কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বাংলাদেশের নিরাপত্তা : চীন, তুরস্ক, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন জরুরি

ইব্রাহীম খলিল (সবুজ) [প্রকাশ: সময়ের আলো, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৫]

বাংলাদেশের নিরাপত্তা : চীন, তুরস্ক, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন জরুরি

বর্তমান সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এক অস্থির সময় পার করছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। ভারত কেবল একটি বিশাল রাষ্ট্রই নয়, বরং এটি একটি পরমাণু শক্তিধর দেশ। 

 



ভৌগোলিক অবস্থানের দিকে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশ প্রায় তিন দিক থেকে এই শক্তিশালী প্রতিবেশী দ্বারা পরিবেষ্টিত। বঙ্গোপসাগরেও রয়েছে তাদের নৌবাহিনীর একক আধিপত্য। এই বাস্তবতা যেমন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই, তেমনি সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে কেবল একটি রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল থাকা বা নতজানু হয়ে থাকা কোনো বুদ্ধিমান রাষ্ট্রনীতি হতে পারে না।​ 

 



এই প্রতিকূল ভৌগোলিক বাস্তবতায় নিজেকে রক্ষা করতে এবং ভারতের সম্ভাব্য ‘থ্রেট’ বা প্রভাব মোকাবিলা করতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই ‘কৌশলগত ভারসাম্য’-এর পথে হাঁটতে হবে। যদি কোনো কারণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয় তবে একা লড়াই করা আমাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন হবে। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে চীন, তুরস্ক এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করা এখন অত্যন্ত জরুরি। এই তিনটি দেশের সঙ্গে শক্তিশালী কৌশলগত ও সামরিক সম্পর্ক থাকলে ভারতের মতো বড় শক্তির থ্রেট মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।

 



প্রথমে চীনের কথা বিবেচনা করা যাক। চীন বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম প্রধান সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি। বাংলাদেশের সামরিক শক্তির প্রধান উৎস হলো চীন। আমাদের সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক থেকে শুরু করে নৌবাহিনীর সাবমেরিন পর্যন্ত সবকিছুই প্রায় চীনের দেওয়া। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আমাদের প্রচুর পরিমাণে আধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদের প্রয়োজন হবে। চীন সেই অস্ত্রের সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারে। 

 



সামরিক দিক থেকে চীন ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। ভারতের সঙ্গে চীনের দীর্ঘ সীমান্ত বিরোধ রয়েছে। যদি বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে একটি গভীর প্রতিরক্ষা চুক্তি থাকে তবে ভারত কখনোই আমাদের ওপর পূর্ণ শক্তিতে আক্রমণ করার সাহস পাবে না। কারণ ভারত জানে যে বাংলাদেশের ওপর হামলা করলে চীন উত্তর দিক থেকে তাদের চাপে ফেলবে। চীনের কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট প্রযুক্তি আমাদের গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারে। এতে করে ভারতীয় বাহিনীর অবস্থান এবং তাদের গতিবিধি আগেভাগে জানা সম্ভব হবে। এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরে ভারতের আধিপত্য কমাতে চীনের নৌবাহিনীর উপস্থিতি আমাদের জন্য একটি বড় ঢাল হিসেবে কাজ করবে।

 



এরপর আসে তুরস্কের গুরুত্ব। আধুনিক যুদ্ধের ধরন এখন বদলে গেছে। এখন কেবল সৈন্য সংখ্যা দিয়ে যুদ্ধ জয় করা যায় না। বর্তমান যুগে ড্রোন এবং ইলেকট্রনিক যুদ্ধ প্রযুক্তি সবচেয়ে বেশি কার্যকর। তুরস্ক এই প্রযুক্তিতে এখন বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে। বিশেষ করে তুরস্কের তৈরি বায়রাক্তার ড্রোন আজারবাইজান এবং ইউক্রেন যুদ্ধে নিজের সক্ষমতা প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশ যদি তুরস্কের সঙ্গে নিবিড় সামরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে তবে আমরা এই আধুনিক প্রযুক্তিগুলো সহজেই পাব। 

 


ভারতের বিশাল ট্যাঙ্ক বহর এবং বিমানবাহিনীকে মোকাবিলা করতে তুরস্কের ড্রোন প্রযুক্তি আমাদের জন্য গেম চেঞ্জার হতে পারে। তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য এবং মুসলিম বিশ্বের একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র। তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কেবল সামরিক নয়, বরং কূটনৈতিকভাবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুরস্ক বাংলাদেশের পক্ষে বড় জনমত তৈরি করতে সক্ষম। তুরস্কের আধুনিক প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ভারতের সামরিক শ্রেষ্ঠত্বকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেবে। এতে করে যুদ্ধের ময়দানে ভারসাম্য বজায় রাখা সহজ হবে।

 



সবশেষে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি সংবেদনশীল হলেও অত্যন্ত কৌশলী এবং গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় সামরিক দুঃস্বপ্ন হলো দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ। ভারত সবসময়ই চায় পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সঙ্গে আলাদাভাবে মোকাবিলা করতে। কিন্তু বাংলাদেশ যদি পাকিস্তানের সঙ্গে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের সম্পর্ক গড়ে তোলে তবে ভারতের ওপর এক বিশাল মানসিক ও সামরিক চাপ তৈরি হবে। 

 

 



পাকিস্তান একটি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র এবং তাদের বিশাল সামরিক অভিজ্ঞতা রয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী কীভাবে কাজ করে এবং তাদের দুর্বলতাগুলো কোথায় তা পাকিস্তান খুব ভালো করে জানে। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য শেয়ার করলে বাংলাদেশ অনেক সুবিধা পাবে। 

 



ভারত যখন দেখবে যে তাদের দুই সীমান্তের রাষ্ট্রগুলো একে অন্যের সঙ্গে সামরিকভাবে যুক্ত তখন তারা কোনো হটকারী সিদ্ধান্ত নিতে সাহস পাবে না। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার অর্থ হলো ভারতকে সবসময় তার পশ্চিম সীমান্তে বিশাল সৈন্য মোতায়েন রাখতে হবে। ফলে তারা বাংলাদেশের সীমান্তে তাদের পুরো শক্তি প্রয়োগ করতে পারবে না। এটি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবে।

 



কূটনৈতিক দিক থেকেও এই তিনটি দেশের গুরুত্ব অপরিসীম। ভারত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের একটি বড় শক্তি হিসেবে জাহির করে। কিন্তু চীন যদি বাংলাদেশের পক্ষে থাকে তবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভারত কখনোই সুবিধা করতে পারবে না। 

 



অন্যদিকে তুরস্ক এবং পাকিস্তান ওআইসি বা ইসলামিক দেশগুলোর জোটে বাংলাদেশের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিতে পারবে। এর ফলে ভারত আন্তর্জাতিকভাবে একা হয়ে পড়বে। কূটনৈতিক চাপ ভারতের আগ্রাসী মনোভাবকে দমন করতে সাহায্য করবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হওয়া উচিত এমন- যেখানে এই তিনটি শক্তিশালী রাষ্ট্র আমাদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি হিসেবে কাজ করবে।

 



পরিশেষে বলা যায় যে জাতীয় নিরাপত্তা কোনো আবেগের বিষয় নয়। এটি সম্পূর্ণ বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করতে হয়। ভারত আমাদের তিন দিক থেকে ঘিরে রাখলেও আমাদের এই তিন মিত্র দেশ ভারতের সেই সুবিধাকে পণ্ড করে দিতে পারে। চীন আমাদের দেবে বিশাল সামরিক শক্তি ও অস্ত্রের জোগান। তুরস্ক আমাদের দেবে আধুনিক প্রযুক্তির ড্রোন ও বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। 

 



আর পাকিস্তান আমাদের দেবে কৌশলগত গোয়েন্দা তথ্য এবং ভারতকে দুদিক থেকে ব্যস্ত রাখার সুযোগ। এই তিন শক্তির সঙ্গে সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পারলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব চিরস্থায়ী হবে। কোনো বৃহৎ শক্তিই তখন বাংলাদেশের দিকে বাঁকা চোখে তাকানোর সাহস করবে না। এই কৌশলগত জোটই হতে পারে আমাদের আগামী দিনের শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ।



লেখক: প্রাবন্ধিক