কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও আর্থসামাজিক সংস্কার

এম এম আকাশ । সূত্র : বণিক বার্তা, ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও আর্থসামাজিক সংস্কার

শ্বেতপত্রের টিওআর এবং প্রথমদিকের মতবিনিময় সভায় বলা হয়েছিল যে অর্থনীতির বিগত সরকারি হিসাবগুলো সঠিক নয়। তাই বাস্তব অবস্থা কতখানি খারাপ ও ফোঁপড়া করে স্বৈরাচারী সরকার রেখে গিয়েছিল তা সঠিকভাবে নির্ণয় করার চেষ্টা করা হবে।

 

 

এ প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য দুটি। ক. বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য তাদের স্বল্পমেয়াদি অবস্থানের কারণে যেহেতু শুধু প্রস্তাবই পেশ করতে পারবে বলে মনে হয়, তবু তার পরেও জরুরি সমস্যাগুলো সমাধানে জরুরি মনোনিবেশ তাদের করতে হবেই—সে জন্য তাদের একটি প্রধান কাজ হবে আর্থসামাজিক পরিস্থিতির বেঞ্চমার্কগুলো সঠিকভাবে নির্ণয় করা।

 

 

এছাড়া ঘাড়ের ওপর পড়ে যাওয়া সমস্যাগুলোর সমাধান করে জনগণকে স্বস্তি প্রদানও কিন্তু এ সরকারের দায়িত্ব। তাদের বন্ধুরাও এ মুহূর্তে তাই বলছেন। সুতরাং আমার মতে, তাদের মূল দায়িত্ব হবে সঠিক ও স্বল্পসংখ্যক পদক্ষেপ গ্রহণ করা।| তারা এগুলো কতদূর করতে পেরেছেন তার একটি পর্যালোচনা এ প্রবন্ধে সংক্ষেপে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে।

 

 

খ. এছাড়া নানা রকম সৃজনশীল অপ্রচলিত সংস্কার প্রস্তাব বর্তমানে উত্থাপিত হয়েছে সেগুলো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের টাস্কফোর্স ও কমিশনগুলোও কিছু পেশ করেছেন। কিছু সুপারিশ প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। অর্থনীতির হালহলিকতের ওপর যে শ্বেতপত্র প্রকাশিত হয়েছে তার বিভিন্ন তথ্য নিয়েও পক্ষ-বিপক্ষে নানা আলোচনা রয়েছে। এগুলো সম্পর্কেও কিছু সংক্ষিপ্ত প্রাসঙ্গিক মন্তব্য এ প্রবন্ধে তুলে ধরা হবে।

 

 

১.১ শ্বেতপত্রের টিওআর এবং প্রথমদিকের মতবিনিময় সভায় বলা হয়েছিল যে অর্থনীতির বিগত সরকারি হিসাবগুলো সঠিক নয়। তাই বাস্তব অবস্থা কতখানি খারাপ ও ফোঁপড়া করে স্বৈরাচারী সরকার রেখে গিয়েছিল তা সঠিকভাবে নির্ণয় করার চেষ্টা করা হবে। অর্থনীতিতে যেসব দুর্নীতি হয়েছিল তার সুনির্দিষ্ট নাম উল্লেখ না করে প্রক্রিয়া ও ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হবে।

 
 

বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত—Beyer R., and Hussian z. (2021) ‘‘validating GDP estimates in bangladesh’’ bangladesh C.E.M background paper (Bangladesh country economic memoradiun- change of fabric) September, 2022. গ্রন্থটির মডেল ও স্টাডি ব্যবহার করে দেখানো হয়েছে বা দাবি করা হয়েছে যে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার যতখানি অতীতে দেখানো হয়েছিল সরকারি পরিসংখ্যানে আসলে বাস্তবে তা হয়নি। সেজন্য বিশ্বব্যাংকের একটি অত্যাধুনিক মডেল ব্যবহার করা হয়েছে। সম্প্রতি এ মডেলের কিছুটা সমালোচনা ও মার্জনা Nick Lea (Former Depuaty Chief Economist, Foreign ComonWealth and Development Office) মন্তব্য করেছেন, ‘‌Firstly the claimed overestimation of GDP Should be treated with caution, but even if accurate, would lessen but not erase Bangladesh’s valuable long term growth... Nevertheless, if we propagate the model’s growth rates, we get a GDP (or GDP per capital) that is 32% less than the reported figure... hence even if correct, Bangladesh Would still be a middle- icome country, but with a true GDP per capital of around $1794 in 2024, rather than $ 2625. Since 1980, this means that GDP per capita would have nearly tripled rather than roughly quadrupled. Still a record that most developing countries would envy. [ DrmÑ Economic Policy Network, the Blavatnik School of Govt, University of Oxford]

 

 

 

১.২ মডেল থেকে প্রাপ্ত নিচের তালিকাটির বিভিন্ন পরিমাণগত দিক নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে তবে প্রকৃত বেঞ্চমার্কগুলো যে সরকারি সংখ্যার চেয়ে অনেক নিচে হবে তা নিয়ে সম্ভবত বিতর্ক নেই। তবে এর মানে বিগত সরকারের সবকিছুই ঠিক ছিল না—সেটাও সত্য নয়। সম্প্রতি রেহমান সোবহান মন্তব্য করেছেন—দুর্নীতি ও বৈষম্য চরমভাবে বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও আসলে কীভাবে চরম দারিদ্র্য হার কমল ও মানব উন্নয়ন সূচকগুলোয় উন্নতি অর্জিত হলো—সেটি বর্তমান উন্নয়নবিদদের তলিয়ে দেখা দরকার। কিছুই অর্জিত হয়নি—এ কথা যেমন সত্য নয়—কিন্তু যেটুকু অর্জন সম্ভব ছিল তা অনেকখানি দুর্নীতি ও বৈষম্যের কারণে অর্জন করা যে সম্ভব হয়নি তা আজ সবাই স্বীকার করেন।

 

 

সুতরাং স্বভাবতই বোঝা যাচ্ছে আগামী যে বাজেট অন্তর্বর্তী সরকার প্রণয়ন করতে যাচ্ছে তাতে তাদের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে—

প্রথমত, কীভাবে বৈদেশিক খাতে উদ্বৃত্ত ব্যালান্স তৈরি করে ক্রমবর্ধমান ডলার রিজার্ভ তারা তৈরি করবে বা করার সূচনা করবে? নতুন ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাণিজ্য, বৈদেশিক ঋণ ও বিনিয়োগ নীতি কী হবে? দ্বিতীয়ত, বাজেটে যে প্রচুর রাজস্ব ঘাটতি থাকবে তা কীভাবে পূরণ করবে?

 

 

তৃতীয়ত, ব্যক্তি বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির হারকে যথাসম্ভব ধরে রাখা যায় কীভাবে তার উপায় উদ্ভাবন অর্থাৎ বিনিয়োগ আবহাওয়ার উন্নতি করে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি কীভাবে অব্যাহত রাখবে? চতুর্থত, মুদ্রাস্ফীতি ও মন্দা দুই-ই কাটিয়ে অর্থনীতিতে কীভাবে সামষ্টিক স্থিতিশীলতা আনবে?

 

 

সর্বশেষ, কয়েকটি চিহ্নিত খাতে সুশাসন কীভাবে প্রতিষ্ঠিত করবে—নতুন প্রতিষ্ঠান ও নতুন সৎ ও দক্ষ মানবসম্পদ কোথায় পাবে, যাতে শুধু ভালো আইন বা নীতিই প্রণীত হবে না তা বাস্তবায়িতও হবে।

 

 

নিঃসন্দেহে এগুলো খুবই চ্যালেঞ্জিং ও পুঞ্জীভূত কঠিন সমস্যা। কিন্তু এগুলোর জন্য যেসব জরুরি নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন—বিশেষত আর্থিক খাত, জ্বালানি খাত, আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় যেসব আশু জরুরি সংস্কার শুরু করা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে তা অন্তত শুরু না করতে পারলে জনগণের মনে প্রয়োজনীয় বিশ্বাস, আস্থা বা ‘স্বস্তি’ ফিরিয়ে আনা যাবে না এবং গোলযোগ ও সামাজিক বিরোধ আরো বৃদ্ধি পাবে। যার সুস্পষ্ট লক্ষণ এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে।

 

 

১.২ সুশাসনের ও শৃঙ্খলার জন্য যে সমস্যাগুলো জরুরিভাবে মোকাবেলা করা দরকার ছিল সেগুলো হচ্ছে নিম্নরূপ—

১. জুলাই আন্দোলনকালে নিহত-আহতদের একটি সুস্পষ্ট সঠিক তালিকা প্রণয়ন, চিকিৎসা প্রদান এবং পুনর্বাসন।

২. যেসব পুলিশ, শিক্ষা কর্মকর্তা, আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য কমবেশি অভিযুক্ত হয়েছেন—তাদের এখন নিরপেক্ষ সুষ্ঠু তালিকা প্রণয়ন করে এদের মধ্যে যারা নির্দেশ পালনে বাধ্য হয়েছিলেন অথবা যাদের অপরাধ লঘু ও Ignore করা যায় তাদের শনাক্ত করে তাদের মব জাস্টিসের মধ্যে ফেলে না দিয়ে একটি সুষ্ঠু ন্যায়বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার প্রয়োজন রয়েছে।

 

 

৩. ব্যক্তি বা দলীয় গ্রুপের হাতে, রাস্তাঘাটের শক্তির হাতে আইন না তুলে দিয়ে সুষ্ঠু ও দ্রুত বিচারের পদক্ষেপ নিতে পারলে দেশে কিছুটা শৃঙ্খলা এরই মধ্যে ফিরে আসত। পুলিশও আস্থা নিয়ে কাজে ফিরে আসতে সক্ষম হতো বলে মনে হয়। প্রথম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হঠাৎ বদল কেন হলেন সেটা স্পষ্ট নয়। সংবিধান কমিশনে কেন একজনকে বদলে বিদেশ থেকে আগত একজনকে নিয়োগ দেয়া হলো তাও বোধগম্য নয়। কেন ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে তাও বোঝা মুশকিল। মূলধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতিবিদদের শক্তিশালী ভূমিকা তৈরি না করে নতুন King’s party তৈরি করতে চাইলে সেটাও কাম্য নয়।

 

 

৪. উপরোক্ত ঘটনাগুলো ছাড়াও আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণগ্রহীতা, শেয়ার কেলেঙ্কারির হোতা, বিদ্যুৎ খাতে ক্ষতিকর দেশী-বিদেশী চুক্তির কমিশনভোগী হোতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ, বৃহৎ মেগা প্রকল্পের চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ ইত্যাদি যাদের নিয়ে শ্বেতপত্রে সাধারণভাবে উল্লেখ রয়েছে কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই যেখানে হয়তো নাম উল্লেখিত হয়নি, সেগুলোর নাম ও অপরাধ প্রকাশ করে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

 

৫. সর্বোপরি টাকা পাচারের যে বিশাল পরিমাণ শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে সেটি কীভাবে উদ্ধার হবে তা বলা কঠিন। এজন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজন হতে পারে। তবে বিগত সরকারের আমলে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই যেভাবে টাকা পাচার হয়ে গিয়েছিল এবং যে মামলা এখনো চলমান তা থেকে আশা করা মুশকিল যে বিদেশে পাচার হওয়া টাকা দ্রুত উদ্ধার হওয়া সম্ভব। বর্তমান বিদেশী ভাড়া করা কোম্পানি ও দুদকের মাধ্যমে এ প্রচেষ্টা চলছে। আমরা অপেক্ষা করে আছি এগুলোর সাফল্যের জন্য। তবে এর ফলে শত্রুদের প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং নতুন বেকারত্ব সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং বিকল্প প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা না করে এদের আঘাত করলে তা হয়তো সামলানো কঠিন হবে। বিশেষত তারা যদি সরকারের মিত্র বাহিনীর মধ্যেই তাদের শ্রেণী মিত্র খুঁজে পান তাহলে রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্য বদলেও যেতে পারে। কিন্তু আমি এ অভিযান থামিয়ে দিতে বলছি না, সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে যেতেই বলছি।

 

 

৬. আশু যে কাজটি এখনো করে ওঠা যায়নি তা হচ্ছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধ। পাশাপাশি নিম্নবিত্তদের বিশেষত শিল্প শ্রমিক, কৃষক ও ক্ষুদ্র ও মাঝারি উৎপাদকদের প্রকৃত আয়ের সুরক্ষা প্রদান করে তাদের দ্রব্যমূল্যের আঘাত থেকে বাঁচানোর চেষ্ট করা উচিত। স্বস্তির জন্য এটা জরুরি।

 

 

৭. বাজারে সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগী কারা—আদৌ তাদের চিহ্নিত করে ভাঙার ক্ষমতা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আছে কিনা। ক্রেতা সমবায় ও বিক্রেতাদের সমবায় তৈরি, রেশন ও ওপেন মার্কেট অপারেশন ও খাদ্যের বিনিময়ে কাজ এবং গ্রাম-শহরে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা স্কিম চালু করা ইত্যাদি সুযোগ এখনো উন্মুক্ত রয়েছে। সৃজনশীল নতুন-পুরনো অনেক সংস্কার প্রস্তাব রয়েছে—এসব নতুন ধরনের অচিরায়ত কোনো পদক্ষেপ এখনো দৃশ্যমান নয়।

 

 

১.৪ এ প্রবন্ধের উপসংহারে এসে যেটা বলব তা হচ্ছে বাংলাদেশে যে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং যার পরিপূরক হিসেবে রাজনীতিতে স্বৈরাচারী কর্তৃত্ব ও ফ্যাসিস্টসুলভ প্রবণতা তৈরি হয়েছে তা থেকে রাতারাতি মুক্তি পাওয়া কঠিন।

 

 

এর পরও অর্থনীতিতে প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলোর কথা বহুদিন ধরেই আলোচিত হচ্ছে। কীভাবে নিদেনপক্ষে একটি গণতান্ত্রিক অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি গড়ে তোলা যায় তা নিয়ে দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীরা ১৯৯০ সালেই এরশাদকে হটানোর পর ২৮টি টাস্কফোর্স রিপোর্ট প্রণয়ন করেছিলেন। সেখানে অনেক ভালো ভালো সুপারিশ ছিল।

 

 

অধ্যাপক রেহমান সোবহান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে সেগুলো প্রণয়নে কোনো বাড়তি অর্থ খরচ না করেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের এগুলো প্রথমে বিএনপি সরকার ও পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার কেউই গ্রহণ ও বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। প্রশ্ন তাই থেকেই যায় যে এবারো এ রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার না হলে অথবা বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার বিকল্প শক্তি জনগণের মধ্যে তৈরি না হলে সে ক্ষেত্রে এবারো সংস্কার অভিযাত্রা কতদূর অগ্রসর হবে?—মাঝপথে কি থুবড়ে পড়বে না?

 

 

ভবিষ্যৎ যত অনিশ্চিতই মনে হোক না কেন অন্তত দেশে যেন মুক্তিযুদ্ধের মতো মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে কোনো নতুন বাগ্‌বিতণ্ডা গৃহযুদ্ধ না হয়—সেটাই কাম্য।

 

 

এমএম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়