কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কিছু কথা

আবুল কাসেম ফজলুল হক । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কিছু কথা

বাংলাদেশে কি এখন কোনো রাজনৈতিক নেতা আছেন? নেতার বৈশিষ্ট্য কী? শুধু ক্ষমতালিপ্সার চরিতার্থতা আর নানা কৌশলে রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে একান্ত ভোগবাদী ও সুবিধাবাদী চিন্তা-চেতনা নিয়ে অনুচিত ও অবৈধ উপায়ে দেশে-বিদেশে বিপুল সম্পত্তির মালিক হওয়া—এটাই কি নেতার মূল বৈশিষ্ট্য? যাঁরা ১৯৭২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন, তাঁরা ক্ষমতায় থেকে কী রকম রাজনৈতিক চরিত্রের পরিচয় দিয়েছেন? ক্ষমতার বাইরে থাকাকালে তাঁরা কেমন ছিলেন? বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের ও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আত্মজিজ্ঞাসার, আত্মসমালোচনার ও আত্মশুদ্ধির কোনো অনুশীলনের তথ্য তো খুঁজে পাওয়া যায় না। কোনো শিক্ষা ছাড়া, অনুশীলন ছাড়া আপনিতেই কি রাজনৈতিক নেতা হওয়া যায়?

 

 

মানুষ কি জন্মগতভাবেই ভালো? মানুষ কি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ভালো কাজ করে? মনুষ্যত্ব, মানবতা, মানুষের স্বরূপ বা মানবপ্রকৃতি কেমন? রাজনৈতিক নেতাদের স্বভাবই বা কেমন? সবই কি জন্মগত? স্বতঃস্ফূর্ত? রাজনীতির প্রকৃতি ও সর্বজনীন কল্যাণ সম্পর্কে এ ধরনের প্রশ্নাবলির উত্তরও সন্ধান করা একান্ত দরকার। বাংলাদেশে রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে যা কিছু বলা হচ্ছে এবং করা হচ্ছে, তা প্রায়ই সর্বসাধারণের জন্য কল্যাণকর নয়। রাজনীতিকে সর্বসাধারণের জন্য কল্যাণকর করে তুলতে হলে এ ধরনের মৌলিক প্রশ্নাবলির উত্তর সন্ধান করে চিন্তার ও কাজের প্রকৃতি বদলাতে হবে এবং উন্নততর নতুন চিন্তা ও নতুন কাজের ধারা সৃষ্টি করতে হবে।

 


বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কিছু কথাবাংলাদেশের রাজনীতি রাষ্ট্রের ভেতরকার রাজনৈতিক নেতাদের ও রাজনৈতিক দলগুলোর আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। রাষ্ট্রে সামরিক আইন জারি হলে, জরুরি অবস্থা ঘোষিত হলে, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতাসীন হলে রাজনীতিবিদরা এবং রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রের রাজনীতিকে নিজেদের আয়ত্তের মধ্যে রাখতে পারেন না। যত সময় যায় ততই বোঝা যায় যে রাষ্ট্রের রাজনীতি নানাভাবে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিগুলোর আয়ত্তে চলে যায়। উপনিবেশায়নের এই পদ্ধতিই বাংলাদেশে এখন প্রচলিত রয়েছে।

 


অত্যুন্নত বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নিয়ে রাজনৈতিক দিক দিয়ে মানবপ্রজাতি আজ এই ধারায় চলছে। এর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়েছে।
বাংলাদেশে রাজনীতি এখন যে রূপ ও প্রকৃতি নিয়ে চলছে, তাতে রাষ্ট্র ক্রমেই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। দেশে কৃষি উৎপাদন বেড়েছে, গ্যাস, তেল, কয়লা ইত্যাদি খনিজ সম্পদ আছে।

 

 

কিন্তু মনের দিক দিয়ে, নৈতিক দিক দিয়ে মানুষের কোনো উন্নতি হয়নি। তার ফলে সমস্যাগুলো সংকটে রূপ নিচ্ছে। অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশে এখন একটা সম্ভাবনাময় ক্রান্তিকাল চলছে। এ অবস্থায় যুগান্তরের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে হবে। করোনাভাইরাস, ডেঙ্গুর প্রকোপ, যুদ্ধ ইত্যাদির ফলে দুনিয়াব্যাপী দরিদ্র মানুষ কোনোক্রমে বেঁচে আছে।

 

 

নারী-নির্যাতন, হত্যা-আত্মহত্যা বেড়ে চলছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে গতরখাটা মানুষ এবং নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষেরা নিদারুণ কষ্টের মধ্যে আছে। এভাবেই কি চলবে? না, এভাবে চলবে না। পরিবর্তন অনিবার্য। চাই শুভকর পরিবর্তন। বাংলাদেশে রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারের কথা প্রচার করা হচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করে ভারতের আগরতলায় পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারের কথাটা বড় করে বলা হচ্ছে।

 

কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতা সংস্কারের কথার সূত্রপাত করেননি। দেশের কোনো বুদ্ধিজীবীও রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা পরিচ্ছন্নভাবে সামনে আনেননি। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ অরাজনৈতিক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের থেকে কথাটা সামনে এসেছে বা আনা হয়েছে। ছাত্র-তরুণদের আন্দোলনের মধ্যে আত্মরক্ষার আন্তরিক তাগিদবশে শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করেন। এই ঘটনা শুধু আওয়ামী লীগেরই নয়, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বিভিন্ন বামপন্থী দল, বিভিন্ন ইসলামী দল—সবারই চরম ব্যর্থতার পরিচায়ক।

 

 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা এবং রাজনৈতিক দলগুলো এখন যে দুরবস্থায় নিপতিত, তা থেকে তাদের উত্থান মামুলি ধারার রাজনীতি দ্বারা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। অরাজনৈতিক নির্দলীয়-নিরপেক্ষ বিশিষ্ট নাগরিকরা শুধু জাতীয় সংসদের নির্বাচন সম্পন্ন করেই ক্ষমতা ছেড়ে যাবেন কেন? এ রকম প্রশ্ন সারা দেশেই কিছু লোকের আড্ডায়, খোশ-আলাপে তর্ক-বিতর্কে দেখা দেয় বলে শোনা যায়। এটা কি কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার?

 

 

রাজনৈতিক নেতাদের এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড দেখে জনসাধারণ রাজনীতির প্রতি আস্থাহীন। এই বাস্তবতায় অরাজনৈতিক নির্দলীয়-নিরপেক্ষ বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে সরকার গঠনের চিন্তা অনেকেই করছেন। এই চিন্তার ধারা যদি জয়যুক্ত হয়, তাহলে বাংলাদেশ কোন গন্তব্যের দিকে চালিত হবে?

 

 

রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার ছাড়া চলমান ধারায় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কিভাবে কত দিন চলতে পারবে? সংস্কার কথাটা বলা সহজ, সাধন করা অত্যন্ত দুরূহ। যাঁরা কোনো জাতির কোনো সংস্কার দেখেছেন কিংবা কোনো কোনো জাতির রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারের কথা ইতিহাসে পাঠ করেছেন, তাঁরা জানেন সংস্কার কত দুঃসাধ্য। বাংলাদেশে রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারসাধন সহজসাধ্য হবে? সভ্য জগতের সর্বত্রই মানুষের মনমানসিকতা, আশা-আকাঙ্ক্ষা বদলে গেছে। নানাভাবে মানুষের চিন্তা-চেতনা বিকারপ্রাপ্ত হচ্ছে। দুনিয়াব্যাপী রাষ্ট্রব্যবস্থার ও বিশ্বব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটানো হয়নি। কায়েমিবাদীরা সব কিছুকেই নিজেদের কর্তৃত্বে নিয়ে নিয়েছে।

 

 

সর্বসাধারণকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। জনসাধারণকে এখানে-ওখানে কৃত্রিমভাবে জাগিয়ে কায়েমি স্বার্থবাদীরা তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে নিচ্ছে। পৃথিবীর নানা স্থানে যুদ্ধবিগ্রহও ঘটছে। যুদ্ধ লাগানো ও যুদ্ধকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তৎপর আছে। যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের অস্ত্র তৈরি করছে এবং বিক্রি করছে। অস্ত্রের ব্যবসাই যুক্তরাষ্ট্রের বড় ব্যবসা। যুক্তরাষ্ট্র উদ্যোগী হয়ে নানা রকম যুদ্ধজোট গঠন করেছে। যেমন ন্যাটো। যুদ্ধ বন্ধ করাকে মানবপ্রজাতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য রূপে গণ্য করা অপরিহার্য।

 

 

যদি সব রাষ্ট্রের জনগণ যুদ্ধবিরোধী প্রচার-আন্দোলন চালায়, তাহলে কোনো না কোনো সময় যুদ্ধ বন্ধ হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫) পর থেকে ইউরোপের জাতিগুলোর মধ্যে যে যুদ্ধবিরোধী প্রচার-আন্দোলন ছিল তা ১০-১২ বছর যেতে না যেতেই শেষ হয়ে যায়। উন্নত ভবিষ্যতের জন্য পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করে শুধু রাষ্ট্রসংঘের কর্তৃত্বে একটি সেনাবাহিনী রাখলে সভ্যতার ধারায় প্রকৃষ্ট উন্নতিশীলতা সম্ভব হবে।

 

 

রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার আমূল পুনর্গঠন দরকার। গণতন্ত্রকে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের মধ্যে। এটা শতকরা ৯০ জন মানুষের জন্য কল্যাণকর নয়। আমরা চাই সর্বজনীন গণতন্ত্র। প্রত্যেক জাতিকেই নিজ নিজ ইতিহাস-ঐতিহ্যের ভিত্তিতে সর্বজনীন গণতন্ত্রের রূপ ও প্রকৃতি নির্ধারণ করা দরকার। এর জন্য দরকার চিন্তাচর্চা ও লেখালেখি। বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয় নিয়ে চিন্তাচর্চা ও লেখালেখি দরকার।

 

 

বিশ্বব্যবস্থার ক্ষেত্রে দরকার জাতিসংঘের নাম রাষ্ট্রসংঘ করে তার কর্মক্ষেত্র নির্ধারণ করা। রাষ্ট্রসংঘ কাজ করবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে যেসব বিরোধ দেখা দেয়, শান্তিপূর্ণ উপায়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সেগুলো মীমাংসা করা, যুদ্ধ লেগে গেলে তা বন্ধ করা, যুদ্ধের সম্ভাবনা নিরসন করা, জাতিরাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করা ইত্যাদি।

 

 

বাংলাদেশের বেলায় এবং অন্য সব রাষ্ট্রের বেলায়ও নিজ নিজ ঐতিহ্যের ভিত্তিতে সর্বজনীন গণতন্ত্রের ধারণা স্পষ্টভাবে রচনা করে নেওয়া। দলভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারায় সরকার গঠনের পদ্ধতি নির্ধারণ করা। তাতে রাজনৈতিক দল গঠনের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া জনগণের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উন্নতির কর্মসূচি নির্ধারণ করা। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় জীবনে গণতন্ত্র কায়েম করা। গণতন্ত্র একটি বিকাশশীল ধারণা।

 

 

দেশ-কালের বিভিন্নতায় সর্বজনীন গণতন্ত্রের ধারণাকেও বিকাশশীল রাখতে হবে। গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা ও জনজীবনকে বিবেচনায় নিয়ে সর্বজনীন কল্যাণে রাষ্ট্রীয় সব ব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করা। আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষার দেশে জনপ্রবাহের যে অগ্রগতি, তার ইতিহাস জানতে হবে। রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিকাশধারার স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ও তার ইতিহাস মনে রেখে বর্তমান বাস্তবতার বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে উন্নতি সাধনের পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রণয়ন করে কাজ করতে হবে।

 

 

বর্তমানে রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারের যেসব কার্যক্রম চলছে, সেগুলোকে আমরা অভিনন্দিত করি। সর্বজনীন কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা ও কর্মসূচিকে সহায়তা করা অপরিহার্য। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যারা নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে, তাদের উন্নতি সাধনেও যথোচিত গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের বিবেচনার বাইরে রেখে রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার সাধন সমীচীন নয়।

 

 

ছাত্র-তরুণরা আন্দোলনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, তাতে রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারের বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছে। এই সুযোগ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও আছে। ছাত্র-তরুণদের থেকেও উন্নত রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব আশা করি। রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্পর্কে ভাববিনিময় একান্ত দরকার। পত্রিকা ও বইপত্র দরকার। কোনোটাই বাস্তবে প্রায় নেই। সম্ভাবনা আছে। মহান লক্ষ্যে সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চিন্তা ও উদ্ভাবন দরকার। আর চিন্তার সঙ্গে কাজও দরকার। চিন্তাবিদদের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের মতবিনিময় দরকার। ভোগবাদ ও সুবিধাবাদ বর্জনীয়। উৎপাদন ও সৃষ্টিতে সবারই মনোযোগ ও শ্রমশীলতা দরকার।

 

লেখক : বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, সাবেক অধ্যাপক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, বাংলা একাডেমি