বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অভিজ্ঞতা ১৯৭১-২০২৫
ড. এম এম আকাশ। সূত্র : আমাদের সময়, ২৩ এপ্রিল ২০২৫

[এই প্রবন্ধটি সম্পূর্ণরূপে লেখকের ব্যক্তিগত
পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে এবং এটি লেখক যে সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত তাদের মতামতের সঙ্গে না-ও মিলতে পারে। এটি কেবল আলোচনার জন্য একটি প্রাথমিক খসড়া এবং লেখকের অনুমতি ছাড়া উদ্ধৃত করা যাবে না।]
ভূমিকা
এই উপস্থাপনায় আমি গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক সূচকগুলো বর্ণনা করার চেষ্টা করব এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা কীভাবে এগুলোকে উৎসাহিত বা বাধাগ্রস্ত করেছে তা তুলে ধরব। বিশেষভাবে গণতন্ত্রের আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত ‘আদর্শ প্রতিষ্ঠানগুলো’ এবং বাংলাদেশে সেগুলোর সীমাবদ্ধ প্রয়োগ ও সীমিত ফলাফলের জন্য দায়ী সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামোগত বাধাগুলোর বিশ্লেষণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। শেষ অংশে আমি এই ঐতিহাসিক বিবর্তন থেকে কিছু শিক্ষা সংক্ষেপে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি।
গণতন্ত্রের বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত সূচক
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও মানবাধিকার আন্তর্জাতিক আলোচনার দুটি প্রধান এজেন্ডা। বিভিন্ন পশ্চিমা আন্তর্জাতিক সংস্থা সারাবছর ‘গণতন্ত্র’ ও ‘মানবাধিকার’ পর্যবেক্ষণ করে এবং এ সম্পর্কে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তারা প্রায়ই একাধিক সূচকের সমন্বয়ে গঠিত একটি যৌগিক সূচকের মাধ্যমে এগুলো পরিমাপ করে। এই সংস্থাগুলোর নিজস্ব পক্ষপাত থাকে এবং তারা যে সূচক নির্বাচন করে তা সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিক বা সার্বভৌম রাষ্ট্রের মতামতের সঙ্গে মিল না-ও হতে পারে। তবু আমি নিচে তিনটি আন্তর্জাতিক সংস্থার বহুল প্রচলিত তিনটি সূচক সেট (ঝবঃ)-এর উল্লেখ করছি-
১. ফ্রিডম হাউস গণতন্ত্র সূচক : এটি সাতটি সূচক নিয়ে গঠিত একটি যৌগিক সূচকের সেট- ১. অবাধ ও ২. নিরপেক্ষ নির্বাচন, ৩. জনগণ ও দলগুলোর অংশগ্রহণ, ৪. সরকারের কার্যকারিতা, ৫. আইনের শাসন, ৬. মুক্ত মত প্রকাশ, ৭. সংগঠনের অধিকার এবং ব্যক্তিগত অধিকার।
২. ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গণতন্ত্র সূচক : এটি পাঁচটি সূচক নিয়ে গঠিত- নির্বাচন, অংশগ্রহণ, সরকারের কার্যকারিতা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নাগরিক স্বাধীনতা।
৩. ভি-ডেম (বিভিন্ন গণতন্ত্র) : এটি একটি কম পরিচিত সুইডিশ একাডেমিকভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা, যারা বিশ্বাস করে যে, গণতন্ত্র একটি বহুমাত্রিক ধারণা এবং বিভিন্ন মাত্রার ওপর দেওয়া গুরুত্ব প্রেক্ষাপটভেদে ভিন্ন হতে পারে। তাদের তথাকথিত ‘ভানহানেনের পলিয়ার্কি সূচকে’ পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা দেশভেদে নানা রূপে অন্তর্র্ভুক্ত হয়েছে। তার পরও সূচকগুলো হচ্ছে- নির্বাচন, অংশগ্রহণ, আলোচনা, সমতা ও উদারনীতি।
এই সম্মেলনের ধারণাপত্রে গণতন্ত্রের প্রতি তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণিত রয়েছে। সম্ভবত এই সম্মেলনের দৃষ্টিভঙ্গি উল্লিখিত ভি-ডেম সূচকের সবচেয়ে কাছাকাছি। ধারণাপত্রে গণতন্ত্রের ‘দৃঢ়তা’ মূল্যায়নের জন্য একটি কার্যকর মিনিম্যাক্স মানদ- ব্যবহার করা হয়েছে। আমি উদ্ধৃত করছি- ‘দৃঢ় গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলোর একটি হলো সংখ্যালঘু এবং প্রান্তিক সামাজিক গোষ্ঠীগুলোকে সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা।’ এবং আবার সমালোচনামূলকভাবে একটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলা হয়েছে, ‘২০১৪-এর পর ভারতে নতুন ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এবং অতিজাতীয়তাবাদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রক্রিয়া গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
যদি আমরা এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করি, তাহলে গণতন্ত্রের দৃঢ়তা পরিমাপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানদ- হবে- সংখ্যালঘু গোষ্ঠী এবং সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির সামগ্রিক রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অবস্থার উন্নতি বা উন্নয়ন পরিমাপকারী প্রক্সি সূচকের সেট। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, সমাজের সংখ্যালঘু গোষ্ঠী এবং প্রান্তিক শ্রেণির প্রতি যেকোনো অন্যায় আচরণ নিশ্চিতভাবে গণতন্ত্রের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবে। সেই মাপকাঠি ব্যবহার করে এখন আমরা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিবর্তন নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা নিচে তুলে ধরছি।
২. বাংলাদেশের রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা এবং গণতন্ত্রের দৃঢ়তা : ১৯৭১-২০২৫ একটি দেশের রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা গঠিত হয় একটি শাসক কর্তৃপক্ষ, একটি প্রভাবশালী শ্রেণি বা শ্রেণির জোট দ্বারা, যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয় এবং আইন, নিয়মকানুন, কারাগার, পুলিশ, সেনাবাহিনী, আমলাতন্ত্র, বিশ্ববিদ্যালয়, থিংকট্যাংক, ধর্ম, রাজনৈতিক দল, গণসংগঠন ইত্যাদির মতো সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জবরদস্তি বা/এবং আধিপত্যমূলক সম্মতি অর্জন ও টিকিয়ে রেখে তাদের রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখে। এই উপাদানগুলো সময়ের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে বিবর্তিত হয়ে একটি দেশে গণতন্ত্রকে হয় উন্নত করতে পারে অথবা সামাজিক ন্যায্যতা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং এই প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলোতে অংশগ্রহণমূলক শাসনকে নিরুৎসাহিত বা বাধাগ্রস্ত করে গণতন্ত্রকে হ্রাস করতে পারে। এখন আমি বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী দল এবং তাদের সংশ্লিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক বৈশিষ্ট্যগুলোর বিবর্তনের একটি খুব সাধারণ রূপরেখা আঁকব।
২.১. ১৯৭১-৭৫ : শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক শাসন
স্বাধীনতার পর, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে শাসনকারী রাজনৈতিক দল ছিল আওয়ামী লীগ (এএল)। এটি ছিল একটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী দল, যার নেতৃত্বে ছিলেন জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি জাতির বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন পেয়েছিলেন। ধনী, দরিদ্র এবং মধ্যবিত্ত সবাই তাকে বঙ্গবন্ধু (বাংলাদেশের বন্ধু) বলে ডাকত!
আওয়ামী লীগ মূলত পাকিস্তানে আওয়ামী মুসলিম লীগ হিসেবে জন্ম নিয়েছিল এবং পরে নিজেকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নামে রূপান্তরিত করে। ১৯৭২-৭৫ সালে আওয়ামী লীগের শাসনের প্রধান সমালোচনাগুলো নিম্নরূপ-
ক. ১৯৭৪ সালে গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু বিরোধী দলগুলো কয়েকটি সংসদীয় আসনে কারচুপির অভিযোগ করেছিল।
খ. ১৯৭২ সালে বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান এই প্রস্তাবে সম্মত হননি, যদিও আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় ব্যক্তি তাজউদ্দীন আহমদ, যিনি শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, এই প্রস্তাবের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল ছিলেন বলে জানা যায়।
গ. পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সংসদে তাদের দাবি সত্ত্বেও কোনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায়নি।
ঘ. ১৯৭৪ সালে প্রান্তিক ও দরিদ্র, বিশেষ করে কৃষি শ্রমিক শ্রেণি সরবরাহ সংকট এবং ক্রয়ক্ষমতার সংকটের কারণে সবচেয়ে খারাপ খাদ্য অধিকার ব্যর্থতার শিকার হয়েছিল। ফলস্বরূপ, প্রান্তিক শ্রেণির অনেক সদস্য দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল।
ঙ. আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব প্রথমে বিরোধীদের প্রতিবাদ গণতান্ত্রিক উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সংকট অব্যাহত থাকায় তিনি পরে একটি একদলীয় ব্যবস্থা গঠন করেন এবং ‘বাকশাল’ নামক দলের বাইরের সবার জন্য নাগরিক অধিকার সীমিত করে দেন।
চ. কিন্তু এটিই ছিল বাংলাদেশে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের শেষের শুরু।
১৯৭৫ সালে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য শেখ মুজিব এবং তার পুরো পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। খন্দকার মোশতাক এবং ডানপন্থি আওয়ামী লীগারদের নেতৃত্বে একটি নতুন সরকার পুরনো সরকারকে প্রতিস্থাপন করে।
২.২. ১৯৭৫-১৯৯০ : মোশতাক, জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদের রাজনৈতিক শাসন
এই সময়কাল ছিল সামরিক বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন ‘রাজার দল’ সৃষ্টির মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতার সম্পূর্ণ পুনর্গঠনের সময়। উদারনৈতিক গনতন্ত্র তখনও সূচিত হয়নি।
ক. শেখ মুজিব হত্যার অল্প সময় পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে আওয়ামী লীগের চারজন বিশিষ্ট নেতার আরেকটি নৃশংস হত্যাকা- ঘটে, যা তৎকালীন আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধপন্থি রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কার্যকরভাবে পঙ্গু করে দেয়।
খ. খন্দকার মোশতাক, আওয়ামী লীগের আরেকজন ডানপন্থি আমেরিকাপন্থি নেতা, অল্প সময়ের জন্য ক্ষমতা গ্রহণ করেন। কিন্তু শিগগিরই সেনাবাহিনীর মধ্যে অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে, যার ফলে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান, যিনি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, ক্ষমতায় আসেন। উচ্চাভিলাষী জেনারেল জিয়া সশস্ত্র বাহিনী এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষ থেকে তার নিজস্ব রাজনৈতিক দল বিএনপি গঠন করেন। এটি একটি ডানপন্থি উদারনৈতিক দল।
গ. কিন্তু পরে জিয়াও একটি অভ্যুত্থানে নিহত হন এবং জেনারেল এরশাদ তার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি প্রায় একইভাবে তার নিজস্ব জাতীয় পার্টি গঠন করেন। সময়ের সঙ্গে জাতীয় পার্টি আরও ডানপন্থি হয়ে ওঠে এবং ভারত-আমেরিকা অক্ষের সঙ্গে আরও শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তোলে।
ঘ. ১৯৯০ সালে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং অন্যান্য বামপন্থি রাজনৈতিক দলের জোটের নেতৃত্বে একটি গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদের সেনা সমর্থিত শাসন উৎখাত হয়।
এই বিস্তৃত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সবচেয়ে অভিনব উদ্ভাবনী ফলাফল ছিল নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার (ঈধৎব ঞধশবৎ এড়াবৎহসবহঃ ঝুংঃবস) নতুন প্রতিষ্ঠান।
২.৩. ১৯৯০-২০০৮ : দ্বিদলীয় রাজনীতির যুগ
এই নতুন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ অন্য অনেক দেশের মতো সফলভাবে একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে দুটি দল পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় আসতে ইচ্ছুক এবং প্রস্তুত ছিল। উভয় দলই মূলত ধনী শ্রেণির দ্বারা পরিচালিত হতো, যারা বিদেশি সাহায্য ব্যবহার করত বা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সুবিধা ভাগাভাগি করত এবং রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি ব্যবহার করে নিজেদের সমৃদ্ধ করত।
এ ধরনের অভিজাত স্বজন তোষণকারী ধনীদের দ্বারা চালিত সীমিত গণতন্ত্র কিছু সময়ের জন্য শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ছাড়াই স্থিতিশীল থাকতে পারে। কিন্তু যদি উভয় দলই পর্যাপ্ত সহনশীল এবং সভ্য না হয়, তাহলে দ্বিদলীয় রাজনীতি কাজ না-ও করতে পারে।
২০০৮ পর্যন্ত বাংলাদেশ দীর্ঘ আঠারো বছর ধরে চারটি জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিদলীয় গণতন্ত্র বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। এই নির্বাচনগুলোতে দুটি প্রধান অভিজাত-নেতৃত্বাধীন দল- আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- প্রত্যেকে তাদের ক্লায়েন্ট নেটওয়ার্ক ‘বঙ্গভবন’ থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত ‘গ্রাম’ পর্যন্ত বিস্তৃত করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। নির্বাচনের মাধ্যমে চক্রাকারে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন এই সময়ে সমাজের অসমতা ও অন্যায়ের ওপর কোনো প্রভাব ফেলেনি। বরং তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল।
আলোচিত সময়ে উভয় দলই নির্বাচনে একটি উল্লেখযোগ্য ন্যূনতম ভোট এবং সংসদীয় আসন পেতে সক্ষম হয়েছিল এবং তারা পর্যায়ক্রমে একে অপরের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে সংসদে মুখোমুখি হয়েছিল। [টেবিল ১ দেখুন] তাই এই সময়ে অভিজাতদের প্রতি জবাবদিহি এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে একটি মানসম্মত বুর্জোয়া গণতন্ত্র বজায় রাখা কিছুটা সম্ভব হয়েছিল। উৎস : ইসলাম, এসএন গভর্ন্যান্স ফর ডেভেলপমেন্ট : পলিটিকাল অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিফর্মস ইন বাংলাদেশ, পালগ্রেভ অ্যান্ড ম্যাকমিলান, নিউইয়র্ক, ২০১৬
২.৪. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার নির্বাচনের ভাঙন
আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা হলো ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট সিস্টেম। এই ব্যবস্থায় একটি দল বা ব্যক্তি তার ভোটের শতাংশের তুলনায় অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বেশি আসন এবং ক্ষমতা পেতে পারে। একই সময়ে, অনেক প্রান্তিক দল উল্লেখযোগ্য ভোট পাওয়া সত্ত্বেও সংসদ থেকে সম্পূর্ণ বাদ পড়তে পারে। ফলে সংসদে একটি স্বৈরাচারী সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনধারী দল একচেটিয়াভাবে শাসন চালাতে পারে বা ‘বিজয়ী সব নেয়’ কৌশল অনুসরণ করতে পারে, যদিও বিরোধী দলের ক্ষেত্রে প্রকৃত শক্তির ভারসাম্য সিটের তুলনায় বেশি থাকতে পারে।
এ ক্ষেত্রে মাঠে শক্তির ভারসাম্য ভেঙে যাবে এবং দুই ক্ষমতা প্রতিদ্বন্দ্বীর যুদ্ধক্ষেত্র সংসদের পরিবর্তে রাস্তায় স্থানান্তরিত হবে। দুই প্রধান দলের মধ্যে রাজনৈতিক যুদ্ধ প্রান্তিক শ্রেণির দ্বারা শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধের সঙ্গে পরিপূরক হতে পারে, যদি তারা তাদের নিজস্ব বিষয়গুলোর চারপাশে স্বাধীনভাবে সংগঠিত হতে পারে। তা না হলে প্রান্তিক দলগুলো দুই বুর্জোয়া দলের লেজুড়বৃত্তির মধ্যেই দিন কাটাতে থাকবে।
২.৪. বাংলাদেশে ব্যর্থ গণতন্ত্র : ২০০৮-২০২৪
২০১৪ সালের পর দুই অভিজাত দলের মধ্যে সমঝোতা সম্পূর্ণ ভেঙে যায়। প্রধান কারণ ছিল প্রভাবশালী দল আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল। দুই প্রধান দল আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন নিয়ে কোনো সমঝোতায় পৌঁছতে পারেনি। ফলে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলো কমবেশি একদলীয় আধিপত্যের কারচুপিযুক্ত নির্বাচন ছিল, যা প্রধান বিরোধী দলগুলো বয়কট করেছিল।
কিন্তু অবশেষে ২০২৪ সালে ছাত্রদের নেতৃত্বে একটি বহু-শ্রেণির আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এটির নেতৃত্বে ছিল বিভিন্ন মতাদর্শের মিশ্রণ। এটি শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটায় এবং সেনাবাহিনী তাকে রক্ষা করতে অস্বীকার করায় তাকে দেশের বাইরে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে নিরাপদ প্রস্থান করতে হয়।
বর্তমান রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে একটি নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, যা সেনাবাহিনী এবং আন্দোলন পরিচালনাকারী ছাত্র সংগঠন দ্বারা সমর্থিত। বর্তমানে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে একটি সর্বজনীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি পুনর্গঠিত হয়েছে। অনেক ভূগর্ভস্থ মৌলবাদী শক্তি উল্লেখযোগ্য শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এখন প্রভাবশালী দল হয়ে উঠেছে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের আশীর্বাদে ছাত্রদের একটি নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্য ঐতিহ্যবাহী বাম দলগুলো তিনটি ‘এম’ (অর্থ, শক্তি ও কারসাজি) নিয়ন্ত্রণ এবং সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে নির্বাচনব্যবস্থায় কিছু সংস্কারের দাবি তুলেছে। তারা সমানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা এবং যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দাবিও জানিয়েছে।
অমীমাংসিত বিতর্কের মূল বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে বাদ পড়বে নাকি অন্তর্ভুক্ত হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামত মনে করে, জাতিসংঘের মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের অপরাধের বিচার আগে করা উচিত। কিন্তু জাতিসংঘের প্রতিবেদন সাধারণত আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের সমর্থন করে। এখন পর্যন্ত শুধু মৌলবাদী দল, যাকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করেছিল এবং নতুন গঠিত ছাত্রদল, যারা আন্দোলনের প্রধান ক্ষতিগ্রস্ত, বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে নির্বাচন থেকে বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
৩. প্রাপ্ত শিক্ষা
প্রথম শিক্ষা হলো বাংলাদেশে গণতন্ত্র, অন্যত্রের মতো, সব সময় অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমতা এবং ন্যায়বিচারের অভাব দ্বারা সীমাবদ্ধ ছিল। দরিদ্র সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক ও কৃষকরা অতীতে কখনোই তাদের আয়, সম্পদ, শিক্ষার যথাযথ অংশ পাননি এবং তারা তাদের ওপর পরিচালিত শাসন প্রক্রিয়ায় অবাধে অংশগ্রহণের রাজনৈতিক সুযোগ থেকেও বঞ্চিত ছিলেন।
এই বঞ্চিত শ্রেণির মধ্যে এবং তাদের বাইরেও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ গোষ্ঠী রয়েছে, যেমন- সাধারণ নারী, বিভিন্ন ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী এবং সর্বোপরি- বিভিন্ন গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ছোট রাজনৈতিক দল, যারা তুলনামূলকভাবে বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার। তাদের সবাইকে ক্ষমতায়িত না করে এবং মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত না করে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না।
বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান একদলীয় আধিপত্যের মাধ্যমে অকার্যকর হয়ে পড়েছিল, যা খেলার ন্যায্য নিয়ম বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করেছিল এবং বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠকে ইতিহাসের নিছক বস্তুতে পরিণত করেছিল। গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ হলো বাদ পড়া মানুষদের ক্ষমতায়িত করে তাদের ইতিহাসের বিষয়বস্তুতে (ঝঁনলবপঃ) পরিণত করা এবং সংখ্যালঘু স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর ক্ষমতা উৎখাত করা। তাই প্রধান শিক্ষা হলো- গণতন্ত্র রক্ষার জন্য ‘ক্ষমতা সব সময় স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক হওয়া উচিত’, ‘প্রতি-ক্ষমতার’ (ঈড়ঁহঃবৎ চড়বিৎ) এবং সংগ্রামের সুযোগ সব সময় উন্মুক্ত রাখা উচিত।
আমি আমার উপস্থাপনা শেষ করছি লর্ড অ্যাক্টনের ইতিহাসের একটি শিক্ষা দিয়ে, যা স্বার্থবাদী ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী কখনোই মানেনি- ‘সব ক্ষমতা দূষিত করে এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে দূষিত করে।’
ড. এম এম আকাশ : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়