কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বাংলাদেশে এইচএমপিভি ভাইরাস, সচেতনতা বাড়াতে হবে

সৈয়দ ফারুক হোসেন । সূত্র : সময়ের আলো, ১৭ জানুয়ারি ২০২৫

বাংলাদেশে এইচএমপিভি ভাইরাস, সচেতনতা বাড়াতে হবে
করোনাভাইরাস ও এমপক্সের পর এবার বিশ্বে নতুন এইচএমপিভি ভাইরাস (হিউম্যান মেটোনিউমোভাইরাস) সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। এইচএমপিভির লক্ষণ শনাক্ত হয়েছে জাপান, মালয়েশিয়া, ভারত এবং বাংলাদেশও। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশও।  বাংলাদেশে এইচএমপিভি ভাইরাসে আক্রান্ত ৩০ বছর বয়সি নারী সানজিদা আক্তার মারা গেছেন। মহাখালী সংক্রামক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে। গত ১৬ জানুয়ারি সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আরিফুল বাশার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
 
 
 
২০১৯ সালের শেষদিকে চীনে ব্যাপকহারে সংক্রমণ বাড়ে কোভিড-১৯ ভাইরাস। এক পর্যায়ে এটি মহামারিতে রূপ নেয়। থমকে যায় পুরো বিশ্ব। সেই সঙ্গে প্রাণ হারায় লাখ লাখ মানুষ। সেই মহামারির পাঁচ বছর পর আবারও নতুন ব্যাধি আতঙ্কে পূর্ব এশিয়ার দেশ চীন। প্রাথমিক ধারণা, রাইনোভাইরাস ও দ্য হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাসের সংক্রমণে দেশটিতে রহস্যময় এই রোগের প্রাদুর্ভাব। শঙ্কা রয়েছে মহামারিতে রূপ নেওয়ার।
 
 
ভাইরাস হলো অতিক্ষুদ্র সংক্রামক, যা শুধু একটি জীবন্ত কোষের অভ্যন্তরে বংশবৃদ্ধি করতে পারে। ভাইরাস উদ্ভিদ, প্রাণী থেকে শুরু করে ব্যাকটেরিয়া, আর্কিয়াসহ সব জীবজগৎকে আক্রান্ত করে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি বাস্তুতন্ত্রেই ভাইরাস পাওয়া যায়। এরা হলো সবচেয়ে বহুল সংখ্যক জৈবিক সত্ত্বা।
 
 
 
২০২০ সালের করোনা মহামারির পর এবার চীনে নতুন এক ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার ঠিক পাঁচ বছর পর এ ঘটনা ঘটল। 
 
 
কোভিড-১৯ মহামারিতে সারা পৃথিবীতে ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। ২০০১ সালে প্রথম এইচএমপিভি ভাইরাস আবিষ্কার হয়। আবিষ্কারেরও ৬০ বছর আগে থেকে ভাইরাসটি মানবজগতে রয়েছে, ফলে কোভিডের মতো নতুন ধরনের ভাইরাস এইচএমপিভি নয়। মূলত ১৩ থেকে ১৬ বছর বয়সের নিচের শিশু এবং বয়স্করা এতে আক্রান্ত হয়। সম্প্রতি এইচএমপিভি ভাইরাসের আক্রমণ হাসপাতালগুলোতে রোগীদের ভিড় বাড়ছে।
 
 
 
বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে এই ভাইরাসের প্রভাব বেশি দেখা যাচ্ছে। এই ভাইরাসের কারণে সাধারণত ঠান্ডা জ্বরের মতো উপসর্গ দেখা দেয়। শীতের মৌসুমে ভাইরাসটি বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। বর্তমানে চীনের বিভিন্ন প্রদেশে এর দ্রুত বিস্তার নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। চীনের পর এবার মালয়েশিয়াতে এবং আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও বাড়ছে এইচএমপিভি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে জনসাধারণকে মাস্ক ব্যবহার এবং বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার পরামর্শ দিয়েছে মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
 
 
 
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের তথ্যানুসারে, এইচএমপিভি একটি শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাস, যা ওপরের এবং নিচের শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ ঘটায়। এটি সব বয়সের ব্যক্তিদের প্রভাবিত করে। তবে শিশু, বয়স্ক এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের জন্য ভাইরাসটি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হয়তো আরও অনেক যুগ আগে থেকেই এ ভাইরাসের অস্তিত্ব ছিল পৃথিবীতে। গুরুতর ক্ষেত্রে, ভাইরাস ব্রংকাইটিস বা নিউমোনিয়ার মতো জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
 
 
 
এইচএমপিভির ইনকিউবেশন পিরিয়ড বা উন্মেষপর্ব সাধারণত তিন থেকে ছয় দিনের মধ্যে হয়। তবে সংক্রমণের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে লক্ষণগুলো বিভিন্ন সময়কালের জন্য স্থায়ী হয়। এইচএমপিভি অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাসের মতোই ছড়ায়। যেমন-কাশি এবং হাঁচি থেকে নিঃসরণের মাধ্যমে, হাত মেলানো বা স্পর্শ করার দ্বারা, সংক্রমিত স্থান স্পর্শ করা এবং তারপর মুখ, নাক বা চোখ হাত দিয়ে স্পর্শ করার মাধ্যমেও বিস্তার লাভ করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে আগেও এইচএমপিভি ভাইরাসের অস্তিত্ব ছিল। 
 
 
 
 
এখনও শিশু আর প্রবীণদের শরীরে মিলবে এটির অস্তিত্ব। তবে আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। করোনার মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেই সংক্রমণ থেকে দূরে থাকা সম্ভব। এইচএমপিভি ভাইরাস বাংলাদেশে নতুন কোনো ভাইরাস নয়। দেশে এর উপস্থিতি আগেও ছিল, এখনও আছে। এই ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলে জানিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)।
 
 
 
অন্য যেকোনো জ্বর, সর্দি বা কাশির ক্ষেত্রে যে ধরনের সতর্কতা প্রয়োজন, এইচএমপিভিজনিত অসুস্থতার ক্ষেত্রে একই ধরনের সাবধানতা প্রয়োজন। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে এই ভাইরাসের উপস্থিতি প্রথম শনাক্ত হয়। সবশেষ ২০২৩ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে দুজনের শরীরে এটি শনাক্ত হয়। 
 
 
 
এটি অন্য জ্বরের মতো। তবে শিশু, বয়স্ক ও বয়স্ক যেসব ব্যক্তি ক্যানসার বা দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা ঝুঁকি আছে। হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে অন্য ব্যক্তির ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। সংক্রমণ থেকে দূরে থাকার উপায় হচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। অর্থাৎ মাস্ক পরতে হবে, নিয়মিত হাত ধুতে হবে।
 
 
 
সম্প্রতি নতুন করে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি)। এটি শ্বাসতন্ত্রবাহিত সংক্রামক ব্যাধির জন্য দায়ী ভাইরাস। এইচএমপিভি ভাইরাসের উদ্ভব নানা কারণে হয়ে থাকে। বিভিন্ন রকম ভাইরাসের সংমিশ্রণে নতুন ভাইরাসের উদ্ভব হয় বা ভাইরাস তার টিকে থাকার জন্য রূপ পরিবর্তন করে। ভাইরাসের পরিবর্তন যখন অনেক বেশি হয়ে যায়, তখন একটি পর্যায়ে সেই ভাইরাসের নতুন নামকরণ করা হয়। হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস ২০০১ সালে প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল নেদারল্যান্ডসে। আগে থেকেই এই ভাইরাসটি পৃথিবীতে ছিল। কিন্তু নতুন করে বিজ্ঞানীদের চোখে ধরা পড়ে ২০০১ সালে।
 
 
 
অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রবাহিত যেসব ভাইরাস, যেমন-ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, করোনাভাইরাসের মতো কাছাকাছি বৈশিষ্ট্য বা মিল রয়েছে এইচএমপিভি ভাইরাসের। শ্বাসতন্ত্রবাহিত যেসব রোগ আছে, যেমন-ইনফ্লুয়েঞ্জা সেটির মতোই এইচএমপিভি ছড়িয়ে পড়ে। হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এইচএমপিভি ছড়ায়।
 
 
 
এইচএমপিভি আক্রান্ত হাঁচি-কাশি লেগে থাকা ব্যক্তির ব্যবহৃত কাপড় বা কোনো বস্তু এমনকি কোনো জায়গা অন্য কেউ স্পর্শ করে সেই হাত নিজের নাক-মুখে স্পর্শে করলে সেখান থেকে এইচএমপিভি হতে পারে। সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শ ও হাঁচি-কাশির মাধ্যমেই এইচএমপিভি ছড়ানোর ইতিহাস আছে। চীনে সম্প্রতি এটি শনাক্ত হয়। ভাইরাসের প্রকোপে চীনে অনেক মানুষ হাসপাতালমুখী হচ্ছেন। গত বছর চীনে ৩২৪ জন এইচএমপিভিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ২০২৩ সালে সেই সংখ্যাটি ছিল ২২৫।
 
 
 
বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে এটি নতুন কোনো ভাইরাস নয়। এমনকি এ নিয়ে বাংলাদেশে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। কোভিড-১৯ একেবারে ভিন্ন ও নতুন আবহের ভাইরাস হওয়ায় এর প্রাদুর্ভাব বা মহামারির রেশ এতটা বিস্তার হয়েছিল। এই ভাইরাসের যে রূপ সেটির বিভিন্ন রকম শ্রেণিবিন্যাস করছেন বিজ্ঞানীরা। তবে এইচএমপিভি ভাইরাসের মিউটেশন হয়েছে কি না তা জানা যায়নি। গুরুতর ফর্মে যাওয়া এবং মানুষের খুব বেশি ক্ষতি করতে সক্ষম, মৃত্যুহার খুব উঁচু এমন পর্যায়ে যায়নি এইচএমপিভি। মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় ভাইরাসটি তাই পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে। অনেকের ক্ষেত্রে এই রোগটি জটিলতা বাড়াতে পারে। কোনো ওষুধ খাওয়ার কারণে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে তাদের।  
 
 
 
 
এইচএমপিভি ভাইরাসের চিকিৎসায় সরাসরি কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। অধিকাংশ ভাইরাসের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো ওষুধ নেই। এ ক্ষেত্রে লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং পাশাপাশি রোগীর যত্ন নিশ্চিত করতে হবে। এটি এমনিতে সেরে যায় নির্দিষ্ট সময় পর। তবে রোগ যাতে গুরুতর পর্যায়ে না যায়, সে জন্য সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। শরীরে যদি অন্য কোনো সংক্রমণ থেকে থাকে, সেটির জন্য ওষুধ দেওয়া হয় রোগীকে। যাতে ওই সংক্রমণ এবং এইচএমপিভি ভাইরাসের সংক্রমণ যুক্ত হয়ে জটিল অবস্থা তৈরি করতে না পারে। করোনার মতো মহামারি পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে এমন অবস্থায় এখনও যায়নি এইচএমপিভি ভাইরাস। 
 
 
 
 
তবে রোগটি যত বেশি ছড়াবে, তত বেশি আশঙ্কা থাকে এই ভাইরাসটি তার ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটাতে পারে, খুব বৃদ্ধি হতে পারে, আবার কমেও যেতে পারে। নিয়মিত বিরতিতে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে, হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় নাক-মুখে রুমাল, টিস্যু বা কনুই দিয়ে ঢেকে নিতে হবে, সংক্রমিত ব্যক্তির কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, এইচএমপিভি সংক্রমিত ব্যক্তিকে মাস্ক পরিধান করতে হবে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির কাছাকাছি থাকা ব্যক্তিদেরও মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। জ্বর হলে রোগীকে বিশ্রাম নিতে হবে নিজ অবস্থানে, অন্যান্য ভাইরাল জ্বরের মতো তিন দিনের ভেতর জ্বর কমে যাবে। 
 
 
 
 
যদি জ্বর না কমে তা হলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে হবে। অনেক বেশি রোগী হাসপাতালে এলে সেটি জনস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি পরিস্থিতি হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই এইচএমপিভি আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে কি না সেটি লক্ষ রাখার পাশাপাশি জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় হাসপাতাল, চিকিৎসা গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সবার সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
 
 
 
সাবেক রেজিস্ট্রার, বিএসএফএমএসটিইউ