কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বিদেশে রাজনৈতিক দলের কার্যক্রমের অন্তরালে

এ কে এম আতিকুর রহমান। সূত্র : কালের কণ্ঠ, ০১ মে ২০২৫

বিদেশে রাজনৈতিক দলের কার্যক্রমের অন্তরালে

এ বছরের ১১ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টির বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার উদ্দেশ্যে শাখা গঠনের কথা উল্লেখ করে বলেন যে বাংলাদেশে এসব দলের মধ্যে যে বৈরী রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যায়, তা তাদের প্রবাসী শাখাগুলোতেও একইভাবে প্রতিফলিত হয়ে থাকে। তিনি এসব দলীয় কর্মকাণ্ড বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্টে যেমন কাজ করে, তেমনি বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে ইতিবাচক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সরকারের যাবতীয় প্রচেষ্টাকে অনেক দুর্বল করে দেয় বলে মন্তব্য করেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সমন্বিত ব্র্যান্ডিং প্রচেষ্টার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে বলেন, ‘আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবদানকে আরো কৌশলগতভাবে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের জন্য একটি সুসংহত এবং ইতিবাচক আখ্যান তৈরির ওপর আমাদের মনোযোগ দিতে হবে।’ বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিগত বছরগুলোতে বিদেশে অনুষ্ঠিত সভায় অংশগ্রহণ করতে যাওয়া বাংলাদেশের নেতাদের ঘিরে ঘটে যাওয়া কয়েকটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার বিবেচনায় তিনি ওই কথাগুলো বলেছেন।

 

 

 

এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা প্রতিবেশী ভারতের উদাহরণ টেনে বলেন, ‘যখন একজন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অন্য দেশ সফর করেন, তখন তাদের প্রবাসীরা তাদের নেতাকে লক্ষ করে প্রকাশ্য বিক্ষোভে অংশ নেয় না। আমাদের ক্ষেত্রে এটি বিপরীত এবং এটি অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। আমাদের এই আচরণ থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’ প্রবাসী ভারতীয়রা স্থানীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে বিশ্বে ভারতের ভাবমূর্তিকে কিভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে তুলে ধরে থাকে, তা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি আরো বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক ভারতীয় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন।

 

 

একইভাবে ভারতীয় কম্পানিগুলো, বিশেষ করে সফটওয়্যার এবং প্রযুক্তিতে, জাতীয় ব্র্যান্ডিংয়ের শক্তিশালী উদাহরণ হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশ এই সম্ভাবনাকে একই পরিমাণে কাজে লাগাতে পারেনি বলে তিনি উল্লেখ করেন।

 

 

 

উপদেষ্টা মহোদয় তাঁর সুদীর্ঘ কূটনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে যে এই কথাগুলো বলেছেন, তাতে সন্দেহ নেই। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই, বিশেষ করে যেখানে প্রবাসী বাংলাদেশিরা রয়েছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর শাখা থাকার কারণে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে যে বিভাজন বিরাজমান তার ফসলই হচ্ছে এসব কর্মকাণ্ড।

 
 
 
 
দেশের সম্মানের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে বিদেশে নিজেদের মধ্যে অযথা বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কলহ বা দ্বন্দ্ব মূলত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত ঐক্য এবং মনোবলকে দুর্বল করে দেয়। এমনকি সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যে রাজনীতির বিরূপ প্রভাব তাঁদের সহমর্মিতার দুয়ারকে সংকুচিতই করে না, অনেক সময়ই পরস্পরের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। এমনকি বিদেশের মাটিতেও তাঁদের মধ্যে অহরহ মারামারি, ঝগড়া-বিবাদের ঘটনা ঘটছে। এসবের দায় কি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিবর্গ এড়াতে পারবেন? অথচ উল্টোটা ঘটলে, ভারতের মতো বাংলাদেশের সম্মান যেমন বাড়ত, তেমনি আমাদের প্রবাসীরাও আমাদের জন্য গর্ব বয়ে আনতেন।

 

 

 

তথ্য মতে, এক কোটির বেশি বাংলাদেশের নাগরিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন, কেউ বা অস্থায়ীভাবে কর্মরত।

 
 
 
 
তাঁদের মধ্যে, বিশেষ করে স্থায়ীভাবে যাঁরা সেখানে রয়েছেন, বেশির ভাগকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের; যেমন—আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ইত্যাদি দলের শাখা গঠনের মাধ্যমে ওই সব দেশে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে সক্রিয় হতে দেখা যায়। অস্বীকার করার উপায় নেই যে ওই সব দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ওই বিদেশি শাখাগুলোর অনুমোদন দিয়ে থাকে। অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতিক্রমেই তাদের ওই সব শাখা বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের রাজনীতির চর্চা করার সুযোগ পেয়ে থাকে। বিষয়টি সেসব দেশের আইনগত দিক থেকে কতটুকু গ্রহণযোগ্য বা আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে অন্য একটি দেশে তাঁদের দলের কর্মকাণ্ড চালানো কতটা নৈতিকতার মাপকাঠিতে বিবেচ্য সে প্রশ্ন থেকেই যায়। যা হোক, অস্থায়ীভাবে কর্মরত বাংলাদেশিরা যেহেতু কয়েক বছরের মধ্যেই কর্মশেষে দেশে ফিরে আসেন, তাই তাঁরা বাংলাদেশের ওই সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়াতে খুব একটা আগ্রহ দেখান না।

 

 

 

কারো না বোঝার কারণ নেই যে বিদেশে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর শাখা গঠনের অন্তরালে অবশ্যই বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। তা না হলে এত খড়কুটো পোড়ানোর দরকার হতো বলে মনে হয় না। এই অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমরা সাধারণ জনগণ যতটুকু অনুমান করতে পারি তার মধ্যে রয়েছে—(১) যেহেতু প্রবাসীরা আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছল থাকেন, তাই তাঁদের দলে ভেড়াতে পারলে দলের জন্য নিয়মিত চাঁদাসহ বিভিন্ন আর্থিক সাহায্য পাওয়া সহজ হয়; (২) নেতাদের বিদেশভ্রমণকালে সেখানে দলীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা ছাড়াও নেতাদের ব্যক্তিগত চাহিদা মেটানোসহ নানা সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া যায়; (৩) দলের প্রয়োজনে এবং নির্দেশে ওই সব দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হয়; (৪) দেশে গৃহীত দলের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের (আলোচনা অনুষ্ঠান, প্রতিবাদ সভা বা মিছিল) অনুকরণে বিদেশে তাদের শাখাগুলোর মাধ্যমে স্থানীয় পুলিশের বা মামলা-মোকদ্দমার কোনোরূপ হয়রানি ছাড়াই সেসব কর্মকাণ্ড চালানো যায়; (৫) সরকারি দলের নেতাদের বিদেশ সফরকালে বিরোধী রাজনৈতিক দলের শাখাগুলো তাদের নেতাদের নির্দেশে বিক্ষোভ মিছিলসহ নানা প্রোগ্রাম নিতে পারে। তবে প্রবাসী বাংলাদেশিরা আর্থিক দিক থেকে ভালো অবস্থানে থাকায় তাঁদের দলের সদস্য/সমর্থক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে সেটি দলের আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করবে। সেটিই এ ক্ষেত্রে মুখ্য উদ্দেশ্য হিসেবে কাজ করে থাকে বলে মনে হয়।   

 

 

 

বিশ্বের অন্য কোনো দেশের রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের মতো বিদেশে তাদের শাখা গঠন করে কি না, জানি না। আমাদের প্রতিবেশী ভারত, নেপাল, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক দলগুলোর বিদেশে শাখা আছে কি? তাহলে গণতন্ত্রের কোন আদর্শ ও ব্যবস্থাপনায় বিদেশে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক কাঠামো থাকার আবশ্যকতা রয়েছে? আমাদের কথা বাদ দিলাম, আদর্শ গণতান্ত্রিক ধারার অনুসারী দেশগুলোর রাজনৈতিক দলগুলোর সংবিধানে কি আমাদের দেশের মতো বিদেশে দলের শাখা গঠনের কোনো ধারা আছে? আমরা কি এমন কোনো দেশের এসংক্রান্ত নিয়মাবলি অনুসরণ বা অনুকরণ করছি? বোধ হয় এটি আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর একান্তই নিজস্ব চিন্তা-চেতনা, উদ্যোগ বা আবিষ্কার। আমাদের রাজনৈতিক মেধার অনন্য বহিঃপ্রকাশ।

 

 

এক লাখের বেশি বিদেশি নাগরিক বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। তাদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক বিদেশি অবৈধভাবেও রয়েছে। ওই সব বিদেশি কি বাংলাদেশে তাদের দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করে? আমাদের মতো তাদের দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের শাখা কি বাংলাদেশে রয়েছে? যদি তাদের দেশের রাজনীতির চর্চা (মিটিং, সমাবেশ, মিছিল ইত্যাদি) এখানে পরিলক্ষিত হতো, আমরা সেসব কতটুকু অনুমোদন বা সমর্থন করতাম? এই প্রশ্নের উত্তর থেকেই আমাদের নিজেদের কাছে প্রশ্ন করা সংগত হবে যে অন্য দেশের মাটিতে আমাদের দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানো কি সঠিক বা যুক্তিসংগত? তাহলে গণতন্ত্রের কোন নিয়মের অনুশীলনে বিদেশে আমাদের রাজনীতির এই অপপ্রয়াস? এই কাজটি করে আমরা কি রাজনৈতিক নৈতিকতার সহজাত ধারাকে বিষাক্ত করছি না? বিদেশিরা আমাদের ওই সব কর্মকাণ্ড দেখে আড়ালে যে উপহাস করে সে খবর কি আমরা রাখি? আর তার ফলাফল ভোগ করতে হয় পুরো দেশকে, দেশের মানুষকে। 

 

 

বাংলাদেশের যেকোনো রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকুক না কেন, মনে হয় না কেউ কোনো দিন এই বিষয়ে যুক্তিসংগত ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সম্মত হবে, যাতে অন্য দেশে বাংলাদেশের রাজনীতি চর্চা করার অবকাশ না থাকে। এমনটি দেখার সুযোগ সৃষ্টির সন্দেহ যখন রয়েই যায়, তখন একটিই আশা আমাদের বাকি থাকে। আর সেটি হলো, বিদেশে দল-মত-নির্বিশেষে সবাই প্রবাসী বাংলাদেশি হিসেবে সামাজিক কল্যাণমুখী সংগঠন অবশ্যই করতে পারেন, তবে তা হতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে এক ব্যানারে ‘আমরা সবাই বাংলাদেশি’ চেতনা ও বিশ্বাসে। দেশের রাজনীতির এমন কোনো কিছুর উপস্থিতি বিদেশের মাটিতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রদর্শন করবেন না, যাতে দেশের সম্মান ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। দেশকে ভালোবাসলে দেশের সম্মানের কথা সবার আগে ভাবতে হবে। কারণ দেশই যে আমাদের পরিচয়। আর সেই পরিচয়টা যেন নন্দিত হয়, নিন্দিত হওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ না পায়—সেই প্রতিজ্ঞাটাই এই মুহূর্তে সবেচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তবে এ কথার অর্থ এই নয় যে তাঁরা বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ভাববেন না, তাঁরা বাংলাদেশের ভোটার হলে তাঁদের পছন্দের রাজনৈতিক দলের প্রার্থীকে ভোট দেবেন না বা সমর্থন করবেন না। সেটি তাঁরা অবশ্যই করবেন, দেশে এসে। বিদেশের মাটিতে প্রকাশ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালালে বাংলাদেশের সম্মান ক্ষুণ্ন হওয়ার পথ যে খোলাই রয়ে যায়।       

 

 

আমাদের একান্ত প্রত্যাশা, আমাদের প্রবাসীরা, যাঁরা রাজনীতি করতে আগ্রহী, তাঁরা ওই সব দেশের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হবেন বা সেসব দেশের নেতৃত্বে আসবেন। তাঁরা সেখানে সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী হলে ওই সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে আরো দৃঢ় ও শক্তিশালী করার সুযোগ পাবেন। তাঁদের নিয়ে আমরা গর্ব বোধ করব। সেটি করতে পারলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করার অনেক বেশি সুযোগ আসবে। আর তখনই আমরা বিদেশে বসে দেশের রাজনীতি করে দেশের সুনামকে ক্ষুণ্ন করার চিহ্নটি দেখতে পাব না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে ব্যক্তির চেয়ে দল এবং দলের চেয়ে দেশের স্বার্থ অনেক ঊর্ধ্বে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা কি এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবেন? মিলিয়ন ডলারের এই প্রশ্নটি হয়তো রয়েই যাবে।

 

লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব