কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বাণিজ্য : বাংলাদেশ-জাপান ইপিএ দ্রুত বাস্তবায়ন যে কারণে জরুরি

মাসরুর রিয়াজ। সূত্র : সমকাল, ০১ মে ২০২৫

বাণিজ্য : বাংলাদেশ-জাপান ইপিএ দ্রুত বাস্তবায়ন যে কারণে জরুরি

ইপিএ বাস্তবায়নে বড় বাধাগুলোর একটি বাংলাদেশের সীমিত প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আলোচনা ও বিভিন্ন সংস্কার বাস্তবায়নে আমাদের দক্ষতা এখনও সীমিত। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর ঐকমত্যও বড় চ্যালেঞ্জ। প্রশাসনের রক্ষণশীল মনোভাব ও সমন্বয়হীনতা সংস্কার কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে। দেশীয় শিল্প, বেসরকারি খাত ও নীতিনির্ধারকদের সমর্থন পেতে সুরক্ষাবাদী মনোভাব ত্যাগ করে কৌশলগত উন্মুক্ততায় যেতে হবে, যা পারস্পরিক প্রবৃদ্ধিভিত্তিক অংশীদারিত্বের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। এ ছাড়াও বিনিয়োগের প্রতিকূল পরিবেশ সংকট আরও তীব্র করছে। নীতি নির্ধারণে অনিশ্চয়তা, ২০টিরও বেশি সংস্থার জটিল ও দীর্ঘ অনুমোদন প্রক্রিয়া এবং অস্পষ্ট আইন প্রয়োগ বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে। 

জাপানের সঙ্গে ইপিএ আলোচনায় সাফল্য অর্জনের সুযোগগুলো কাজে লাগাতে বাংলাদেশকে তিনটি ক্ষেত্রে কৌশলগত পদক্ষেপ নিতে হবে।

 

 

ক. আলোচনা কৌশল ও দিকনির্দেশনা 

জাপানের সঙ্গে ইপিএ আলোচনায় বাংলাদেশের বহুমাত্রিক কৌশল গ্রহণ করা উচিত। মানবসম্পদ উন্নয়ন, খাতভিত্তিক সহযোগিতা ও অফিসিয়াল উন্নয়ন সহায়তার (ওডিএ) কৌশলগত ব্যবহারে গুরুত্ব দিতে হবে। জাপান-ফিলিপাইন ও জাপান-থাইল্যান্ড ইপিএ মডেল থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের উচিত আর্থিক বাজার ও খাদ্য নিরাপত্তা খাতে কর্মশক্তির দক্ষতা উন্নয়ন এবং লক্ষ্যভিত্তিক খাত উন্নয়নে সহযোগিতা চাওয়া। এ ছাড়া ওডিএ তহবিল ব্যবহার করে সক্ষমতা বাড়ানোর কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। শুল্ক পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহারের মাধ্যমে শিল্প সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। কৃষি, মৎস্য, অটোমোবাইলসহ সংবেদনশীল খাতগুলোকে অধিক উদারীকৃত বাণিজ্য পরিবেশে রূপান্তরে অনুকূল শর্ত নিশ্চিত করতে হবে।

 

 

খ. বিনিয়োগ খাতের প্রস্তুতি

বাংলাদেশকে ইপিএর পূর্ণ সুবিধা ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিনিয়োগ পরিবেশে ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। নীতিমালা সংস্কার, বাণিজ্য উদারীকরণ ও অবকাঠামো উন্নয়নে মনোনিবেশ করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ডকুমেন্টেশন ও নিয়মকানুন সহজ করার মাধ্যমে রপ্তানি সময় ও ব্যয় কমিয়ে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হবে। চুক্তি বাস্তবায়ন, বিদ্যুৎপ্রাপ্তি ও বাণিজ্যিক ডকুমেন্টেশন প্রক্রিয়ার সরলীকরণ বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করবে। সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা অপরিহার্য। প্রপার্টি রাইটস সুসংহতকরণ, জমি অধিগ্রহণ সহজীকরণ, আইনের আধুনিকীকরণ, দক্ষতা উন্নয়ন, ডিজিটালাইজেশন, মেধাস্বত্ব আইনের কার্যকর প্রয়োগ ও অর্থায়নে প্রবেশাধিকার সম্প্রসারণ করতে হবে।

 

 

গ. কাস্টমস সংস্কার

বাণিজ্যিক দক্ষতা বাড়ানো এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশকে কাস্টমস পদ্ধতিতে ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। কাস্টমস অ্যাক্ট ১৯৬৯-এর অধীনে ‘বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো’ পূর্ণ মাত্রায় চালু করে প্রক্রিয়া সহজ ও অপ্রয়োজনীয় জটিলতা দূর করতে হবে। নতুন কাস্টমস আইন ২০২৩-এ উন্নত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, পোস্ট-ক্লিয়ারেন্স অডিট ও স্বচ্ছতা বাড়ানোর বিধান রয়েছে। এই বিলে ১২০ দিনের মধ্যে কাস্টমস সিদ্ধান্ত প্রদান, স্পষ্ট প্রক্রিয়া নির্ধারণ ও ফি কাঠামোতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়েছে। স্বয়ংক্রিয় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ও ‘ট্রেড ফেসিলিটেশন এগ্রিমেন্ট’ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তিও এতে রয়েছে। দ্রুত এ বিল বাস্তবায়ন হলে বৈশ্বিক বাণিজ্যে দেশের অবস্থান শক্তিশালী ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

 

 

এই ইপিএ শুধু বাণিজ্য চুক্তি নয়। এটি বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতামূলক, বহুমুখী ও সহনশীল অর্থনীতিতে রূপান্তরের কৌশলগত উপকরণ। এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রাক্কালে ঝুঁকি যেমন বেশি, সম্ভাবনাও বিপুল। জাপানের প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনাগত শক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার, অপ্রকাশিত বাণিজ্য সম্ভাবনার সদ্ব্যবহার ও দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির পথ সুগম করতে বাংলাদেশকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। ইপিএর লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে দেশীয় সংস্কার প্রক্রিয়ার সমন্বয়, অংশীজনের সঙ্গে কৌশলগত সম্পৃক্ততা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশ এই অংশীদারিত্বকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেলে পরিণত করতে পারে।

 

 

মাসরুর রিয়াজ: চেয়ারম্যান, পলিসি এক্সচেঞ্জ; সাবেক ঊর্ধ্বতন অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক গ্রুপ