কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বায়ুদূষণ ও জনস্বাস্থ্য: বাংলাদেশ কতটা ঝুঁকিতে?

ড. কবিরুল বাশার । সূত্র : বণিক বার্তা, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বায়ুদূষণ ও জনস্বাস্থ্য: বাংলাদেশ কতটা ঝুঁকিতে?

বায়ুদূষণ আধুনিক বিশ্বের অন্যতম গুরুতর পরিবেশগত সমস্যা। বিশেষ করে বাংলাদেশে বায়ুদূষণ এক ভয়াবহ সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। বায়ুদূষণ আধুনিক বিশ্বের অন্যতম গুরুতর পরিবেশগত সমস্যা। বিশেষ করে বাংলাদেশে বায়ুদূষণ এক ভয়াবহ সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, দূষিত বাতাস শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত নানা রোগসহ হৃদরোগ, স্ট্রোক ও ক্যান্সারের মতো মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোয় বায়ুদূষণের মাত্রা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

 

বিশ্বব্যাপী অক্ষমতা ও মৃত্যুর শীর্ষ কারণ হচ্ছে বায়ুদূষণ। প্রতি বছর প্রায় ৯০ মিলিয়ন মানুষ দূষণে মারা যায়, যার দুই-তৃতীয়াংশই মারা যায় শুধু বায়ুদূষণের কারণে। ডব্লিউএইচওর মতে, বায়ুদূষণ বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর আনুমানিক ৭০ মিলিয়ন লোককে হত্যা করে। মূলত স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের কারণে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পায়। বেশকিছু গবেষণায় দেখা গেছে, দূষিত বায়ু শ্বাস নেয়ার ফলে একজন ব্যক্তির হৃদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ, ফুসফুসের সংক্রমণ এবং ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

 

পৃথিবীতে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান বায়ুমান পর্যবেক্ষণ করে তার তালিকা প্রকাশ করে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আইকিউ এয়ারের তথ্যমতে, গত ফেব্রুয়ারির অনেক দিনই দূষিত নগরীর তালিকায় ঢাকা ছিল ১ নম্বরে। খারাপের দিক থেকে ঢাকা তার শীর্ষ পাঁচে অবস্থান প্রায় প্রতিদিনই ধরে রাখছে। বাংলাদেশে ৬৪ জেলার মধ্যে অল্প কয়েকটি জেলা বাদে প্রায় সব জেলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। শীতকালে বৃষ্টি না থাকার কারণে বাংলাদেশে বায়ুদূষণ সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে যায়। 

 

বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা এবং টেলিভিশন বায়ুদূষণ ও প্রতিকার নিয়ে সোচ্চার। যুগের পর যুগ ধরে বায়ুদূষণ নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, লেখালেখি, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ হলেও উন্নতি হচ্ছে না বায়ুমানের। 

 

বায়ুদূষণের কারণ

বাংলাদেশে বায়ুদূষণের প্রধান কারণ হলো:

ইটভাটা ও শিল্প-কারখানা: বাংলাদেশে প্রচলিত পুরনো প্রযুক্তির ইটভাটা ও বিভিন্ন কলকারখানা বিপুল পরিমাণ ধোঁয়া ও ক্ষতিকর গ্যাস নির্গত করে। এসব ধোঁয়ায় কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন অক্সাইডের মতো ক্ষতিকর উপাদান থাকে, যা বাতাসকে দূষিত করে।

 

 

যানবাহনের ধোঁয়া: পুরনো ও অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। ডিজেল ও অকটেনচালিত যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া কার্বন মনোক্সাইড, লেড ও অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ যুক্ত করে, যা শ্বাসযন্ত্রের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। নগরায়ণ ও

 

নির্মাণকাজ: রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য শহরে অব্যাহত নির্মাণকাজ থেকে প্রচুর ধূলিকণা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। নির্মাণসামগ্রী খোলা ট্রাকে করে স্থানান্তরের মাধ্যমেও প্রচুর পরিমাণে ধূলিকণা বাতাসে মিশে যায়। এসব ধূলিকণা শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে মানবদেহে প্রবেশ করে শ্বাসকষ্ট, ব্রঙ্কাইটিস ও অন্যান্য রোগ সৃষ্টি করে। কৃষিকাজ ও খোলা জ্বালানি ব্যবহার: গ্রামীণ এলাকায় ফসলের অবশিষ্টাংশ পোড়ানো, কাঠ ও কয়লা জ্বালিয়ে রান্নার ফলে বাতাসে ক্ষতিকর কণার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এটি বিশেষ করে শিশু ও নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়।

 

 

বায়ুদূষণের স্বাস্থ্যগত প্রভাব

বায়ুদূষণের কারণে মানবদেহে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। শ্বাসযন্ত্রের রোগ: বায়ুদূষণজনিত কারণে হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, ফুসফুসের সংক্রমণ ও দীর্ঘমেয়াদি অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হৃদরোগ ও স্ট্রোক: গবেষণায় দেখা গেছে, দূষিত বাতাসে দীর্ঘ সময় শ্বাস নিলে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বায়ুদূষণের কণা (PM 2.5) রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে রক্তনালিতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

 

 

ক্যান্সারের ঝুঁকি: বাতাসে থাকা ক্ষতিকর রাসায়নিক ও ধূলিকণা ফুসফুস ক্যান্সারসহ অন্যান্য ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। ডব্লিউএইচও বায়ুদূষণকে ক্যান্সারের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। চোখ ও ত্বকের সমস্যা: বায়ুদূষণের ফলে অনেক মানুষের চোখে জ্বালা, লালচে ভাব ও অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়া ধুলাবালির কারণে ত্বকের বিভিন্ন সংক্রমণও হতে পারে। গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি: গর্ভবতী নারীরা যদি দূষিত বাতাসে দীর্ঘদিন শ্বাস নেন, তাহলে শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে এবং নবজাতকের ওজন কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া অকাল প্রসব ও জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি বাড়তে পারে।

 

 

বাংলাদেশে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে করণীয়

বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকার ও সাধারণ জনগণের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

ইটভাটা ও শিল্প-কারখানার নিয়ন্ত্রণ: পুরনো ও দূষণকারী ইটভাটাগুলোর পরিবর্তে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। কলকারখানায় নির্গত ধোঁয়া পরিশোধনের জন্য উন্নত ফিল্টার ব্যবহার করা প্রয়োজন। যানবাহনের দূষণ কমানো: পুরনো ও উচ্চমাত্রায় ধোঁয়া নির্গতকারী যানবাহন নিষিদ্ধ করা দরকার। সিএনজি, ইলেকট্রিক গাড়ি ও পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ব্যবহার বাড়ানো উচিত।

 

 

নির্মাণকাজের নিয়ন্ত্রণ: নির্মাণকাজের সময় নিয়মিত পানি ছিটানোর ব্যবস্থা ও নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখার নিয়ম চালু করতে হবে, যাতে ধুলাবালি বাতাসে না ছড়ায়।

বনায়ন বৃদ্ধি: শহর ও গ্রামে বেশি পরিমাণে গাছ লাগাতে হবে। গাছ বাতাসের ক্ষতিকর উপাদান শোষণ করে বায়ুর গুণগত মান উন্নত করে। 

জনসচেতনতা বৃদ্ধি: সাধারণ মানুষকে বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করতে হবে এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে মাস্ক ব্যবহার, গাছ লাগানো ও দূষণ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

 

 

প্রতি বছর শীতকালে খারাপ পরিস্থিতি হওয়া সত্ত্বেও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বায়ুদূষণ রোধে নির্দেশিকার বাস্তবায়ন দেখা যায় না। নির্দেশিকায় রাস্তা নির্মাণের সময় নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, বিটুমিনের ওপর বালি না ছিটিয়ে মিনি অ্যাসফল্ট প্লান্টের মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার, রাস্তার পাশের মাটি কংক্রিট বা ঘাসে ঢেকে দেয়া, রাস্তা পরিষ্কারে ঝাড়ুর পরিবর্তে ভ্যাকুয়াম সুইপিং ট্রাক ব্যবহার, বড় সড়কে কমপক্ষে দুবার পানি ছিটানোর ব্যবস্থা নেয়া—কোনোটি কার্যকর করার উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। বাংলাদেশে নির্মাণসামগ্রী রাখা বা পরিবহনের সুনির্দিষ্ট কোনো বিধিমালা না থাকায় নির্মাণস্থলগুলোয় প্রচুর ধুলাবালি থাকে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, শীতকালে ঢাকায় প্রতিদিন ৫০০ টন ধুলা সড়কে জমে এবং দুই হাজার টন বাতাসে ওড়ে।

 

 

পৃথিবীর প্রায় ৮৯টি শহর প্রায় সব দিনই তাদের বায়ুমান ঠিক রাখতে পারছে। পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো প্রায় সব সময় শীর্ষে অবস্থান করছে। শুধু ধনী দেশ নয়, মধ্যম আয়ের অনেক দেশও তাদের বায়ুমান ঠিক রাখতে পেরেছে। পৃথিবীর অনেক দেশ যেহেতু বায়ুদূষণ কমাতে পেরেছে, তাই বাংলাদেশের পক্ষেও এটি কমানো সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন আইন, পরিকল্পনা ও সমন্বিত উদ্যোগ। পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও দূষণকে জাতীয় অগ্রাধিকার ঘোষণা করা দরকার। বায়ুদূষণ মোকাবেলায় বাতাসের গুণগত মানের সঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত বিষয়গুলো সমন্বিত করে কার্যকর সরকারি নীতিমালার মধ্যে আনতে হবে। পরিবেশ আইন বাস্তবায়নে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা উচিত। যেকোনো ধরনের দূষণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। বাংলাদেশের দূষণ কমানোর পাশাপাশি আন্তঃসীমান্ত বায়ুদূষণ বন্ধ করার জন্য আঞ্চলিকভাবেও উদ্যোগ নেয়ার বিষয়ে সব দেশের একমত হতে হবে।

 

 

বায়ুদূষণ শুধু পরিবেশের ক্ষতি করে না, এটি মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনমানের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে বায়ুদূষণ একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এজন্য সরকার, পরিবেশ সংস্থা ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ গড়ে তুলতে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

 

ড. কবিরুল বাশার: কীটতত্ত্ববিদ ও অধ্যাপক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়