কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বহুমুখিতায় ঢাকা-দিল্লি-ইসলামাবাদ

মোস্তফা কামাল। সূত্র : আমাদের সময়, ২০ এপ্রিল ২০২৫

বহুমুখিতায় ঢাকা-দিল্লি-ইসলামাবাদ

কী করতে গিয়ে কী বলে দিল পাকিস্তান? বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে টানা দীর্ঘ সময় পর জমে ওঠা আলোচনায় ছেদই পড়ে গেল এ বিষয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিং ও বিবৃতিতে। বাংলাদেশের তরফে মুক্তিযুদ্ধে নৃশংসতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কিংবা স্বাধীনতা-পূর্ব অভিন্ন সম্পদের জন্য বকেয়া অর্থ দাবির মতো বিষয়ে একটা শব্দও নেই সেখানে। অথচ বাংলাদেশের তরফে ইস্যুগুলো প্রচার করা হয়েছে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে। অথচ বৈঠকে ‘ভারতের দখলে থাকা জম্মু ও কাশ্মীর’ নিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধান প্রশ্নে বাংলাদেশের পক্ষে কিছু বলা না হলেও পাকিস্তানের বিবৃতিতে এটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ইসলামাবাদের বিবৃতিতে।

 

 

দেড় দশক পর হওয়া ইসলামাবাদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের জন্য অমীমাংসিত বিষয়ের সমাধান চেয়েছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ এলেন। জানালেন চমৎকার অনুভূতি। এখন আসার অপেক্ষা দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের। আগামী ২৭-২৮ এপ্রিল তার ঢাকা সফরসূচি নিশ্চিত করেছেন পররাষ্ট্রসচিব জসীম উদ্দিন। পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ‘মুক্তিযুদ্ধে নৃশংসতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কিংবা স্বাধীনতা-পূর্ব অভিন্ন সম্পদের জন্য বকেয়া অর্থ দাবির’ মতো বিষয় ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। গেল বৃহস্পতিবার ঢাকায় দুই দেশের সচিব পর্যায়ে ফরেন অফিস কনসালটেশন বা আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। পরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব জসীম উদ্দিন জানালেন, স্বাধীনতা-পূর্ব ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে চার দশমিক তিন দুই বিলিয়ন বা ৪৩২ কোটি ডলার চেয়েছে।

 

 

এ ছাড়া এফওসিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের নৃশংসতার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ও তুলেছে ঢাকা। খবরটির মধ্যে বেশ নতুনত্ব। কিন্তু একদিনের ব্যবধানে শুক্রবার পাকিস্তানের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক সম্পর্কে দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গোলমাল। এতে বলা হয়, দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে পুনরুজ্জীবিত করতে যৌথ অঙ্গীকার প্রতিফলিত হয়েছে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক, গাজায় ইসরায়েলি হামলার নিন্দা এমনকি জম্মু ও কাশ্মীর ‘ভারতের অবৈধ দখলে’ রয়েছে দাবি করে এর সমাধানের মতো ইস্যু নিয়ে ঢাকার বৈঠকে কথা হয়েছে বলেও জানানো হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে ‘গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়া’ কিংবা ‘বকেয়া অর্থের’ বিষয়ে কিছু বলা নেই ওই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে। কেমন হয়ে গেল ব্যাপারটা?

 

 

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচের সঙ্গে বৈঠক শেষে গণমাধ্যমকে বেশ উচ্চাশার সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব জসীম উদ্দিন জানিয়েছিলেন, আলোচনায় অমীমাংসিত বিষয়ের মধ্যে ছিল, “আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন, অবিভক্ত সম্পদের সুষম বণ্টন, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রেরিত বৈদেশিক সাহায্য তহবিল হস্তান্তর এবং ১৯৭১ সালে তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে জনসমক্ষে ক্ষমা চাওয়া। বাংলাদেশের আগের একটি হিসাবে ৪০০ কোটি ডলার এবং আরেকটা হিসাবে ৪৩২ কোটি ডলার। এ হিসাব আলোচনায় বলেছেন বলে দাবি তার। স্বাভাবিকভাবেই গণমাধ্যমে ব্যাপক কাভারেজ পায় সংবাদটি। কিন্তু ছন্দপাত পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে। যেখানে এসব ইস্যুতে একটি শব্দও আনেনি ইসলামাবাদ। বরং অতীতের ইস্যুর চেয়ে ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দিকেই বেশি নজর দিয়েছে ইসলামাবাদ। তাদের ভাষ্য, দেশ দুটির সাংস্কৃতিক সম্পর্ক এবং অভিন্ন ইতিহাস ও জনআকাক্সক্ষার কথা এসেছে আলোচনায়। বৈঠকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত ও কৌশলগত সহযোগিতা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করেছে দুই পক্ষ” বলা হয়েছে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে।

 

 

সাম্প্রতিক কয়েকটি উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগের প্রসঙ্গও এসেছে সেখানে। সম্পর্কের গতিশীলতা ধরে রাখতে নিয়মিত প্রাতিষ্ঠানিক সংলাপ, ঝুলে থাকা চুক্তি দ্রুত চূড়ান্ত করা এবং বাণিজ্য, কৃষি, শিক্ষা ও কানেক্টিভিটির (সংযোগ) ক্ষেত্রে সহায়তা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, বলে জানিয়েছে ইসলামাবাদ। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে দেশটির কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলাদেশিদের পড়াশোনার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আর বাংলাদেশ প্রস্তাব দিয়েছে মৎস্য ও সামুদ্রিক বিষয়ে কারিগরি প্রশিক্ষণের। কানেক্টিভিটিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথাও বলেছে দুদেশ। যমুনায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেছেন। সেখানে জানানো হয়েছে, অতীতের কিছু ফয়সালা করে ইসলামাবাদের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাণিজ্য ও ব্যবসার সম্ভাবনা খুঁজে বের করতে চায় ঢাকা।

 

 

বালুচ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ঢাকা তার খুব ভালো লেগেছে। আলোচনা চমৎকার হয়েছে। বাংলাদেশের খাবার, শপিংও খুব ভালো হয়েছে। ঢাকায় ইসলামাবাদকে নিয়ে এমন আথিতেয়তার মাঝে দিল্লির বাতাস ভিন্ন। সেখানে মুসলিমদের দুর্দশা যাচ্ছে। ওয়াক্ফ ব্যবস্থার সংস্কার আদালতে পর্যন্ত গড়িয়েছে। ওয়াক্ফ (সংশোধনী) বিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষায় সামাজিক ন্যায়বিচার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ‘ঐতিহাসিক মাইলফলক’। কংগ্রেসের কাছে সংবিধানের মূলনীতি, ধারা ও চর্চার ওপর আঘাত। বাংলাদেশ-ভারতের অভ্যন্তরীণ, দ্বিপক্ষীয় নানা বিষয় এখন ক্রমেই বহুপক্ষীয় হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এতে বহু কূটনীতি যোগ হয়ে গেছে। ভারতের প্রতিবেশীরা যার যার সক্ষমতা দেখাচ্ছে। একটা সময়ে এমন অবস্থা হয়েছিল, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী চীন বা কোথাও সফরে গেলে সেটাও ভারতকে জিজ্ঞেস করে যেতে হতো। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের একসঙ্গে এগিয়ে চলা ভারতের জন্য বড় বেদনার। কিছুটা চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকিরও।

 

 

দিল্লি ঢাকায় অবিরাম মৌলবাদী প্রবণতা দেখছে। এর সমান্তরালে শিগগির বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন হবে, এ আশাবাদের কথাও বলতে ছাড়ছে না। আসলে অবস্থা এখন এমন একপর্যায়ে চলে গেছে কে কী বলছেন ঘটনা তার ওপর নির্ভর করছে না। মার্কিনি মেহমানরা বাংলাদেশ ঘুরছেন। জোড়ায় জোড়ায় সফরও করছেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিবের সফরকালে ঢাকায় দুজন মার্কিন মন্ত্রীও ছিলেন। দিল্লি-ঢাকা দুই রাজনৈতিক মঞ্চেই এখন ভর উদ্বেগ- অস্থিরতা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার মাঝেই ভারত এখন নতুন এক কৌশলগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান পারস্পরিক সহযোগিতা ভারতের জন্য বাড়তি উদ্বেগের। চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশ অক্ষ ভারতের জন্য উদ্বেগের না হয়ে পারে না। ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবে তিন দেশ পরস্পরের আরও কাছাকাছি চলে আসায় চিকেন নেক নামে পরিচিত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বিশেষ করে শিলিগুড়ি করিডর পড়েছে ঝুঁকিতে।

 

 

মাত্র ২২ কিলোমিটার প্রশস্ত এই করিডর ভারতের মূল ভূখ-কে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত রাখে। এর পাশাপাশি সীমান্তে চীনের সেনা উপস্থিতি ও সামরিক তৎপরতা ভারতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছে। চীন এই অক্ষের মূল চালকশক্তি। সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে চীনের দ্রুত অগ্রগতি ভারতকে আতঙ্কিত করছে। চীনের ২০২৫ সালের সামরিক বাজেট ২৩ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে, যা ভারতের তুলনায় প্রায় তিনগুণ। চীনের হাইপারসনিক মিসাইল, অত্যাধুনিক ড্রোন প্রযুক্তি এবং শক্তিশালী সাইবার যুদ্ধ সক্ষমতা তাদের আধুনিক যুদ্ধে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশে চট্টগ্রাম ও পায়রা বন্দরে, রেল ও সড়ক যোগাযোগে চীনা বিনিয়োগকে ভারত কৌশলগতভাবে সন্দেহের চোখে দেখছে। পাকিস্তান এই অক্ষের অংশীদার হিসেবে কাজ করছে। ভারতের পররাষ্ট্র ও ভূরাজনীতির জন্য বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, নেপাল, শ্রীলংকা অত্যন্ত দামি। এই দেশগুলোর নেতৃত্ব পরিবর্তন ভারতের মাথাব্যথার কারণ। যার মূলে চীন। এ চারটি দেশই চীনমুখী রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। তাদের বেইজিংয়ের ভরসা হয়ে ওঠা ভারতকে তাড়িত-ব্যথিত করাই স্বাভাবিক।

 

 

আরেক নিকট-প্রতিবেশী মিয়ানমারকে নিয়ে যন্ত্রণায় ভুগছে বাংলাদেশ। মিয়ানমার ১ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে যাচ্ছে এমন সংবাদেও এখন ছন্দপতন। জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেসকে নিয়ে কক্সবাজারে প্রধান উপদেষ্টার ভিন্নমাত্রার সফর, চীন সফরে এ নিয়ে হাই-প্রোফাইলের আলাপ বৈঠক-আশ্বাসের পর এখন ভিন্নকথা। একটা যোগাযোগ হলেও বাংলাদেশ না পারছে মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে জোরালো চাপ দিতে। না পারছে আরাকান আর্মির সঙ্গে প্রকাশ্যে কথা বলতে। একটা জটিল অবস্থা। কিছু লুকোচুরিও কাজ করছে। কারণ রিফিউজি প্রত্যাবাসনের অনেকগুলো আন্তর্জাতিক মানদ- রয়েছে। বুঝতে দেওয়া হচ্ছে না, রোহিঙ্গা ইস্যুটা বাইল্যাটারাল ইস্যু নয়। এটি মাল্টিল্যাটারাল ইস্যু। এর সঙ্গে কেবল বাংলাদেশ আর মিয়ানমার যুক্ত নয়। অনেক পক্ষ যুক্ত। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে জাতিসংঘ, ইউনিসেফ, ইউএনএইচসিআরসহ শতাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থার বোঝাপড়ার ব্যাপারও আছে।

 

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন