বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপড়েন
ভারতের সঙ্গে চীনের সীমান্ত দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ৪৮৮ কিলোমিটার, পাকিস্তানের ৩ হাজার ৩১০ কিলোমিটার এবং বাংলাদেশের ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার। প্রতিবেশী হিসেবে ভারত ও বাংলাদেশ দীর্ঘ সীমান্তরেখা বজায় রাখছে। এসব ভারতের হিসাব। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য হিসাবটা অন্যরকম। বাংলাদেশের জন্য তার একমাত্র প্রতিবেশী ভারত। কেননা প্রায় তিন দিক থেকে বাংলাদেশ মূলত ভারত দ্বারা বেষ্টিত। চতুর্থ দিকটিতে সমুদ্র। একটুখানি ফাঁক গলে একদিকে মিয়ানমার বাংলাদেশের অন্য প্রতিবেশী। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের প্রায় পুরোটাই ভারত কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে। তবে ভারত তার দুই প্রতিবেশী বাংলাদেশ এবং নেপালের জন্য জারি করে রেখেছে ‘উন্মুক্ত সীমান্ত’ নীতি। সীমান্ত উন্মুক্ত থাকায় দুদেশের মধ্যে পণ্য আদান-প্রদান এবং মানুষের যাতায়াতে একটি সহজ পদ্ধতি কার্যকর আছে। ভারতের কাছাকাছি অবস্থানে যেসব দেশ বেশ গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান, মিয়ানমার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে এ দেশগুলোর কোনোটাই ভারতের কাছে গুরুত্বের বিচারে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং চীনের কাছাকাছি যায় না।

ভারতের বর্তমান সরকার একটি সেøাগান ব্যবহার করে- ‘প্রতিবেশীকে অগ্রাধিকার’। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সর্বশেষ সরকারি সফরে যান ভুটান-২০২৪, নেপাল-২০২২, বাংলাদেশ-২০২১, মালদ্বীপ-২০১৯, শ্রীলঙ্কা-২০১৯, আফগানিস্তান-২০১৬ এবং পাকিস্তান-২০১৫ সালে। নরেন্দ্র মোদি গত ১০ বছরে ৫ বার নেপাল, তিনবার করে ভুটান ও শ্রীলঙ্কা, দুবার করে বাংলাদেশ, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তান এবং একবার সফর করেছেন পাকিস্তান। নরেন্দ্র মোদি তার শাসনকালে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫ বার চীন সফর করেন এবং ২০১৮ সালের পর থেকে একবারও চীন সফর করেননি। তিনি দুবার মিয়ানমার এবং একবার মরিশাস সফরও করেন। ২০১৬ সালে ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের ইসলামাবাদে। কিন্তু ভারতসহ আরো ৪টি দেশ পাকিস্তানের সেই সম্মেলন বয়কট করেছিল। তারপর থেকে সার্কের আর কোনো শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। সবকিছু মিলিয়ে বিশ্বের এক নম্বর জনসংখ্যার দেশ ভারত তার প্রতিবেশী দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে প্রভাব ধরে রাখতে সমর্থ হচ্ছে না। বাংলাদেশেও তাদের অস্তিত্ব লেজে-গোবরে অবস্থায়। নরেন্দ্র মোদিকে প্রায়ই ভারতকে বিশ্ব পরিস্থিতিতে ‘পিস ব্রোকার’ হিসেবে তুলে ধরতে বেশ সক্রিয় দেখা গেলেও তাকে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বিশেষ করে সবচেয়ে কাছের এবং দীর্ঘ সীমান্তের প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মেরামতের ব্যাপারে খুব একটা সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না। জি-২০, জাতিসংঘের সম্মেলন, কোয়াড এসব নিয়ে মাথা ঘামালেও সার্ক নিয়ে তার মাথা ঘামানোর কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়নি। ফলে সরকারের অগ্রাধিকার প্রশ্নে তার প্রতিবেশীরা একটু ছিটকেই পড়েছে।
গুগল নিউজে ভোরের কাগজের খবর পড়তে ফলো করুন
এই আবর্তে বাংলাদেশের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান এবং ঢাকা ছেড়ে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় দুদেশের সম্পর্কে টানাপড়েনের পরিস্থিতি উপহার দিয়েছে। নরেন্দ্র মোদির সরকার তখন থেকে নিশ্চিত করে আসছে, শেখ হাসিনা ভারতেই আছেন। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে তারা অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের টানাপড়েনে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন- আপাতত আমরা আশা করি, ভারত শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা উসকে দিতে দেবে না। শেখ হাসিনার উদ্ধৃতি হিসেবে উল্লেখ করা বিতর্কিত মন্তব্যের ভিত্তিতে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন- বাংলাদেশ তাকে ফেরত না চাওয়া পর্যন্ত চুপ থাকতে হবে।
নিজ দেশ থেকে পালানো আঞ্চলিক নেতাদের আশ্রয় দেয়ার ইতিহাস ভারতের নতুন নয়। ১৯৫৯ সালে চীন থেকে পালিয়ে আসা তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাইলামাকে ভারত আজো আশ্রয় দিয়ে আছে। ১৯৭৫ সালের পর শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা কয়েক বছর ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আফগান নেতা মোহাম্মদ নজিবুল্লার পরিবার ১৯৯২ সালে আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতে। ১৯৯৬ সালে নজিবুল্লাহকে আফগানিস্তানে তালেবান হত্যা করলেও তার স্ত্রী-সন্তানরা এখনো ভারতের আশ্রয়ে আছেন। এবার শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেয়ার সিদ্ধান্তের ফলে নরেন্দ্র মোদির সরকারের রাজনৈতিক সুবিধা এবং অসুবিধা দুটোই আছে। সুবিধা হলো, ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে শেখ হাসিনার ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। ভারতে তাকে ইসলামপন্থি চরমপন্থার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ হিসেবে গণ্য করা হয়। অধিকাংশ ভারতীয়ের মতে, বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থায় একটি পরিবর্তন হয়েছে সেই দেশটির সমর্থনে যে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের পরিবর্তে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল। এসব ভারতের মোদি সরকারের জন্য হাসিনা-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে প্রভাবিত করেছে। অন্যদিকে শেখ হাসিনার কথা ভাবতে গিয়ে ভারত বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আগ্রহ দেখাতে সমর্থ হচ্ছে না এবং বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভারতবিরোধী একটি মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘে নরেন্দ্র মোদি-ইউনূস দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হওয়ার যে একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, ভারত সেই সুযোগটি কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের স্থিতিশীলতার স্বার্থে দুদেশের কূটনীতিক এবং নীতি-নির্ধারকদের পারস্পরিক সম্পর্ক অনেক বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু শেখ হাসিনা ভারতে থাকাতে দুদেশের মধ্যে একটি নিবিড় আলাপ-আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত হতে পারছে না বলেই মনে হচ্ছে। ভারতের পক্ষ থেকে তেমন একটা প্রচেষ্টার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ও ভারত উভয়কেই গুরুত্ব সহকারে বুঝতে হবে, পারস্পরিক সৌহার্দপূর্ণ একটি সম্পর্ক দুদেশের স্থিতিশীল একটি পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যই প্রয়োজন। যেহেতু দেশ দুটি তিন দিক দিয়ে একে অপরের প্রতিবেশী, তাই একে অপরের সিকিউরিটি বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেয়ার কোনো সুযোগই নেই। বৈরিতার পথে কোনো লাভেরও সম্ভাবনা নেই কোনো দেশেরই। দুই দেশকেই বুঝতে হবে, দুই প্রতিবেশীর স্বতন্ত্র সম্পর্কের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। উভয়ের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যই দুদেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ অবস্থানের কোনো বিকল্প নেই; কিছু বাস্তব এবং ঐতিহাসিক সত্যকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ারও সুযোগ নেই। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ঐতিহাসিক ভূমিকা, চীন, মিয়ানমার কিংবা পাকিস্তানের তুলনায় ভারত ও বাংলাদেশের ভৌগোলিক নৈকট্য, ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে ঢাকার নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্যের সুযোগ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষেত্রে দুদেশের ক্রমবর্ধমান সহযোগিতা, দুদেশের স্থলসীমা চুক্তির মাধ্যমে ছিটমহল বিনিময়, দ্বিপক্ষীয় স্তরে সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপন, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বৃদ্ধি এবং দুদেশের উপকূলে পরস্পরের জাহাজ চলাচলের বিষয়ে সমঝোতা ইত্যাদি।
দ্বিপক্ষীয় কিছু অপ্রাপ্তির জায়গাও আছে, যা দুদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে। দিল্লি ও ঢাকার সুসম্পর্ক সত্ত্বেও তিস্তাসহ অন্তত ৫৪টি নদীর পানিবণ্টনের বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত। বাংলাদেশ ও ভারতের বর্তমান সরকারপ্রধানের এই উপলব্ধি আসা উচিত যে, কূটনৈতিক সম্পর্কে শুধু স্মৃতির সরণি বেয়ে অতীতের কৃতকর্মের প্রতিদান সন্ধান করা নিরর্থক। রাজনীতিতে আবেগ থাকবে, সমাজজীবনে নানা আবেগের বহিঃপ্রকাশও ঘটবে- কিন্তু কূটনৈতিক বিচারে ভারত ও বাংলাদেশকে সমকালীন বিশ্ব রাজনীতিকে মূল্য দিতে হবে, সমাজ ও অর্থনীতির বাস্তবতাকে চিহ্নিত করতে হবে, আঞ্চলিক ও ভূখণ্ডনীয় ভূরাজনীতির রূপরেখাকে অনুধাবন করতে হবে দুদেশের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণে। সমাজ ও রাজনীতিকে বহুগামী এবং বহুমাত্রিক না করে একমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যে দেশ এগিয়ে নিতে চাইবে, শেষ বিকালে পরাজয় তাদেরই হবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং মিডিয়া বারবার বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার অধ্যায়টি পাশ কাটিয়ে গিয়েছে। ফলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কটি বর্তমানে একটি গ্রে এলাকায় থমকে আছে। বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই উভয় দেশের দায়িত্বশীল মহলকে বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ক উন্নয়ন কোনো একটি দেশের পক্ষ-বিপক্ষের বিষয় নয়; বিষয়টি উভয় দেশের স্বার্থের একেবারেই কেন্দ্রবিন্দুর বিষয়। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে নিজ দেশের স্বার্থের কারণেই। ভারতের যেমন তার সেভেন সিস্টারের নিরাপত্তাজনিত বিষয় আছে, তেমনি বাংলাদেশেরও চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা এবং মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয় আছে। বাংলাদেশের ইলিশ যেমন ভারতে রপ্তানি করলে পশ্চিমবঙ্গের লোক খুশি হয়, তেমনি ভারতের ডিম-আলু-পেঁয়াজও বাংলাদেশের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। দুই প্রতিবেশী দেশের স্বার্থটা একান্তই পারস্পরিক ও সৌহার্দপূর্ণ।
সুধীর সাহা : কলাম লেখক।