কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক, জনপরিসরে উত্তেজনা তৈরি করা যাবে না

এম হুমায়ুন কবির । সূত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ২৭ জানুয়ারি ২০২৫

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক, জনপরিসরে উত্তেজনা তৈরি করা যাবে না

আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সীমান্তে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অশান্ত পরিস্থিতি কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের নানা উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডের জেরে সীমান্ত এলাকায় প্রায়ই চরম উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে। প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো ইস্যুতে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়াচ্ছে বিজিবি-বিএসএফ।

 

 

এমনকি দুই দেশের নাগরিকরাও এতে জড়িয়ে পড়ছে। যার সর্বশেষ নজির দেখা গেল চাঁপাইনবাবগঞ্জের চৌকা সীমান্তে। সেখানে দলবেঁধে ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে গাছ কাটার ঘটনায় রুখে দাঁড়ায় এলাকাবাসী। দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষের সময় টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও সাউন্ড গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটায় বিএসএফ। যার রেশ চলছেই। গত শনিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে এক বাংলাদেশি যুবকের আহত হওয়ার কথা জানা যায় গতকাল রবিবার প্রতিদিনের বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদনে। 

 


গত বছর জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। যা এখনও অব্যাহত। সাম্প্রতিককালে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে ভারতের পক্ষ থেকে সীমান্তের শূন্যরেখায় কাঁটাতারের বেড়া স্থাপনের কাজ শুরু করাকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার তৎপরতাকে ভালোভাবে দেখার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ব্যবস্থাপনাটা কীভাবে হবে।

 

 

 তা নিয়ে ১৯৭৫ সালেই দুদেশের মধ্যে ‘বর্ডার গাইডলাইনস’ বলে একটি স্বীকৃত ব্যবস্থা আছে। সেখানে পরিষ্কার করে বলা আছেÑ সীমান্তরেখার ১৫০ গজের মধ্যে কোনো দিকেই কেউ এমন কোনো স্থাপনা করবে না, যাতে সীমান্তের এ অঞ্চলটার নিরাপত্তায় কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। কাজেই তারা ২০১০ সালের যে অ্যাগ্রিমেন্টের কথা বলছে, তাতে সীমান্তের ওপর বেড়া বা কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের কোনো অধিকার দেওয়া হয়েছে কি নাÑ তা আমার জানা নেই। আমি জানি যেÑ দুদেশের মধ্যে ১৯৭৫ সালের বর্ডার গাইডলাইনস অনুযায়ী সীমান্ত ব্যবস্থাপনার কাজটা সম্পন্ন হয়।

 

 

এখন দুটো জিনিস আমার কাছে মনে হয়েছে। একটা হচ্ছেÑ ভারতের দিক থেকে সরকারি পর্যায় থেকে এটি নতুন করে একধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি বা জটিলতা তৈরির একটা প্রয়াস বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। কারণ তারাও জানে, সীমান্তে বেড়া দিতে গেলে বাংলাদেশ প্রতিবাদ করবে এবং যেটি ইতোমধ্যে করাও হয়েছে, যে কারণে তা থামল এ মুহূর্তে। আরেকটা বিষয় হচ্ছেÑ এমনিতেই আমরা জানি যেÑ বাংলাদেশে একটা বড় পরিবর্তন ঘটেছে ৫ আগস্ট এবং এ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে একটা নতুন জাগরণ, আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটটা ভারতের জন্য আপাতদৃষ্টিতে ভিন্ন। এখন বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশাটা ধরেই দুদেশের মধ্যে সম্পর্কটা চালিয়ে যেতে হবে।

 

 

সীমান্তকে কেন্দ্র করে দুদেশের সম্পর্কের যে টানাপড়েনটা দেখছি আমরা, সেটা দুই দিকের বৃহত্তর বোঝাপড়ার ঘাটতির জায়গাটাই কিন্তু স্পষ্ট করে তুলছে। কারণ গত ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যে আত্মমর্যাদাবোধ তৈরি হয়েছে, এটা যেকোনো জাতির জন্যই হতে পারে এবং আমাদের জন্য তা ইতিবাচক বলেই আমরা ধরে নিচ্ছি। এখন ভারতের নিকট-প্রতিবেশী হিসেবে যেহেতু তাদের সঙ্গে আমাদের বহুমাত্রিক সম্পর্ক আছে, তাদের কিন্তু এ পরিবর্তনটা উপলব্ধি করতে হবে।

 

 

কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে, এখন পর্যন্ত ভারতের দিক থেকে এ উপলব্ধির জায়গাটা সঠিকভাবে অনুভূত হচ্ছে না। ভারতের দিক থেকেও কিন্তু বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ড, অতিরঞ্জন প্রচারণার মতো ঘটনাগুলো ঘটছে। সেটা ভারত সরকারের একটি অংশ থেকে হচ্ছে, তাদের রাজনৈতিক দলগুলোর একাংশের দিক থেকে হচ্ছে, মিডিয়া জগতে হচ্ছে, জনগণের পর্যায়ে হচ্ছে এবং এখানে যেটি বিপজ্জনক বিষয়, সেটা হচ্ছেÑ আগে পররাষ্ট্রনীতি বা সম্পর্কের বিষয়টা সরকারি পর্যায়ে অথবা যারা সম্পৃক্ত আছেন, তাদের পর্যায়ে সম্পন্ন হতো; এখন কিন্তু দুদেশের জনগণের মধ্যে সংশ্লিষ্ট হয়ে গেল, যেটা আমরা সম্প্রতি বর্ডারে দেখলাম।

 

 

সমস্যা সমাধানে দুই পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সজাগ থাকতে হবে পরিস্থিতিটা যেন কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়। দুই দেশের মধ্যে যেসব সমস্যা আছে, কূটনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে। বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয়তার আলোকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জনপরিসরে উত্তেজনা তৈরি করা যাবে না সাম্প্রতিক পরিস্থিতিকে সহনীয় পর্যায় নিয়ে আসার সুযোগ তো রয়েছেই, সীমান্ত সম্পর্কে যেকোনো চুক্তিতেই একটা প্রভিশন থাকে অর্থাৎ দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে এটা সংশোধন কিংবা বাতিলের সুযোগ থাকে। কাজেই ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যে চুক্তিগুলো আছে, সেখানে এ বিষয়টা আছে বলে আমি ধরে নিচ্ছি।

 

 

তো সেই প্রেক্ষাপট থেকে বাংলাদেশের দিক থেকে যখন আমরা মনে করছি ভারতের কোনো একটা অবস্থান সঠিক নয় এবং তারা যদি সেখানে কোনো দলিলের ভিত্তিতে বা চুক্তির ভিত্তিতে বক্তব্য দিতে আসে, আমরা নিশ্চয়ই সংশোধনীর জন্য প্রস্তাব করতে পারি। আমার ধারণা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সে বিষয়টা উল্লেখ করেছেন এবং তিনি এটাও উল্লেখ করেছেনÑ আগামী মাসে বিজিবি ও বিএসএফ আলোচনায় বসবে, তখন এটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতে পারে।

 

 

আমি মনে করি, এখন যে সীমান্তের ওপরে বেড়া দেওয়া হচ্ছে, এতে করে জটিলতা বৃদ্ধি ছাড়া আর কিছু হবে না। এ ছাড়া বড় যে প্রশ্নটি রয়েছে, তা হলোÑ আপনি যদি আমাকে বন্ধুদেশ বলে মনে করেন বা আমার সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে চান, তাহলে আপনি আমার ঘরের সামনে এসে কাঁটাতারের বেড়া দিলে কি তা সম্পর্কের জন্য সহায়ক হবে, না বিপক্ষে যাবে? এটা তাদেরও উপলব্ধ হওয়া উচিত বলে মনে করি।

 

 

এখানে সীমান্ত অঞ্চলে একটা পারস্পরিকতা আছে। যেমন ভারতের দিক থেকে আগরতলা বলুন কিংবা পশ্চিমবঙ্গের কথাই বলুন, সেখানে ভারতীয় ব্যবসায়ীরাও কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষ যাতায়াত না করার কারণে, সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক গতিতে না চলার কারণে। কাজেই আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখন একে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসতে হলে দুই দেশের চলাচলের সুযোগটা তৈরি করতে হবে অর্থাৎ ভিসাপ্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক করতে হবে।

 

 

এটি যদি স্বাভাবিক না হয় এবং আপনি যদি বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার কখন আসবেÑ এজন্য অপেক্ষা করতে চান, তাদের পক্ষ থেকে এ ধরনের বক্তব্য এলে আমি মনে করি, তা সঠিক দিকনির্দেশনা দিচ্ছে না। আপনি যখন এ কথাটা বলছেন, তার মানে হচ্ছে, আপনি পরোক্ষভাবে বলে দিচ্ছেন, এখন যারা আছেন, তাদের সঙ্গে আমরা স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে আগ্রহী নই। আমার মনে হয় এ জায়গাটায় আরেকটু স্বাভাবিক চিন্তার সুযোগ আছে। সেক্ষেত্রে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আমাদের জায়গা থেকে কয়েক দিন আগেই পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে আলোচনা হয়ে গেল, আমাদের দিক থেকে যে বক্তব্য দেওয়া দরকার, সেগুলো আমরা বলেছি।

 

 

আমাদের প্রধান উপদেষ্টা নিজেই বলেছেন, আমরা আত্মমর্যাদা ও সমতার ভিত্তিতে সম্পর্কটা চাই। এটা হচ্ছে তাত্ত্বিক কথা আর বাস্তব অর্থে বলতে গেলেÑ ভিসাপ্রক্রিয়াটা স্বাভাবিক করা প্রয়োজন, দুদেশের মধ্যে যোগাযোগটা স্বাভাবিক করা দরকার। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রক্রিয়াটা যাতে স্বাভাবিক পর্যায়ে আসে, এজন্য তাদের পক্ষ থেকেই মূল উদ্যোগটা নেওয়া দরকার, আমরাও সেটাকে স্বাগত জানাব। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের চলমান উত্তেজনা নিরসনের লক্ষ্যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে একটি জোরালো ও স্পষ্ট বার্তা দেওয়া জরুরি। একই সঙ্গে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় বাসিন্দাদের শান্ত রাখার বিষয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

 

 

 

প্রতিবেশী দুই দেশের সীমান্ত নিয়ে সৃষ্ট চলমান সংকটে এই মুহূর্তে সমস্যা নিরসনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে স্পষ্টভাবেই বার্তা দিতে হবে। বলতে হবেÑ তোমরা দুই দেশের যৌথ সীমান্তে যে উদ্যোগ নিয়েছ তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এর মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে। যেকোনো সময় একটা বিপদ সৃষ্টি হতে পারে, যা কারও জন্যই গ্রহণযোগ্য নয়। এজন্য এই কাজ থেকে তোমরা বিরত থাকো। এটা ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে স্পষ্ট করে দেওয়া দরকার।

 

এ ছাড়া তাদের আরও বলে দিতে হবেÑ এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে আমরা তা প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত রয়েছি। অপ্রয়োজনীয় কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তারা যেন বিষয়টি উপলব্ধি করে সেটা তাদের জানিয়ে দিতে হবে। সেই সঙ্গে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তুলতে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করাও জরুরি। 

 

 

দুই দেশের সম্পর্ক তো বহুমাত্রিক ও বহুমুখী। সেই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই বড় প্রতিবেশী হিসেবে ভারতকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সমস্যা হলোÑ এখনও তারা সেটি মানতে পারছে না। ৫ আগস্টের পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েনের কারণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতা তারা মানতে পারেনি। এজন্য নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে। আমি মনে করি, সমস্যা সমাধানে দুই পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সজাগ থাকতে হবে পরিস্থিতিটা যেন কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়। দুই দেশের মধ্যে যেসব সমস্যা আছে, কূটনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে। বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয়তার আলোকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জনপরিসরে উত্তেজনা তৈরি করা যাবে না। 

 

 

কূটনীতি-রাজনীতি বিশ্লেষক। যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত