম ও প্রযুক্তির চাহিদা বৃদ্ধি পাবে।
আন্তর্জাতিক সমর্থন : ভারতের স্ট্র্যাটেজিক অংশীদার যেমন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া (কোয়াড) তাদের সমর্থন দিতে পারে, যা ভারতকে কৌশলগতভাবে লাভজনক অবস্থানে রাখতে সাহায্য করবে।
মানবিক ক্ষতি : ভারত এবং চীনের মধ্যে যুদ্ধ হলে বহু সেনা ও সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। এই যুদ্ধ কেবল সীমান্ত অঞ্চলে নয়, পুরো দেশের জন্য বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
আর্থিক ক্ষতি : যুদ্ধের ফলে ভারতের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। বড় ধরনের সামরিক যুদ্ধ এবং তার অবকাঠামোগত ক্ষতির কারণে দেশটির অর্থনীতি বিপর্যস্ত হতে পারে।
অঞ্চলীয় অস্থিতিশীলতা : যুদ্ধ বাধলে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে। এই অস্থিতিশীলতা ভারতীয় ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বৈদেশিক নীতি কার্যক্রমকে প্রভাবিত করতে পারে।
চীনের লাভ ও ক্ষতি
লাভ : বিশ্বে সামরিক আধিপত্য বৃদ্ধি পবে। চীন যদি ভারতের বিরুদ্ধে সফলভাবে যুদ্ধ করে, তবে এটি তাদের সামরিক শক্তি প্রদর্শনের একটি বড় সুযোগ হতে পারে।
অর্থনৈতিক আধিপত্য : ভারতের বিরুদ্ধে বিজয় চীনের জন্য অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হতে পারে, বিশেষ করে ভারতের বাজারে নিজেদের ব্যবসা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে।
ক্ষতি : যদিও চীন সামরিক শক্তির দিক থেকে ভারতকে অতিক্রম করতে সক্ষম, তবে এটি তাদের জন্যও ব্যাপক মানবিক ও সামরিক ক্ষতি আনতে পারে।
আন্তর্জাতিক ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া : চীনের আক্রমণ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। বিশেষত, পশ্চিমের দেশগুলো চীনকে কঠোর সমালোচনা করবে এবং তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে।
অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া : যুদ্ধের কারণে চীনের অর্থনীতি ব্যাহত হতে পারে, বিশেষ করে বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হলে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটলে।
বাংলাদেশের লাভ ও ক্ষতি
কৌশলগত সুবিধা : বাংলাদেশ যদি ভারত ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়, তবে তারা নিজে কিছু কৌশলগত সুবিধা নিতে পারে। যেমন বাংলাদেশ চীন ও ভারতের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে পারলে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে।
বাণিজ্য সুযোগ : বাংলাদেশ যদি চীন বা ভারতের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখে, তবে তারা বাণিজ্যিক সুযোগে লাভবান হতে পারে। চীন এবং ভারতের মধ্যে যুদ্ধের ফলে বাণিজ্যিক সম্পর্কের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হলেও, বাংলাদেশ কিছু পণ্য ও সেবা বাজারে প্রবেশ করতে সক্ষম হতে পারে।
আঞ্চলিক নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিপদ : সীমান্তে উত্তেজনা এবং যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশে প্রচণ্ড নিরাপত্তা সংকট সৃষ্টি হবে। এটি রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
অর্থনৈতিক ক্ষতি : দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধের পরিস্থিতি বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে, যা দেশের অর্থনীতি এবং ব্যবসার জন্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনবে।
মানবিক সংকট : যুদ্ধের ফলে শরণার্থী সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে, যা মানবিক ও সামাজিক সংকট সৃষ্টি করবে। এখন ভারত, চীন ও বাংলাদেশের ক্ষমতা বিশ্লেষণ আলোচনা করা জরুরি। ভারত, চীন এবং বাংলাদেশ এই তিনটি দেশের সামরিক সক্ষমতা বিশ্লেষণ করা হলে, আমরা দেখতে পাবো যে, প্রতিটি দেশের বিভিন্ন ধরনের সামরিক প্রস্তুতি এবং শক্তির পরিসর রয়েছে। ভারত একটি বড় আকারের সামরিক শক্তি। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ হিসেবে, ভারতের সেনাবাহিনী বিপুল সংখ্যক সেনা, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র এবং যুদ্ধের কৌশলগত সক্ষমতার অধিকারী।
১. সেনাবাহিনী : ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ১৪ লাখের মতো সক্রিয় সদস্য রয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের সীমান্তে উচ্চ প্রস্তুতি বজায় রাখে এবং তীব্র উত্তেজনার সময় দ্রুত সেনা মোতায়েন করতে সক্ষম।
২. বিমানবাহিনী : ভারতের রয়েছে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম বিমানবাহিনী। যার প্রায় ৬৫০টি যুদ্ধবিমান এবং অত্যাধুনিক ফাইটার প্লেন রয়েছে, যেমন : সু-৩০ এমকেআই, রাফাল, মিরাজ ২০০০, এবং মিগ-২৯।
৩. নৌবাহিনী : ভারতের নৌবাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শক্তিশালী উপস্থিতি রয়েছে। প্রায় ১৫০টির মতো যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন এবং বিমানবাহী জাহাজের অধিকারী।
৪. পারমাণবিক শক্তি : ভারত একটি শক্তিশালী পারমাণবিক শক্তিধর দেশ, যার প্রায় ১৫০-১৬০টি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।
৫. কৌশলগত প্রস্তুতি : ভারতের রয়েছে বেশ কিছু আধুনিক কৌশল এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যেমন আধুনিক রাডার সিস্টেম, স্যাটেলাইট নজরদারি এবং সাইবার নিরাপত্তা কৌশল।
অন্যদিকে চীন সামরিক শক্তির দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে একটি।
১. সেনাবাহিনী : চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (চখঅ) পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনী, যার প্রায় ২০ লাখ সক্রিয় সদস্য রয়েছে।
২. বিমানবাহিনী : চীনের বিমানবাহিনী বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক এবং বৃহত্তমগুলোর একটি। এটি প্রায় ৩,০০০ যুদ্ধবিমান নিয়ে গঠিত, যার মধ্যে চীনের নিজস্ব তৈরি ঔ-২০ স্টেলথ ফাইটার, ঝঁ-৩০, ঔ-১০ এবং অন্যান্য যুদ্ধবিমান রয়েছে।
৩. নৌবাহিনী : চীনের রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নৌবাহিনী, যার ৩০০টিরও বেশি যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন এবং বিমানবাহী জাহাজ রয়েছে। চীনের সাবমেরিন এবং বিমানবাহী জাহাজের আধুনিক প্রযুক্তি অত্যন্ত উন্নত।
৪. পারমাণবিক শক্তি : চীন পারমাণবিক শক্তিধর দেশ, দেশটির প্রায় ৩০০টি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।
৫. কৌশলগত প্রস্তুতি : চীন আধুনিক রাডার, স্যাটেলাইট নজরদারি ব্যবস্থা, সাইবার যুদ্ধ কৌশল এবং বৃহত্তর যুদ্ধ কৌশল ব্যবহার করে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। বিশেষত, চীন বিভিন্ন ধরনের বৈদ্যুতিন যুদ্ধ কৌশল এবং অরবিটাল সিস্টেম ব্যবহার করে যুদ্ধক্ষেত্রে আগ্রাসন তৈরি করতে সক্ষম।
বাংলাদেশের সামরিক শক্তি এবং প্রস্তুতি : বাংলাদেশ, যদিও ভারত এবং চীনের মতো বৃহত্তর সামরিক শক্তির তুলনায় ছোট, তবে এটি একটি দক্ষ ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী এবং আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের কিছু অংশ রাখে। তবে বৃহত্তর শক্তির সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধের জন্য তার সীমিত সামরিক সক্ষমতা রয়েছে।
১. সেনাবাহিনী : বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রায় ২ লাখ সক্রিয় সদস্য এবং প্রায় ১ লাখ রিজার্ভ সেনা নিয়ে গঠিত। এটি সীমান্তে দ্রুত মোতায়েনের জন্য প্রশিক্ষিত এবং দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বজায় রাখতে সক্ষম।
২. বিমানবাহিনী : বাংলাদেশের বিমানবাহিনী তুলনামূলক ছোট, তবে এটি আধুনিক কিছু যুদ্ধবিমান যেমন- ঋ-৭, ঋ-১৬ এবং গরএ-২৯ নিয়ে গঠিত, যা সীমিত আক্রমণ এবং প্রতিরক্ষা সক্ষমতা প্রদান করে।
৩. নৌবাহিনী : বাংলাদেশের নৌবাহিনী ছোট এবং সীমিত আক্রমণ সক্ষমতা রাখে। এটি কয়েকটি ছোট যুদ্ধজাহাজ এবং সাবমেরিন নিয়ে গঠিত। তবে দক্ষিণ এশিয়ার সমুদ্রসীমা রক্ষার জন্য এটি যথেষ্ট সক্ষম।
৪. পারমাণবিক শক্তি : বাংলাদেশের কাছে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র নেই, তাই পারমাণবিক যুদ্ধের ক্ষেত্রে তার কোনো প্রতিরক্ষা ক্ষমতা নেই।
৫. কৌশলগত প্রস্তুতি : বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে সীমিত প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে এবং দেশের ভেতরে এবং সীমান্তে নিরাপত্তা বজায় রাখতে সক্ষম।
ভারত, চীন এবং বাংলাদেশের সামরিক শক্তি বিশ্লেষণ করলে, যুদ্ধের পরিস্থিতিতে চীন ও ভারতের সামরিক সক্ষমতা বিপুল। তাদের তুলনায়, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী সীমিত এবং শুধু আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং সীমান্ত রক্ষার জন্য উপযুক্ত।
উপসংহার : বাংলাদেশ, ভারত এবং চীন তিনটি দেশে যুদ্ধের পরিস্থিতি অত্যন্ত মারাত্মক হতে পারে এবং এর ফলাফল শুধু এসব দেশের জন্য নয়, বরং পুরো দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জন্য বিপর্যয়
ডেকে আনতে পারে। তবে যুদ্ধের পথে যাওয়ার আগে এই তিনটি দেশ কূটনৈতিক আলোচনা এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে মনোযোগী হলে, তারা অনেক ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে এবং একটি স্থিতিশীল দক্ষিণ এশিয়া গঠনে সহায়ক হবে।
লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক