কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বাংলাদেশে ব্যবসা নিয়ে আসুন এবং এর মাধ্যমে বিশ্ব বদলে দিতে ভূমিকা রাখুন

ড. মুহাম্মদ ইউনূস । সূত্র : বণিক বার্তা, ১০ এপ্রিল ২০২৫

বাংলাদেশে ব্যবসা নিয়ে আসুন এবং এর মাধ্যমে বিশ্ব বদলে দিতে ভূমিকা রাখুন

বাংলাদেশ যে পথ পেরিয়েছে যা যথেষ্ট আবেগপূর্ণ। এ বাংলাদেশ যারা উপহার দিয়েছে তারা দেশের নায়ক। কিহাক সাং, আজকে যিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেলেন তাকে অভিনন্দন।

 

বাংলাদেশ যে পথ পেরিয়েছে যা যথেষ্ট আবেগপূর্ণ। এ বাংলাদেশ যারা উপহার দিয়েছে তারা দেশের নায়ক। কিহাক সাং, আজকে যিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেলেন তাকে অভিনন্দন। বাংলাদেশের প্রতি তার অনুরাগ, ত্যাগ, মমতা অনুকরণীয়। তিনি বাংলাদেশকে ভালোবাসেন, বাংলাদেশের প্রকৃতি ভালোবাসেন, বাংলাদেশের জন্য কাজ করছেন। আশা করি, আপনারা তার কারখানা পরিদর্শন করবেন। এবার বাংলাদেশে বড় আকারের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে এসেছেন। আমি আপনাদের সবাইকে বলব, এ দেশ আপনাদেরও। আমরা এটাকে সবার জন্য সুন্দর দেশ বানাব।

 

  • আমাদের রয়েছে দীর্ঘ ৫০ বছরেরও বেশি সময়ের এক যাত্রা। আমি ঠিক মনে করছিলাম ১৯৭১ সালের কথা, যখন আমরা স্বাধীন দেশ হয়েছিলাম। তখন আমরা উদযাপন করেছিলাম সেই অর্জন এবং প্রতিজ্ঞা করেছিলাম একটি নতুন দেশ গড়ে তোলার। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অসংখ্য প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে, তবুও আমরা আনন্দিত ছিলাম—আমরা স্বাধীন। সেটাই ছিল ১৯৭১।

 

  • তারপর এল ১৯৭৪। আজ আমরা প্রায় ১৮ কোটিরও বেশি মানুষের কথা বলি। কিন্তু ১৯৭১ সালে আমাদের জনসংখ্যা ছিল এর এক-তৃতীয়াংশের মতো। তবুও দেশটা একই ছিল। ১৯৭৪ সাল—একটি বছর যা আমরা ভুলতে পারি না। মানুষ না খেয়ে মারা গিয়েছিল। সারা দেশে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। প্রায় ১৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। এটাই ছিল সেই দেশ, যেখান থেকে আমরা যাত্রা শুরু করি।

 

  • আমরা তখন একটি মাত্র ফসল ফলাতাম। আমাদের কাছে আর কোনো বিকল্প জানা ছিল না। আমাদের জনসংখ্যার বড় অংশই ছিলেন কৃষক, তাদের আর কোনো পেশা ছিল না। সেই কৃষকদের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশই ছিলেন ভূমিহীন। তাদের নিজের কোনো জমি ছিল না। তারা অন্যের সামান্য জমিতে একটি ফসল ফলিয়ে কোনো মতে জীবনধারণ করতেন। যদি আপনি ‘দারিদ্র্যের চরম সীমা’ শব্দটির বাস্তব রূপ দেখতে চান, তাহলে সেটাই ছিল বাংলাদেশ। জীবন ছিল অত্যন্ত কঠিন।

 

  • আপনি ১৯৭৪ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এ যাত্রাপথটি যদি দেখেন, তাহলে সেটি একটি অভাবনীয় রূপান্তর। আজ আমরা বৃহৎ শিল্প-কারখানার কথা বলছি। আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি আরো শিল্প স্থাপনের জন্য। আমরা একটি বৃহৎ বাজার এবং বিশাল, মেধাবী, তরুণ জনগোষ্ঠীর কথা বলছি। এটাই বাংলাদেশ—অত্যন্ত অল্প সময়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।

 

  • সেই দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশে একটি ক্ষুদ্র উদ্যোগের সূচনা হয়েছিল, যা ছিল শুধুই এ অসহ্য পরিস্থিতিকে কিছুটা লাঘব করার চেষ্টা। মানুষকে ক্ষুদ্র পরিমাণে অর্থ ধার দেয়ার একটি উদ্যোগ—দুই ডলার, তিন ডলার—যাতে তারা একটি ছোট ব্যবসা শুরু করতে পারে। এ উদ্যোগটি বিশেষভাবে নারীদের ওপর কেন্দ্রীভূত ছিল, কারণ তারাই ছিল সবচেয়ে অসহায়। পরবর্তীতে এ উদ্যোগই পরিচিতি পায় ‘মাইক্রোক্রেডিট’ (ক্ষুদ্রঋণ) নামে।

 

  • আমরা একটি ব্যাংক গঠন করি—গ্রামীণ ব্যাংক। তখন আমরা জানতাম না এটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু আজ এটি আন্তর্জাতিকভাবে একটি পরিচিত নাম হয়ে উঠেছে। কারণ আপনি যেই দেশেই থাকুন না কেন, আপনার ভেতরেই ১৯৭৪ সালের এক টুকরো বাংলাদেশ লুকিয়ে আছে। আপনি সেটা চিনতে পারেন না। আপনি সেটা লুকিয়ে রাখেন—সরকারি অর্থ দিয়ে তাদের সহায়তা করে।

 

  • তাই আমি বারবার বলি, দরিদ্র মানুষকে সরকারি অনুদান দেয়া কোনো সমাধান নয়। আসল সমাধান হলো একটি কাঠামো, একটি উপযুক্ত ব্যবস্থা তৈরি করা। মানুষের আপন শক্তিকে উন্মোচন করা। ক্ষুদ্র ঋণ ছিল সেই প্রচেষ্টার একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। এরপর একটি অদ্ভুত ধারণা মাথায় আসে। সরকার তখন টেলিফোন লাইসেন্স দিতে চাচ্ছিল। টেলিফোনের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্কই ছিল না। শহরগুলোতে গুটিকতক ফোন থাকলেও বেশির ভাগই অকেজো। তখন আলোচনা হলো—আমরা কেন একটি টেলিফোন কোম্পানির লাইসেন্সের জন্য আবেদন করি না? এটি ছিল একেবারেই পাগলামির মতো ধারণা।

 

  • সরকার জিজ্ঞেস করল, তোমরা টেলিফোন কোম্পানি দিয়ে কী করবে? তোমাদের কী ধরনের ব্যবসা হবে এতে? আমি বললাম, আমরা এ ফোনগুলো গরিব নারীদের হাতে তুলে দেব। তারা আমাদের কথা শুনে হেসে ফেলল।

 

  • দীর্ঘ গল্প সংক্ষিপ্ত করে বলি, আমরা সেই লাইসেন্স পেয়ে যাই। আমরা এর নাম রাখি ‘গ্রামীণফোন’—কারণ আমরা গ্রামীণ ব্যাংক, তাই নামেও ‘গ্রামীণ’। কেউই আমাদের সঙ্গে অংশীদার হতে চায় না। কারণ আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই, কোনো প্রযুক্তি জ্ঞান নেই। তখনকার বাংলাদেশ মোবাইল ফোনের জন্য উপযুক্ত স্থান নয়, এখানে কোনো বাজার নেই। কে আমাদের সঙ্গে কাজ করবে? আমরা একের পর এক আন্তর্জাতিক দরজায় কড়া নাড়ি। কেউ রাজি হয় না। ব্যক্তিগতভাবে চিনি এমন একজনের কাছে গেলাম—তিনি ছিলেন নরওয়ের টেলিনর কোম্পানির চেয়ারম্যান।

 

  • আমি তাকে অনুরোধ করি—আমাদের কি সাহায্য করতে পার? আমি ব্যাখ্যা করি কেন আমরা এটা করতে চাই এবং কেন আমরা নারীদের হাতে ফোন দিতে চাই। তিনি গুরুত্বসহকারে বিষয়টি নেন। কিন্তু টেলিনরের পরিচালনা পর্ষদ তাতে সম্মত হয়নি। তারা বলে, বাংলাদেশ? আমরা তো এমন কোনো দেশের নাম শুনিনি। ফলে তার জন্য এটি ছিল বিশাল এক চ্যালেঞ্জ। যতবার বোর্ড না বলে, ততবারই তিনি ফিরে যান—আবার বোঝানোর চেষ্টা করেন। অবশেষে তিনি বোর্ডের অনুমোদন পান। কোম্পানির মূল্যায়ন ছিল—এ প্রকল্পের সর্বোচ্চ সময়ে দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী সংখ্যা হবে দুই লাখ।

 

  • মাত্র দুই লাখ গ্রাহক নিয়ে কোনো লাভজনক ব্যবসা সম্ভব নয়। তিনি আমাকে বললেন, আমি তখন বললাম—আপনি কি পাগল? সংখ্যাটা অন্তত ১০ গুণ হবে। আমি সেইভাবে হিসাব করেছিলাম। পরবর্তীতে এটি হয়ে ওঠে দেশের সবচেয়ে বড় টেলিফোন কোম্পানি এবং সেই ফোনসেটগুলো পেয়েছিল নারীরা। তাদের তৈরি করা হয়েছিল ‘টেলিফোন লেডি’—তারা কোম্পানির মোবাইল সার্ভিস বিক্রি করতেন। পুরুষরা আবেদন করতে পারতেন না, ফোনও পেতেন না। শুধু গ্রামীণ ব্যাংকের দরিদ্র নারী সদস্যরাই এ ফোন ব্যবহারের সুযোগ পেতেন। সব নারী নয়—শুধু দরিদ্র নারী, যারা গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য।

 

  • এ নারীরা ছিলেন সম্পূর্ণ অশিক্ষিত, জীবিকার কোনো উপায় ছিল না, এমনকি টেলিফোন কী জিনিস তাও জানতেন না। আমরা তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তারা টেলিফোন সেবা বিক্রি শুরু করলেন—বলেন, ‘আপনি যদি আপনার মধ্যপ্রাচ্যে থাকা ছেলের সঙ্গে কথা বলতে চান তাহলে আসেন।’ তখন মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের প্রবাহ বাড়তেছিল। এতে টেলিফোন ব্যবসা খুব চাঙ্গা হয়ে ওঠে।

 

  • মানুষ কথা বলতে চায়। এ চাহিদা থেকেই এক দুর্দান্ত ব্যবসার সূচনা হয়। অল্প সময়েই, এক লাখ নারী সারা বাংলাদেশে টেলিফোন সেবা বিক্রি করতে শুরু করেন। ব্যাপারটা এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে সবাই টেলিফোন চায়। পুরো কোম্পানির দৃশ্যপট পাল্টে যায়। তখন বিশ্বের অন্যান্য দেশে নতুন নতুন টেলিকম কোম্পানি গড়ে উঠছিল। তারা শুধু শহরকেন্দ্রিক ছিল। কিন্তু সংবাদপত্রগুলো কাভার করছিল আমাদের গল্প—তাদের নয়। আমরা হয়ে উঠি পরিচিত নাম।

 

  • তখন তারা আমাদের অনুকরণ শুরু করে। প্রথমবারের মতো ধারণা তৈরি হলো যে গ্রামের জীবনেও টেলিফোনের ব্যবহার থাকতে পারে। তারা কখনো ভাবেনি, একটুও না—যে টেলিফোন গ্রামের মানুষের জন্যও প্রয়োজনীয় হতে পারে। তারা কেবল শহরেই মনোযোগ দিত। কিন্তু সেই দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেল। বিশ্বব্যাপী টেলিফোন শিল্পে পরিবর্তন আসে।

 

  • আমি এ গল্পটা বলছি, কারণ বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে অদ্ভুত কিন্তু শক্তিশালী কিছু ধারণা দিয়ে পৃথিবী বদলে দেয়ার চেষ্টা চলে।

 

  • মঞ্চে যাদের আপনি পুরস্কার নিতে দেখলেন, তারা প্রত্যেকেই এমন কিছু ‘পাগলাটে’ কিন্তু কার্যকরী ধারণা নিয়ে এসেছেন এবং তা বাস্তবায়ন করেছেন। আমরা আপনাকেও আমন্ত্রণ জানাচ্ছি—এ সৃজনশীল মানুষের কাতারে।

 

  • শুধু বাংলাদেশকে বদলানোর জন্য নয়, বরং সারা পৃথিবীকে বদলাতে। আমি বারবার সবাইকে মনে করিয়ে দিই—হ্যাঁ, আপনি মুনাফা অর্জন করতে চান, নিশ্চিন্তে করুন। যতটুকু পারেন, মুনাফা করুন। কিন্তু এর সঙ্গে আপনি একটি ক্ষুদ্র অংশ সামাজিক উদ্দেশ্য হিসেবেও যুক্ত করতে পারেন। এতে আপনার মূল লক্ষ্য বিঘ্নিত হবে না। এটা এমন কিছু, যা আপনি করতে পারেন এবং করতে গিয়েই আনন্দ পাবেন। যেমন আপনাদের অনেকেই এরই মধ্যে করেন।

 

আমি এই গল্পটা বললাম, কারণ বাংলাদেশে এমন অভাবনীয় পরিকল্পনা আছে যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে বদলে ফেলা সম্ভব। সেই সঙ্গে এখানে অনেক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্ভব।

 

 

আজকে মঞ্চে যাদের পুরস্কার নিতে দেখেছেন, তাদের প্রত্যেকেই এমন কিছু অভাবনীয় দৃঢ় পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলেন এবং তা বাস্তবায়ন করেছেন। আমরা আপনাকেও আমন্ত্রণ জানাচ্ছি—এ চিন্তাশীল মানুষের ভিড়ে যোগ দিতে। শুধু বাংলাদেশকে নয়, বরং পুরো পৃথিবী বদলাতে।

 
  • আমি বারবার সবাইকে মনে করিয়ে দিই—মুনাফা অর্জন করতে চাইলে নিশ্চিন্তে তা করুন। যতটা সম্ভব মুনাফা করুন। কিন্তু এর সঙ্গে একটা সামাজিক উদ্দেশ্যও যুক্ত করা যেতে পারে। এতে আপনার মূল লক্ষ্য বিঘ্নিত হবে না, বরং এটা করতে করতে আপনি আনন্দিত হবেন। আপনাদের অনেকেই এরই মধ্যে তা করছেনও। তাই কেউ যদি একটি উদ্দেশ্যমূলক ব্যবসা তথা মুনাফার পাশাপাশি মানুষের উপকারের জন্য কিছু করতে চান তাহলে বাংলাদেশই সেই জায়গা। আপনি জানবেন না আপনার ব্যবসার ভবিষ্যৎ কেমন হতে যাচ্ছে। কেন হঠাৎ পুরো পৃথিবী আপনার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু একদিন হঠাৎ পেছনে ফিরে তাকিয়ে ভাববেন—‘এটা কীভাবে হলো?’ এমনটা বাংলাদেশে সম্ভব।

 

  • সবাই বোঝাতে চায়—আপনি কতটা লাভ করলেন, আপনার ‘বটম লাইন’ কতটা ভালো। তবে আমি এতটুকুও যোগ করি—নিঃসন্দেহে উপার্জনের অর্থ সুখ। কিন্তু অন্যকে সুখী করাটা অত্যধিক সুখের বিষয়। যদি আপনি বাংলাদেশে ব্যবসা করেন, আপনি দুটোই পাবেন এবং অতিরিক্ত হিসেবে যার জন্য আপনার কোনো ব্যয় করতে হবে না। আপনি বরং গর্ব বোধ করবেন যেমনটা এ মঞ্চের ব্যক্তিরা অনুভব করেন। সত্যিকার অর্থে তারা অত্যধিক সুখী। কারণ তারা এমন কিছু করেছেন, যা মানুষের জীবনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। যে কারণে একসময়ের দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশ আজ বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পথে। ব্যবসা, উদ্যোগ—সব কিছুতেই। বাংলাদেশকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবার কোনো সুযোগ নেই। এ দেশ বৃহৎ বৈশ্বিক অর্থনীতির একটি অংশ। পুরো দেশ সম্পদে ভরপুর। আমরা একে অপরকে সহযোগিতা করব। ব্যবসা মানে সবকিছু কেড়ে নেয়া নয়, ব্যবসা মানেই প্রতিযোগিতা নয়।

 

  • একসঙ্গে উপার্জন করা, মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন বয়ে আনা আনন্দের বিষয়। এ আনন্দ পরিমাপযোগ্য নয়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই সেই আনন্দ উপভোগ করতে পারে নিজেদের ব্যবসার প্রসার ঘটিয়ে এবং সমাজে প্রভাব বিস্তার করে। এক্ষেত্রে ব্যবসা হলো পৃথিবী বদলে দেয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী কৌশল। যদিও ব্যবসার ক্ষেত্রে আমাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় খুব সংকীর্ণ বিষয়ে মনোযোগ দিতে। ফলে আমরা পুরো পৃথিবীকে পেছনে ফেলে দিই। অথচ আমরা চেষ্টা করতে পারি নতুন কিছু করার।

 

  • আমি সবসময় একটা নতুন সভ্যতা গড়ে তোলার কথা বলি। যেখানে সবকিছু সরল মনে গ্রহণ করা হবে। আমরা সবাইকে আপন করে নেব। এমন এক পৃথিবী গড়ে তুলতে পারি যেটি হবে তিন শূন্যের পৃথিবী—শূন্য কার্বন নিঃসরণ, শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীকরণ ও শূন্য বেকারত্ব এবং এটা সম্ভব ব্যবসার মাধ্যমে। সরকার দিয়ে নয়। কারণ এটা সরকারের কাজ নয়। এটা মানুষের দায়িত্ব। ব্যক্তির দায়িত্ব।

 

  • আমরা মানুষ। আমরা চাইলে পৃথিবী বদলাতে পারি। আর ব্যবসা আমাদের হাতে দিয়েছে সেই কার্যকর কৌশল। নতুন সভ্যতায় কার্বন নিঃসরণ থাকবে না। এখানেই ব্যবসায়িক উদ্ভাবনের সুযোগ। আমাদের শুধু এ বিষয়ে মনোযোগ প্রয়োজন। কার্বন নিঃসরণ অব্যাহত থাকলে সেটি হবে আমাদের ধ্বংসের পথ।

 

  • আবার সম্পদের কেন্দ্রীকরণও আনন্দদায়ক। কিন্তু সম্পদ যদি কেবল হাতে গোনা কয়েকজনের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, সেটাই হবে মানবজাতির জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর। এটা পুরো পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেবে। আর বেকারত্ব? আমাদের তরুণদের বেকারত্ব উদ্বিগ্ন করে তোলে। তাদের বলা প্রয়োজন, ‘তোমরা চাকরিপ্রত্যাশী নও, তোমরাই উদ্যোক্তা। উদ্যোক্তার মতো চিন্তা করো। কাজের সুযোগ তৈরি করো।

 

  • তাছাড়া বাংলাদেশই সেই উদাহরণ, যেখানে ভূমিহীন কৃষক বা স্বল্প জমির মালিকরা নিজেদের রূপান্তর ঘটিয়েছেন। ষাটের দশক, সত্তরের শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সৃজনশীল তরুণ উদ্যোগ নেন একটি শিল্প গড়ে তোলার। তারা বলেছিলেন, আমরাও পারি এবং সেটিই ছিল বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সূচনা।

 

  • সেই প্রথম প্রজন্ম—তাদের কেউ কেউ এখনো আমাদের সঙ্গে আছেন। আর এখন আমরা দেখছি দ্বিতীয় প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের উত্থান। এটাই আমাদের ইতিহাস। এখনো প্রথম প্রজন্ম সক্রিয়। তৃতীয় প্রজন্মের কথাও ভাবতে হবে এখন। আমরা কি প্রস্তুত? যদি আমরা দ্বিতীয় প্রজন্ম নিয়ে কথা বলি, তাহলে তৃতীয় প্রজন্মের কথা আরো বড় পরিসরে চিন্তা করতে হবে। নারী-পুরুষ উভয়কে নিয়েই আমাদের ভাবতে হবে।

 

  • দুঃখজনকভাবে নারী উদ্যোক্তারা অতীতে অনেকটা উপেক্ষিত ছিলেন। কয়েকজন সক্রিয় ছিলেন, কিন্তু কম। অথচ নারীরাও পুরুষের মতোই সৃজনশীল এবং উদ্যোগী। এ নতুন প্রজন্ম—নারী-পুরুষ উভয়ে মিলে পৃথিবী বদলে দেবে। তারা প্রযুক্তিতে দক্ষ, উদ্ভাবনী মনোভাবসম্পন্ন এবং সমস্যা সমাধানে পারদর্শী। আমাদের আর সেই পুরনো দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমস্যার দিকে তাকাতে হবে না—যেখানে আমরা কেবল সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকি। মানুষ নিজেরাই সক্ষম এজন্য।

 

  • এ বিনিয়োগ সম্মেলনে একত্রিত হওয়া আমাদের সুযোগ দিচ্ছে এমন এক পৃথিবী নিয়ে ভাবতে—যেটি আমরা একসঙ্গে গড়ে তুলতে পারি। ব্যবসার পাশাপাশি আমরা এটা নিয়েও ভাবতে পারি। আমাদের চারপাশে এখনো অনেক অব্যবহৃত সুযোগ রয়েছে যেগুলো কাজে লাগানো প্রয়োজন। বাংলাদেশে ব্যবসা মানে কেবল বাংলাদেশ নয়, এটা হতে পারে গোটা বিশ্বের জন্য। আমন্ত্রণ জানাচ্ছি—এ উদ্দেশ্য পূরণে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে।
 

ড. মুহাম্মদ ইউনূস: প্রধান উপদেষ্টা

[বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) আয়োজিত চার দিনব্যাপী ‘বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন ২০২৫’-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অধিবেশনে দেয়া বক্তব্যে]