বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও সম্ভাবনা
বিগত ১৬ বছর ধরে দেশে কোনো নির্বাচন ছিল না। নির্বাচন নামে প্রহসন করেছে হাসিনা সরকার। দেশে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে জনগণ। ৫ আগস্ট ২৪ বিপ্লবের পর মানুষ নতুন করে স্বাধীনতা পেয়েছে। কথা বলার অধিকার পেয়েছে। আশা করা যায় শিগগিরই ভোটের অধিকার ফিরে পাবে। যে জন্য হাজার হাজার শিশু-কিশোর তখন প্রাণ দিয়েছে। স্বৈরাচারমুক্ত দেশ হয়েছে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন ছিল সরকারের স্থিতিশীলতা নীতি ধারাবাহিকতা নিয়ে। নির্বাচিত সরকার ছাড়া বিনিয়োগকারীরা আস্থা ফিরে পান না। আস্থার জন্য, বিনিয়োগের জন্য নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন। আমরা আশা করছি, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়ে সরকার গঠনে বর্তমান সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। যার ফলশ্রুতিতে বিগত বিনিয়োগ সম্মেলনের ফসল আমরা ঘরে তুলতে পারব-আবুল কাসেম হায়দার। সূত্র : নয়া দিগন্ত, ১৭ এপ্রিল ২০২৫
‘বাংলাদেশে ব্যবসায় নিয়ে আসুন এবং এর মাধ্যমে বিশ্বকে বদলে দিতে ভূমিকা রাখুন।’ কথাগুলো বলেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ‘বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন-২০২৫ এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এই আহ্বান জানান তিনি। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এই সম্মেলনের আয়োজন করে।
সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যা বিশ্বকে বদলে দিতে অভিনব সব ধারণা রয়েছে। এ সব ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। তাই আমরা আপনাদের আমন্ত্রণ জানাই, যেন আপনারা শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বকেই বদলে দেয়ার যাত্রায় যুক্ত হন। তিনি বলেন, আপনি যদি কোনো লক্ষ্য নিয়ে ব্যবসায় করতে চান, তাহলে বাংলাদেশই আপনার সেই জায়গা। বাংলাদেশ করে দেখায়, যা একবার কেউ শুরু করলে অন্যরাও তার অনুসরণ করে।’
ব্যবসার মাধ্যমে সুখী হওয়া
মানুষ সুখী হতে চায়। সুখ পাওয়ার জন্য মানুষ দেশে অবিরত চেষ্টা করে যাচ্ছে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, টাকা উপার্জন করে মানুষ নিঃসন্দেহে আনন্দ বা সুখ পায়, কিন্তু অন্যকে সুখী করার মধ্যে অতিরিক্ত আনন্দ বা সুখ নিহিত রয়েছে। তিনি বলেন, যদি আপনি বাংলাদেশে ব্যবসায় করেন, তাহলে আপনি সুখ এবং অতিরিক্ত আনন্দ দুটোই পাবেন। কোনো খরচ ছাড়াই আপনি এই অতিরিক্ত আনন্দ লাভ করতে পারেন।
বিনিয়োগকারীরা কী জানতে চান
বিনিয়োগ সামিটে ৫০টি দেশের ৫৫০ জনের বেশি বিনিয়োগকারী অংশ নেন। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, বিনিয়োগ সম্মেলনে আসা বিদেশী বিনিয়োগকারীরা দুইটি বিষয়ে বেশি জানতে চাচ্ছেন। তারা বাংলাদেশে ব্যবসায় করলে সরকার কী সুবিধা দেবে, সেটি জিজ্ঞাসা করছেন। মূলত লাল ফিতার দৌরাত্ম্য কমাতে কী কী পদক্ষেপ নেয়া হবে, সেটি তাদের জানার মূল বিষয়। একই সাথে বাংলাদেশে ব্যবসায় করা প্রতিষ্ঠানগুলোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়, সেটিও বিদেশী বিনিয়োগকারীরা জানতে চান।
বিনিয়োগ ও রাজনৈতিক দল
চার দিনের এই সামিটে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা নানা প্রশ্নের জবাব চান। সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে উক্ত সামিটে নিমন্ত্রণ করে এবং দেশের বিনিয়োগ নিয়ে তাদের মতামত প্রদানের সুযোগ করে দেয়। এটি একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন। বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপি প্রতিনিধিদের সাথে বিনিয়োগকারীরা আলাপ করেন এবং তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে চান।
বিএনপি প্রতিনিধি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপি বর্তমান সরকারের নীতি ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে। যেটি বিনিয়োগকারীদের বড় প্রশ্নের উত্তর অর্থাৎ নীতির কোনো পরিবর্তন হবে না। বিনিয়োগকারীদের কোনো সুযোগ সুবিধা কমবে না বরং সম্ভব হলে বাড়ানো হবে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের এখন বিনিয়োগ জিডিপির শূন্য দশমিক ৪২ শতাংশ আমাদের লক্ষ্য এটিকে ২ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করা।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, অর্থনীতিতে যে অনৈতিকতা চলছে, ‘আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা ক্ষমতায় যেতে পারলে অর্থনীতিতে সামাজিক বৈষম্যহীন, সামঞ্জস্যপূর্ণ ও দুর্নীতিমুক্ত একটি টেকসই অর্থনীতি প্রদান করব।’
বিনিয়োগ সম্মেলনের লক্ষ্য
৭ এপ্রিল ২০২৫ বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন কাজ শুরু হয়েছিল। চার দিনের এই শীর্ষ সম্মেলনে দেশের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগের সুযোগ ও অর্থনৈতিক সংস্কার তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনা, জুলাই ২৪ বিপ্লবের পর সংঘটিত অর্থনৈতিক সংস্কারকে তুলে ধরা এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের পাইপলাইন তৈরির লক্ষ্যে এই শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশে বিনিয়োগে বাধা
‘কান্ট্রি প্রাইভেট সেক্টর ডায়াগনস্টিক’ শিরোনামে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) বাংলাদেশে বিনিয়োগে এখন পাঁচটি বড় বাধা রয়েছে বলে উল্লেখ করে। বাধাগুলো হচ্ছে : ১) বিদ্যুৎ সমস্যা ২) অর্থায়নে সীমিত সুযোগ ৩) দুর্নীতি ৪) অনানুষ্ঠানিক খাতের আধিক্য এবং ৫) উচ্চ কর হার। তবে এই পাঁচটি বাধা ছাড়াও আরো কয়েকটি বাধা রয়েছে। তা হচ্ছে ৬) দেশে সুশাসনের অভাব ৭) নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন।
দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হলে উল্লিখিত বাধাগুলো দূর করতে হবে। বিগত সরকার উন্নয়নের জন্য অনেক প্রকল্প ও পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কিছু কিছু উন্নয়নমূলক কাজও হয়েছে। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী করা সম্ভব হয় নাই। তবে কাজের চেয়ে বেশি হয়েছে দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থ পাচার। তাই আমাদের ঋণের বোঝা বেড়েছে অনেক গুণ। কিন্তু সেই অনুযায়ী উন্নয়ন দৃশ্যমান নয়।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত
দেশের শিল্পায়ন ও বিনিয়োগের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রধানতম বিষয়। প্রয়োজনমতো বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি না হলে কোনো শিল্প স্থাপন করা যায় না। সঠিকভাবে উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। বিগত সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অনেক প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। তাদের ঘোষিত ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বর্তমানে ৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া কষ্ট হচ্ছে। দেশের বর্তমান বিদ্যুতের চাহিদা ১২ হাজার মেগাওয়াট বলা যায়। অসম চুক্তি, দুর্নীতি ও অতি বেশি বিনিয়োগ দেখিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি দেখানো হয়েছে।
জ¦ালানি খাতের অন্য বড় অংশ গ্যাস খাত। দেশের বৃহৎ শিল্প গ্যাসভিত্তিক। গ্যাস আবিষ্কার ও উৎপাদনে বিগত সরকার যত্নশীল কম ছিলেন। তাই দেশে গ্যাস উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। পরিকল্পিতভাবে পেট্রোবাংলাকে নিয়ে গ্যাস আবিষ্কার ও উত্তোলনের পদক্ষেপ নিতে হবে। গভীর সমুদ্রে গ্যাস আবিষ্কার ও উত্তোলনের জন্য জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন। দেশে গ্যাস উত্তোলন বাড়াতে পারলে আমদানি কমে যাবে। দেশ শিল্পায়নে দ্রুত এগিয়ে যাবে। বিনিয়োগের স্বার্থে শিল্পখাতে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা কোনোক্রমে উচিত হবে না।
অর্থায়নে সীমিত সুযোগ
অর্থ ছাড়া কোনো শিল্প স্থাপন করা যায় না। অর্থ আসে ব্যাংক থেকে ও বিদেশী বিনিয়োগ থেকে। বিগত সরকার দেশের ব্যাংকিং ও অ-আর্থিক ব্যবস্থা একেবারে ধ্বংস করে ফেলেছে। সব ব্যাংক থেকে অর্থ লুট করে নামে-বেনামে বিদেশে পাচার করেছে। তাই আজ দেশের ১০ থেকে ১২টি ব্যাংক ধ্বংসের মুখে। বর্তমান সরকার ব্যাংকিং খাতের সংস্কার শুরু করেছেন। কিছু কাজও হচ্ছে। কিছু কিছু ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। সরকারকে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের সুশাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। অর্থ লুটকারীদের বিচার করতে হবে। পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে হবে। চেষ্টা চলছে আশা করি সুফল পাবো।
দুর্নীতি
দুর্নীতির মহাসাগরে নিমজ্জিত আমাদের বাংলাদেশ। দুর্নীতি শুরু হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর অর্থাৎ ১৯৭১ সাল থেকে। দুর্নীতিতে নেই এমন কোনো বিভাগ বা মন্ত্রণালয় পাবেন না। দুর্নীতি করে না এমন লোকও খুঁজে পাওয়া বড় কঠিন। বাংলাদেশে শিল্প স্থাপনের কাজটি শুরু করতে হয় একটি ট্রেড লাইসেন্স নেয়ার মাধ্যমে। এরপর ৩২টি দফতর থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। এই এক বিড়ম্বনা। দেশে বিগত ১৬ বছর ধরে দুর্নীতির মহাউৎসব চলছে। প্রতিটি প্রকল্পে দুর্নীতি, অনিয়ম চলছে। ঋণও চলেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। নিজেরা সবাই স্বচ্ছ। দুর্নীতিমুক্ত। কিন্তু দেশের সব স্তরে সব আমলা বিগত দুর্নীতির সাগরে ডুবে ছিলেন। এখন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। নতুন প্রজন্ম ৫ আগস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন আমাদের দেখিয়েছে।
অনানুষ্ঠানিক খাতের আধিক্য
উৎপাদনমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের চেয়ে দেশে অনানুষ্ঠানিক বিনিয়োগ বেড়েছে। তাতে মৌলিক কর্মসংস্থান কম হচ্ছে। সুশাসনের অভাবে দেশে দেশী-বিদেশী শিল্প খাতে বিনিয়োগ কম এসেছে।
উচ্চ কর হার
বর্তমান সরকার সংস্কার কাজ শুরু করেছেন। কিছু কিছু কাজ হচ্ছে। বেশকিছু ব্যাংকের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। সুদের হার বৃদ্ধি হয়েছে ১২ থেকে ১৮ শতাংশে। ব্যাংক ছাড়া আর্থিক খাতের সুদের হার ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ। এই উচ্চ কর হারে দেশে বিনিয়োগ কঠিন হয়ে পড়েছে। বিনিয়োগকারীরা এই অধিক সুদ হারে বিনিয়োগে উৎসাহিত নয়। বর্তমান বিনিয়োগ সামিটে বেশকিছু বিনিয়োগ এসেছে। আমরা আশাবাদী। দেশের রাজনৈতিক সংস্কার ও উন্নতির পর বিনিয়োগ আসবে। সুদের হার কমিয়ে আনতে হবে। সুদের হার পূর্বের মতো ৯ শতাংশে আনতে হবে।
আইনের শাসনে উন্নয়ন
বিগত সরকারের আমলে আইনের শাসন ছিল না। কোনো আইন সঠিকভাবে কার্যকর ছিল না। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতিতে আইনের শাসন ছিল না। বিগত সরকার আইন করতেন। আইনের জন্য নয়, নিজের জন্য আইন। সুশাসন বলতে কিছু ছিল না। আইনের অভাবে দেশে একটা অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সুশাসন ছাড়া দেশী বিদেশী বিনিয়োগ হবে না। বিনিয়োগ আসবে না। আমরা আশা করছি বর্তমান সরকার আইনের সুশাসন সর্বত্র কায়েমের চেষ্টা সর্বোচ্চ পর্যায়ে করবেন।
নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন
বিগত ১৬ বছর ধরে দেশে কোনো নির্বাচন ছিল না। নির্বাচন নামে প্রহসন করেছে হাসিনা সরকার। দেশে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে জনগণ। ৫ আগস্ট ২৪ বিপ্লবের পর মানুষ নতুন করে স্বাধীনতা পেয়েছে। কথা বলার অধিকার পেয়েছে। আশা করা যায় শিগগিরই ভোটের অধিকার ফিরে পাবে। যে জন্য হাজার হাজার শিশু-কিশোর তখন প্রাণ দিয়েছে। স্বৈরাচারমুক্ত দেশ হয়েছে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন ছিল সরকারের স্থিতিশীলতা নীতি ধারাবাহিকতা নিয়ে। নির্বাচিত সরকার ছাড়া বিনিয়োগকারীরা আস্থা ফিরে পান না। আস্থার জন্য, বিনিয়োগের জন্য নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন। আমরা আশা করছি, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়ে সরকার গঠনে বর্তমান সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। যার ফলশ্রুতিতে বিগত বিনিয়োগ সম্মেলনের ফসল আমরা ঘরে তুলতে পারব।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়