কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বাণিজ্যযুদ্ধে মিত্র চায় সবাই

সাখাওয়াত হোসেন সুজন। সূত্র : দেশ রূপান্তর, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

বাণিজ্যযুদ্ধে মিত্র চায় সবাই

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ছয়বার অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি সরাসরি শুল্ক ও বাণিজ্য সংক্রান্ত জটিলতায়। সম্প্রতি ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে এমন ইতিহাসই তুলে ধরেছেন জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক স্কট রেনল্ডস নেলসন। তিনি বলেন, আজকের মতো এত নির্ভুলভাবে বিশ^ব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সূচনা আমরা বিরলভাবে দেখতে পাই। ২ এপ্রিল চীনের ওপর ১৪৫ শতাংশ মার্কিন শুল্ক এবং বেইজিংয়ের ১২৫ শতাংশ প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপের ফলে, বিশে^র বৃহত্তম দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্ক কার্যকরভাবে স্থবির হয়ে পড়ে। মার্কিন মুদ্রাস্ফীতির আসন্ন ধাক্কা থেকে শুরু করে চীনের মার্কিন ট্রেজারি বন্ড ক্রয়ের সম্ভাব্য বিপরীতমুখী পরিণতি পর্যন্ত আমরা এর পরিণতি এবং প্রভাবগুলো দেখতে শুরু করি। ৫০ শতাংশ পর্যন্ত উচ্চতর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার সংক্ষিপ্তভাবে কার্যকর হওয়ার পরে অন্য দেশগুলো ৯০ দিনের অবকাশ পেয়েছে। তবে বিশ^ব্যাপী হুমকি রয়েই গেছে। শুল্ক ও মন্দার ভয়াবহ ইতিহাস তুলে ধরে ইতিহাসের এ অধ্যাপক সবাইকে সতর্ক করেছেন।

 

 

 

 তিনি বলেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায় সব মার্কিন আমদানি পণ্যের ওপর নতুন করে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার পর, পরিস্থিতি কতটা দ্রুত পতনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কয়েক দিনের মধ্যেই আর্থিক বাজার থেকে কোটি কোটি ডলার মুছে ফেলা হয়। বিনিয়োগকারীরা মার্কিন ডলার এবং মার্কিন বন্ড থেকে অর্থ উত্তোলন শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক সংক্রমণের লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করে। ডোনাল্ড ট্রাম্প বা চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কেউই পিছু হটার কোনো প্রবণতা দেখাননি। তাই তাদের এমন মনোভাবে বিশ^ অর্থনীতি অগ্নিগর্ভে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।এদিকে চীন এবং আমেরিকা দুই বলয়ই চলমান এ বাণিজ্যযুদ্ধে নিজ নিজ মিত্র খুঁজতে শুরু করেছে। তবে ব্যবসায়িক মিত্ররা নিজেদের দিকে তাকিয়ে সব পদক্ষেপ নেবে, এটাই সত্য। আর তাদের বাণিজ্যযুদ্ধ গোটা বিশ^কেই হুমকির মুখে ফেলবে এই কঠিন কথাটা সহজেই অনুমান করা যায়।

 
 

বহুপক্ষীয় বাণিজ্য বজায় রাখার আহ্বান চীনের : মঙ্গলবার চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বহুপাক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থা রক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ বেইজিং মার্কিন শুল্কব্যবস্থা মোকাবিলায় বাণিজ্য অংশীদারদের সমর্থন সংগ্রহ করতে চাইছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামিকে ফোনে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র দেশগুলোর ওপর নির্বিচারে আক্রমণ শুরু করার জন্য শুল্ককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। প্রকাশ্যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম লঙ্ঘন করছে। সেই সঙ্গে অন্যদের বৈধ অধিকার এবং স্বার্থ ক্ষুণœ করছে।’ তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা ব্যাপকভাবে হুমকির মুখে। বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থা রক্ষা করার দায়িত্ব উভয় দেশের। চীন এবং ব্রিটেনকে এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।’ তিনি অস্ট্রিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিয়েট মেইনল-রাইজিঞ্জারের সঙ্গে পৃথক এক ফোনালাপে ওয়াং ইইউকে বহুপাক্ষিক বাণিজ্য রক্ষার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন যে, ‘চীন তাদের সঙ্গে উচ্চ-স্তরের আদান-প্রদান আরও জোরদার করতে ইচ্ছুক।’

 

 

ফোনালাপে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, ‘চীনা পণ্যের ওপর ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়েছে, যার ফলে বেইজিং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের মাধ্যমে প্রতিশোধ নিতে বাধ্য হয়েছে।’ সোমবার বেইজিং দেশগুলোকে তার খরচে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৃহত্তর অর্থনৈতিক চুক্তি করার বিরুদ্ধে সতর্ক করার এবং যদি তারা তা করে তবে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেওয়ার পর ওয়াংয়ের ফোনালাপও করল। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এই মাসের শুরুতে সরাসরি ইইউর কাছে আবেদন করেছিলেন। বেইজিংয়ে স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজকে বলেছিলেন যে, বিশ্বায়ন রক্ষায় চীন এবং ব্লকের একসঙ্গে কাজ করা উচিত। ইইউ বাণিজ্য প্রধান মারোস সেফকোভিচের মার্চের শেষের দিকে সফরের পর বেইজিং এবং ব্রাসেলস নীরবে সমন্বয় জোরদার করেছে, ইভি সরবরাহ শৃঙ্খল বিনিয়োগ এবং কৃষি-খাদ্য বাজার অ্যাক্সেসের সমস্যাসহ বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক কর্মী গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেছে। উভয় পক্ষ চীনের তৈরি বৈদ্যুতিক যানবাহনের ওপর ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণের আলোচনাও পুনরুজ্জীবিত করেছে, একটি সমাধান যা বেইজিং দীর্ঘদিন ধরে গত বছর ব্লকের আরোপিত শুল্কের পক্ষে সমর্থন করে আসছে।

 

 

এশিয়া হারাচ্ছেন ট্রাম্প : এক দশকেরও বেশি সময় ধরে, এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক গতিশীলতা বিপরীত দিকে এগিয়ে চলেছে। ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং প্রতিযোগিতামূলক জাতীয়তাবাদ নিরাপত্তার নিয়শ্চয়তাদাতা হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে আরও শক্তিশালী করেছে। অন্যদিকে চীনের অর্থনৈতিক উত্থান আঞ্চলিক অর্থনীতিগুলোকে একে অপরের সঙ্গে। সেই সঙ্গে চীনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে একত্রিত করেছে এবং তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। ‘এশিয়া হারাচ্ছেন ট্রাম্প’ ফরেন পলিসির এই শিরোনামের নিবন্ধে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এই অঞ্চলের প্রতি মার্কিন নীতি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধারাবাহিকতার ওপর নির্ভরশীল। এটি কি টেকসই নাকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক, মিত্রদের অবজ্ঞা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ব্যবস্থার মূল্যবোধ এবং প্রতিষ্ঠান থেকে পশ্চাদপসরণ এবং চীন থেকে বিচ্ছিন্নতা এই অঞ্চলকে ভয়ংকর ‘হয় অথবা পছন্দ’ করতে বাধ্য করার সংমিশ্রণ তোলা হয়।

 

 

বাণিজ্যের নতুন জ্যামিতিতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্ব-প্রান্তিকীকরণ করছে এবং চীন এই অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশের শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদার হয়ে উঠেছে। আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য এখন মোটের প্রায় ৬০ শতাংশে পৌঁছেছে। মার্কিন ভূমিকা এরই মধ্যে প্রান্তিক হয়ে উঠছিল। এখন ট্রাম্প ইতিমধ্যেই একটি ভঙ্গুর ব্যবস্থাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের বিচ্ছিন্নতা তাদের মধ্যে বিশ্ব জিডিপির ৪৩ শতাংশ এশিয়া জুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যকে ব্যাহত করছে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই, প্রেসিডেন্টের ইচ্ছানুযায়ী আরোপিত এবং আবারও তুলে নেওয়া ব্যাপক শুল্ককে যুদ্ধের অর্থনৈতিক ঘোষণা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। ট্রাম্প অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুরের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তিকে ক্ষুন্ন করছেন।

 

 

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুসারে, প্রশাসনের শুল্ক কৌশল হলো কম শুল্কের জন্য চীনের সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের বিকল্পকে বাধ্য করা। হোয়াইট হাউজের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো যখন বলেছিলেন যে, ভিয়েতনামের মার্কিন শুল্ক শূন্যে নামিয়ে আনার ‘কোনো অর্থ নেই’। তখন তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন, ‘এটি অ-শুল্ক প্রতারণার বিষয়।’ এই মূল্য শৃঙ্খলগুলো শেষ করা অঞ্চলের অর্থনৈতিক কাঠামোকে ছিঁড়ে ফেলবে। এশিয়ান রাষ্ট্রগুলো তাদের মার্কিন শুল্ক কমাতে চুক্তি করার জন্য লাইনআপ করছে আরও মার্কিন তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস কেনা, সামরিক সরঞ্জাম কেনা এবং মার্কিন জাহাজ নির্মাণে সহায়তা করা। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য ঘাটতি দূর করার সম্ভাবনা কম। প্রায় ৩০ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দেশ হিসেবে, শুল্ক কমানো হলেও, যুক্তরাষ্ট্র অনিবার্যভাবে ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ার মতো ছোট, নিম্ন এবং মাঝারি আয়ের দেশগুলোর কাছে বিক্রির চেয়ে বেশি কিনবে। মার্কিন মিত্র দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপান ত্রিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা চীনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এবং চীনা প্রতিবেদন অনুসারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি প্রতিক্রিয়া সমন্বয় করার কথা বলেছে, এটি সময়ের লক্ষণ।

 

 

ইউরোপ চীনের সঙ্গে নতুন অর্থনৈতিক সম্পর্ক অনুসন্ধান করছে, যেমন বৈদ্যুতিক যানবাহন এবং ব্যাটারি কারখানার লাইসেন্স দেওয়া, যেমন স্পেন এবং হাঙ্গেরি করছে। এশিয়ায় এ ধরনের প্রবণতার একটি সূচক হবে যদি চীনের সিপিটিপিপিতে যোগদানের প্রস্তাব জাপান ও অস্ট্রেলিয়া গ্রহণ করে অথবা ইউরোপীয় ইউনিয়ন সিপিটিপিপির সঙ্গে বাণিজ্য ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হয়। এ ধরনের পরিস্থিতি মার্কিন-পরবর্তী নিয়মভিত্তিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে পারে। নতুন নিয়ম এবং প্রযুক্তিগত মান গঠন করতে পারে। চার দশক ধরে মার্কিন-চীন সম্পর্কের মূল চাবিকাঠি এই ব্যবসা-বাণিজ্য এখন বিচ্ছেদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। স্থল, সমুদ্র, আকাশ সব ক্ষেত্রেই কৌশলগত প্রতিযোগিতা কমছে না। তাইওয়ান নিয়েও উত্তেজনা চূড়ান্ত পর্যায়ে। কোনো এশীয় দেশ তাদের মূল্য শৃঙ্খলে চীনা বিনিয়োগকে এড়িয়ে যাবে, চীনা ডিজিটাল নেটওয়ার্ক নিষিদ্ধ করবে অথবা তার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা অস্ত্র এড়িয়ে যাবে? ওয়াশিংটন এক মুহূর্তের নোটিস ছাড়াই চুক্তি ভেঙে ফেলতে ইচ্ছুক হলে, কে তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারে? ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ রাজনীতি কি এশিয়ায় অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক হয়ে পড়া এই অঞ্চলের শীর্ষ পুলিশ হিসেবে মার্কিন ভূমিকা টিকিয়ে রাখবে, নাকি ভাটা পড়বে?

 

 

লেখক: সাংবাদিক