বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন প্রসঙ্গ
সাঈদ খান। সূত্র : আমাদের সময়, ০৭ মে ২০২৫

অবৈধ, একতরফা, ভোট চুরি, ভোট ডাকাতি, প্রহসন এবং ডামি-আমি নির্বাচনের কথা মনে আছে, নাকি ভুলে গেছি সবাই! ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে নির্বাচন বর্জন করে। এই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনের প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ঘোষণা করা হয়, যা ইতিহাসে আর কখনও ঘটেনি এবং যা জনমনে ‘বিনা ভোটের নির্বাচন’ বা ‘বিনা ভোটের সরকার’ হিসেবে পরিচিত।
২০১১ সালের ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধান থেকে বাতিল করা হয় এবং সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস হয়। এর পর থেকে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা পুনরায় চালু করার দাবিতে দেশের বেশির ভাগ দল আন্দোলন চালিয়ে যায় এবং কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দেয়। এর ফলস্বরূপ, একতরফা নির্বাচন এবং ভোটারবিহীন নির্বাচন পরিচালিত হয়।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং অন্যান্য দলসহ ৩৯টি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ভোটের আগের রাতে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা ভোটকেন্দ্রে জাল ভোট দিয়ে ব্যালট বাক্স ভরে রাখেন। বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে এবং নতুন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চালায়। এর পরেই ‘রাতের ভোট’ বা ‘রাতের ভোটের সরকার’ নামে এই নির্বাচনকে আখ্যায়িত করা হয়।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যা ‘ডামি’ বা ‘আমির নির্বাচন’ হিসেবে পরিচিত। এটি ছিল একটি নির্বাচনের নাটক, যেখানে ফলাফল আগেই নির্ধারিত ছিল। জনগণ এই নির্বাচন বর্জন করে এবং সরকারের কাছে একতরফা নির্বাচন আয়োজনে জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার অভিযোগ তোলে।
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বিনা ভোট, ভোট ডাকাতি ও ডামি নির্বাচনই হয়েছে। বিরোধী দলগুলো বারবার নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানালেও সরকার তাদের দাবির প্রতি কোনো গুরুত্ব দেয়নি। ফলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে এবং স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
২ মে ২০২৫ তারেক রহমান বলেছেন, ‘আমাদের সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদ সদস্যদের জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হওয়ার কথা। কিন্তু সংবিধান লঙ্ঘন করে এক পলাতক স্বৈরাচারী শাসক তিনবার অবৈধ সংসদ ও সরকার গঠন করেছেন, তা-ও জনগণের ভোট ছাড়াই। আজ বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ জানতে চায়, সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্তদের আগামী দিনে রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক করে দিতে অন্তর্বর্তী সরকার কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বা গ্রহণ করছে? ব্লেইম গেম বা দায় এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদি অন্তর্বর্তী সরকার পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়, তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার অবশ্যই আগামী দিনে সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান ছিল স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট জাঁতাকল ভেঙে ভোটের অধিকার, বৈষম্য নিরসন ও গণতন্ত্র ফিরে পেতে ছাত্র, জনতা, কৃষক, শ্রমিকের ঐক্যের বাঁধনে গড়া মহা প্রতিবাদ। মানুষের আশা, চাহিদা, স্বপ্নের সমন্বয়, ন্যায়বিচার, সমৃদ্ধি, সুশাসনের প্রতিচ্ছবি, মৌলিক অধিকার, মানবিক মর্যাদা, ন্যায্য সমাজ গড়ার স্বপ্ন ও প্রত্যাশাই গণ-অভ্যুত্থানের মূল বিষয়। এই লক্ষ্যের প্রথম ধাপ পূরণের জন্য শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এর পর থেকে রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংস্কারের বিষয়টি জনগণের মধ্যে বিস্তৃত হতে থাকে, যেখানে মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর আগে, ২০১৭ সালে বিএনপি ‘ভিশন-২০৩০’ ঘোষণা করে রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের পরিকল্পনা তুলে ধরে। পরে, ২০২২ সালে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ২৭ দফা রূপরেখা এবং ২০২৩ সালে রাষ্ট্র সংস্কার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ৩১ দফা রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়। শুধু সাম্প্রতিক সময়ে নয়, বিএনপি তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যতবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল, ততবারই রাষ্ট্রকাঠামোর বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করেছে, যা দেশ ও জাতির অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংস্কারের সংস্কৃতি শুরুই হয় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরেÑ যার ধারাবাহিকতা আজও চলমান।
সংস্কার একটি প্রস্তাবনার রূপরেখা, সনদ, নীতিমালা বা চার্টার, যা ‘সব অংশীজনের’ মতামতের ভিত্তিতে সংস্কার কমিশনগুলো তৈরি করেছে। এখন রাজনৈতিক দলগুলো এ চার্টারে প্রয়োজন অনুযায়ী টিক দেবে। যেসব বিষয়ে সব দলের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে উঠবে, শুধু সেসব ক্ষেত্রেই সংস্কার বাস্তবায়িত হবেÑ সরকারের পক্ষ থেকে এমনটিই বলা হয়েছে। আর এই সংস্কার বাস্তবায়ন করবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি বা সংসদ। একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যতটুকু সংস্কার প্রয়োজনÑ অন্তর্বর্তী সরকার তা সম্পন্ন করে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। এই প্রক্রিয়ায় যেসব সংস্কার অন্তর্বর্তী সময়ে গৃহীত হবে, সেগুলোর চূড়ান্ত বৈধতা প্রদান করবে পরবর্তী নির্বাচিত জাতীয় সংসদ।
সাধারণ মানুষের কাছে সংস্কার মানে শুধু রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পরিবর্তন নয়, বরং এমন একটি সমাজব্যবস্থা, যেখানে খুনি, দুর্নীতিবাজ ও অসৎ লোকেরা ক্ষমতায় আসতে না পারে। তারা চায়, যারাই ক্ষমতায় আসুক, তারা যেন ন্যূনতম ভালো হয়, দেশ যেন ভালো থাকে। সন্তান যেন পড়াশোনা করে ঘুষ ছাড়া চাকরি পায়Ñ সাধারণ নাগরিকের চাওয়া এতটুকুই।
২ মে ২০২৫ তারেক রহমান বলেছেন, ‘রাষ্ট্র ও রাজনীতি মেরামতের জন্য সংস্কারের কর্মযজ্ঞ চলছে। চলমান সংস্কারে যদি রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিকে অবজ্ঞা করতে হয়, তাহলে সংস্কারের তাৎপর্যটা কী? এটি আজ বহু মানুষের প্রশ্ন। দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল সংস্কারের পক্ষে। তার পরও সংস্কার নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কেন এত সময়ক্ষেপণ করছে? এ নিয়ে জনগণের মনে ধীরে ধীরে প্রশ্ন বেড়েই চলেছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে অবজ্ঞা এবং জনগণের রায়কে অবহেলা করে বি-রাজনীতিকরণকে উৎসাহিত করা হলে সেটি শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের একটি অংশ সংস্কার ও নির্বাচনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সুপরিকল্পিতভাবে বিরোধ উসকে দিতে চায়। গণতন্ত্রকামী জনগণের মনে এ ধরনের বিশ্বাস জন্ম নিতে শুরু করেছে। বিশেষ পরিস্থিতিতে গঠিত হওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলো নিঃশর্ত সমর্থন দিচ্ছে। কিন্তু অনির্দিষ্টকালের জন্য এই সমর্থন দেওয়া যৌক্তিক নয়।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন হলো জনগণের মত ও আকাক্সক্ষা প্রকাশের মূল স্তম্ভ, যা রাজনৈতিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় প্রধান ভূমিকা পালন করে। জন-আকাক্সক্ষা ও নির্বাচন একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত, কারণ একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে। এমন একটি নির্বাচনব্যবস্থাÑ যেখানে কোনো প্রকার কারচুপি, জালিয়াতি বা সহিংসতা ছাড়াই তারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। তাদের আশা ও চাহিদা পূরণের জন্য নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন করে। এভাবে জনগণের মত প্রকাশ ও আকাক্সক্ষা সরাসরি নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত। গণতন্ত্রের মূলভিত্তি হলো নির্বাচন, যা জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করে। নির্বাচন ছাড়া কোনো সরকার জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি হতে পারে না। নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতা পরিবর্তন হলে তা অবৈধ শাসনব্যবস্থার জন্ম দেয়, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জনগণের অধিকার ক্ষুণ্ন করে। টেকসই ও কার্যকর সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন একটি বৈধভাবে নির্বাচিত সরকার; অনির্বাচিত সরকারের পক্ষে তা সম্ভব নয়।
তারেক রহমান নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেছেন, দেশে এমন আবহাওয়া তৈরির অপচেষ্টা চলছে, যেখানে নির্বাচনের দাবি করা যেন অপরাধ। জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে অবজ্ঞাসূচক বক্তব্যের গন্তব্য কিন্তু পলাতক স্বৈরাচারকেই আনন্দ দেয়। অপরপক্ষে এটি গণতন্ত্রকামী জনগণের জন্য কিন্তু অপমানজনক।
দেশ ও জনগণের স্বাধীনতা সুরক্ষিত ও সুসংহত রাখতে হলে নাগরিকদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করাই হতে হবে প্রধান অগ্রাধিকার। জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে স্বাধীনভাবে প্রতিটি নাগরিকের ভোট প্রয়োগের নিশ্চয়তাবিধান। স্থানীয় সরকার থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে নাগরিকদের প্রত্যক্ষ ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের গণতান্ত্রিক রীতি প্রতিষ্ঠা করা গেলে, যারা জনপ্রতিনিধি হতে চান তাদের নিশ্চিতভাবে জনগণের রায়ের মুখাপেক্ষী করে দেওয়া সম্ভব হবে।
এই প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের রাজনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিত হতে থাকবে ধীরে ধীরে। জনপ্রতিনিধিরা জনগণের কাছে জবাবদিহি থাকতে বাধ্য হবেন। কারণ আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে, কেতাবি কিংবা পুঁথিগত সংস্কার দিয়ে স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদ ঠেকানো যায় না। সংবিধান বা আইন না মানার কারণেই মানুষ ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠে।
জাতীয় নির্বাচন জনগণের অধিকার, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার প্রতীক। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের রাজনৈতিক অধিকার প্রয়োগে প্রস্তুত; এখন প্রয়োজন একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকারের কার্যকর উদ্যোগ। নির্বাচন কমিশন ও সরকারের উচিত অবিলম্বে জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ও রোডম্যাপ ঘোষণা করা।
সাঈদ খান : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক; সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে