বাংলাদেশের নতুন ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ
মেহেদী হাসান [সূত্র : আমার দেশ, ০৯ আগস্ট ২০২৫]

আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক আধিপত্যকেন্দ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। পরাশক্তিগুলোর কাছে দিন দিন বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে। ভৌগোলিক এ অবস্থানগত কারণে একদিকে যেমন বাংলাদেশের সামনে রয়েছে অপার সম্ভাবনা, অন্যদিকে তৈরি করেছে বড় ধরনের ঝুঁকি। অনেক দিন ধরে এ সম্ভাবনা ও ঝুঁকি নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চললেও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে তা ঘনীভূত হয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে শক্তিশালী করা ও ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য যে ধরনের দেশপ্রেমিক, দক্ষ আর মেরুদণ্ডসম্পন্ন রাজনীতিক ও কূটনীতিবিদ দরকার ছিল, সেক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে প্রকট শূন্যতা বিরাজ করছে। সে কারণে ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের সুবিধা আদায়ের পরিবর্তে ঝুঁকি ও বিপদের মাত্রা ভারী হচ্ছে।
বর্তমানে বিশ্বে প্রধান দুই শক্তি হলো যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। আর এই দুই শক্তি সামরিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও ভৌগোলিক আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তীব্র বিরোধে লিপ্ত, যা প্রায়ই সশস্ত্র সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি করছে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ের তীক্ষ্ণ নজর আকৃষ্ট করেছে বাংলাদেশ। অপরদিকে আবার বাংলাদেশকে পুরোপুরি পদানত করতে যারপরনাই চেষ্টা করে যাচ্ছে ভারত। এ অবস্থায় বাংলাদেশ যদি সঠিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে বড় ধরনের বিপদ অপেক্ষা করছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
মাফিয়া শাসক শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতি বলতে কিছু ছিল না। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সরাসরি পরিচালিত হতো দিল্লি থেকে। বাংলাদেশকে এতই নিচে নামানো হয়েছিল যে, পতনের আগে শেখ হাসিনার চীন সফরের ক্ষেত্রেও দিল্লি থেকে অনুমতি আসতে হয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো পরিণত হয়েছিল দলের প্রচার কার্যালয়ে। ফলে দীর্ঘ দেড় দশকে বাংলাদেশে প্রকৃত অর্থে দক্ষ কূটনীতিক তৈরি হতে পারেনি। দলবাজি, নোংরামি আর নিজের আখের গোছানোই মূলত ছিল তাদের প্রধান কাজ। ছাত্র-জনতার এত বড় বিপ্লবের পরও এখনো মূলত সেই তাদের দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যা দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছু নয়। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো পরাশক্তির মধ্যে বর্তমানে যে প্রতিযোগিতা চলছে, তা মোকাবিলার ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার খবর ইতোমধ্যে প্রকাশ্যে এসেছে।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধাকে দেশের কল্যাণে কাজে লাগানোর পরিবর্তে শেখ হাসিনা তার নিজের, পরিবারের, দলের ও ভারতের স্বার্থ আদায়ের হাতিয়ারে পরিণত করেছিলেন। টানা সাড়ে ১৫ বছর শাসনামলে মাফিয়া শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ছেড়ে দিয়েছিলেন ভারতের হাতে। এ অবস্থায় ভারত বাংলাদেশের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে তার যাবতীয় সুবিধা আদায় করে নেয় এবং চীন দূরে সরে যেতে বাধ্য হয়। ফলে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানগত সম্ভাবনা মাটিচাপা পড়ে। কিন্তু চব্বিশের বিপ্লবের পর আবার অপার এক সম্ভাবনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। দিল্লি-নিয়ন্ত্রিত মাফিয়া শাসক শেখ হাসিনার বিদায়ের পর বাংলাদেশ এখন ভারতের আধিপত্য থেকে মুক্ত। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাত ধরে আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ঘিরে তৈরি হয়েছে অনেক সম্ভাবনা, তৈরি হয়েছে অনেকের অনেক আগ্রহ।
বাংলাদেশ ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের প্রতিযোগিতা এবং মুখোমুখি অবস্থানের বিষয়টি সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে বাংলাদেশ যেন চীনের প্রতি অধিক নির্ভরশীল হয়ে না পড়ে। সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে চীন থেকে পণ্য আমদানি কমানোসহ আরো অনেক বিষয়ে। বাংলাদেশ চীন থেকে জে-১০সি যুদ্ধবিমান কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ বিষয়ে ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের এক কূটনীতিক গণমাধ্যমের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। গত ১৯ জুন চীনের কুনমিংয়ে চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের খবরে যুক্তরাষ্ট্র এতটাই উদ্বিগ্ন যে, ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস থেকে রীতিমতো ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে জানিয়ে দিয়েছে, চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। বাংলাদেশের বন্দর, জেটি ও জাহাজে ব্যবহৃত চীনের তৈরি লজিস্টিকস সিস্টেম লগিঙ্ক ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে বলছে যুক্তরাষ্ট্র।
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এ আচরণ ও তৎপরতার সঙ্গে মিল রয়েছে ভারতের অতীত তৎপরতার। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র যা চাইছে, তা যদি বাংলাদেশ মেনে চলে, তা মূলত ভারতেরই হীন উদ্দেশ্য সাধন করবে। ভারত গত ১৬ বছরে বাংলাদেশকে চীন-পাকিস্তানসহ সমগ্র বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। বাংলাদেশে দেড় যুগ ধরে হাসিনার শাসন টিকিয়ে রাখার পক্ষে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যেসব যুক্তি তুলে ধরেছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল হাসিনা না থাকলে বাংলাদেশ চীনের বলয়ে চলে যাবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের প্রধান লক্ষ্য ও ঘোষিত নীতি হলো ‘আমেরিকা ফার্স্ট।’ বাণিজ্য ঘাটতি কমানো, নিজ দেশের বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা এবং শিল্পের বিকাশে গোটা বিশ্বের বিরুদ্ধে তারা শুল্কযুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সে হিসেবে ১৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশ চীনা পণ্য কেনা কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য কেনা বৃদ্ধি করুক, সেটা চাওয়া দোষের নয় ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য। কিন্তু চীন থেকে যুদ্ধবিমান কেনা এবং ভারতীয় আগ্রাসন ও আধিপত্য মোকাবিলায় চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশ ত্রিদেশীয় বলয় তৈরির বিষয়ে ঢাকার ওপর ওয়াশিংটনের চাপ সৃষ্টি বাংলাদেশের জন্য অস্বস্তিকর। বাংলাদেশ-চীন এ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের হস্তক্ষেপের বিষয়ে বেইজিং যে প্রশ্ন তুলেছে তা অমূলক নয়।
তবে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার সাফল্য প্রমাণ করছে, বাংলাদেশ ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মুখোমুখি যে অবস্থান সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের হাতে এর সমাধান রয়েছে।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ট্রাম্প প্রশাসনকে প্রথমেই যেটি বোঝাতে হবে তা হলো, পরপর দুবার ওবামা প্রশাসন এবং সর্বশেষ বাইডেন প্রশাসন পর্যন্ত টানা সাড়ে ১৫ বছর ওয়াশিংটন ঢাকাকে নয়াদিল্লির হাতে ছেড়ে দেওয়ায় এবং দীর্ঘকাল ওয়াশিংটন ঢাকাকে নয়াদিল্লির চোখ দিয়ে দেখায় বাংলাদেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।
সাড়ে ১৫ বছর নয়াদিল্লি বাংলাদেশকে সামরিক ও সমরাস্ত্র ক্ষেত্রে একটি পঙ্গু রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। সেভেন সিস্টার্সের কারণে ভারত বাংলাদেশকে তার নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি মনে করে এবং সে কারণে ভারত কখনোই চায় না বাংলাদেশ সামরিকসহ সার্বিক ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী দেশ হিসেবে গড়ে উঠুক। সে কারণে ভারতও বাংলাদেশের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য প্রধান হুমকি। তাই সামরিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় শক্তি অর্জন করতে হবে অবশ্যই। বাংলাদেশের আকাশ সম্পূর্ণ অরক্ষিত। নেই কোনো শক্তিশালী অস্ত্র নির্মাণ সক্ষমতা। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি বাংলাদেশ কৌশলগত কারণে চীন থেকেও সহায়তা নেবে, যেমনটা নিচ্ছে পাকিস্তান।
সমরাস্ত্র ক্ষেত্রে চীনের ওপর পাকিস্তানের নির্ভরশীলতা যুক্তরাষ্ট্র যদি মেনে নিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হবে কেন, যেখানে বাংলাদেশ তিন দিক দিয়ে চরম বৈরী রাষ্ট্র ভারত দ্বারা বেষ্টিত?
ঢাকাকে এটি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, নয়াদিল্লির চোখ দিয়ে ওয়াশিংটনের আর ঢাকাকে দেখা চলবে না কোনো অবস্থাতেই। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে নয়াদিল্লির প্রভাবমুক্ত হতে হবে এবং এ বিষয়ে নিশ্চয়তা আদায় করতে হবে। নিশ্চয়তা আদায় করতে হবে, কারণ ভারতীয় আধিপত্য থেকে বাংলাদেশকে রক্ষায় শেখ হাসিনার আমলে বাইডেন প্রশাসন কোনো ভূমিকা পালন করেনি। ২০২৪ সালের শেষ মুহূর্তে উদ্যোগ নিয়েও আবার হাত গুটিয়ে নিয়েছিল ওয়াশিংটন। তাই ভারতীয় আগ্রাসন মোকাবিলায় বাংলাদেশকে চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে হবে।
শুল্ক বাণিজ্য আলোচনার সফলতা একটি উপযুক্ত উদাহরণ যে, উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরতে পারলে ওয়াশিংটন তা অস্বীকার করে না। পররাষ্ট্র ক্ষেত্রেও চালাকি ও গোঁজামিল বাদ দিয়ে ওয়াশিংটনের সব প্রশ্নের উপযুক্ত জবাব দিতে হবে খোলাসা করে, সত্য তুলে ধরতে হবে সাহসের সঙ্গে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র। চলতি বছর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের শীর্ষ রেমিট্যান্স আয়ের দেশও যুক্তরাষ্ট্র। এভাবে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। বাংলাদেশি পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক কমানো ঢাকার প্রতি ওয়াশিংটনের ইতিবাচক মনোভাবের পরিচায়ক। বেইজিংও অবশ্যই বোঝে ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্বের বিষয়টি। চীন-যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন ইস্যুতে যুদ্ধংদেহি, কিন্তু তারপরও যুক্তরাষ্ট্র হলো চীনের প্রধান রপ্তানি বাজার।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে দৃঢ়ভাবে মনে রাখতে হবে, কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের দয়ায় তারা ক্ষমতায় বসেনি। সুতরাং কারো চাপের কাছে কোনো অস্থাতেই নতিস্বীকার নয়, বরং চাপকে বন্ধুত্বে পরিণত করার হিম্মত, মেধা ও দক্ষতা প্রদর্শনের সময় এসেছে। জাতীয় স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র-চীন উভয়ের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় দক্ষ ও ঝানু কূটনীতির কোনো বিকল্প নেই। এজন্য বাংলাদেশের এখন সর্বাগ্রে প্রয়োজন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংস্কার ও জরুরি ভিত্তিতে দক্ষ দেশপ্রেমিক কূটনীতিক হাজির করা, যেমন খুঁজে আনা হয়েছে ড. খলিলুর রহমান ও আশিক চৌধুরীর মতো মেধাবী দেশপ্রেমিকদের।
লেখক : সহকারী সম্পাদক, আমার দেশ