কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বিমসটেক সম্মেলন ও আঞ্চলিক সমন্বয়ের সম্ভাবনা

সাইমন মোহসিন । সূত্র : আমাদের সময়, ০৭ এপ্রিল ২০২৫

বিমসটেক সম্মেলন ও আঞ্চলিক সমন্বয়ের সম্ভাবনা

বঙ্গোপসাগরীয় বহুক্ষেত্রীয় প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা উদ্যোগ (বিমসটেক)-এর ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলন ৪ এপ্রিল থাইল্যান্ডে সমাপ্ত হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ আগামী দুই বছরের জন্য গ্রুপের সভাপতিত্ব গ্রহণ করে একটি তাৎপর্যপূর্ণ উত্তরণ চিহ্নিত করেছে।

 

 

বাংলাদেশের নেতৃত্বে অধ্যাপক ইউনূস বিমসটেকের ভবিষ্যৎ অগ্রাধিকারগুলোর একটি রূপরেখা প্রদান করেছেন। এর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো বিমসটেক মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা, যা আঞ্চলিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সংহতিকে গতিশীল করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। এ ছাড়া সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অবকাঠামোগত সংযোগ ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিমসটেক ট্রান্সপোর্ট কানেক্টিভিটি মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নও অন্যতম অগ্রাধিকার হবে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা প্রসঙ্গে অধ্যাপক ইউনূস রোহিঙ্গা সংকট সমাধান ও তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে সক্রিয় সম্পৃক্ততার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।

 

 

শীর্ষ সম্মেলনে অধ্যাপক ইউনূস ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে আলোচনাসহ উল্লেখযোগ্য পার্শ¦-কূটনৈতিক তৎপরতা লক্ষ করা গেছে, যেখানে সম্ভাব্য দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

 

 

তবে বিমসটেক সংগঠনটিকে এখনও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো অব্যাহত বাণিজ্যের পথে বাধাগুলো সমাধান, সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং অসম অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করা। এগুলো বিমসটেকের ঐক্য ও কার্যকারিতাকে পরীক্ষার মুখে ফেলেছে।

 

 

ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে ‘ব্যাংকক ভিশন ২০৩০’ গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতায় কিছু অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। এটি ২০৩০ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ, সহনশীল ও উন্মুক্ত বিমসটেক গড়ে তোলার একটি ব্যাপক রোডম্যাপ। অর্থনৈতিক সংহতিতে অগ্রগতির অংশ হিসেবে সদস্য রাষ্ট্রগুলো দীর্ঘকাল ধরে অবাস্তবায়িত থাকা বিমসটেক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) আলোচনা ত্বরান্বিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, যা আঞ্চলিক বাণিজ্যকে শক্তিশালী করবে। থাইল্যান্ড সমুদ্র পরিবহন সহযোগিতা চুক্তি এবং বঙ্গোপসাগর ও থাইল্যান্ড উপসাগরকে সংযুক্তকারী তাদের উচ্চাভিলাষী ল্যান্ড ব্রিজ প্রকল্পসহ গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ প্রকল্পগুলোর ওপর আলোকপাত করে।

 

 

সহনশীলতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নেতৃবৃন্দ বিমসটেক ট্রপিক্যাল মেডিসিন এক্সিলেন্স সেন্টারের মতো বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বিষয়ে একমত হন। তারা জলবায়ু চ্যালেঞ্জ ও স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় ভারতের প্রস্তাবিত একটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন করে। বিমসটেক সন্ত্রাসবাদ ও মাদক পাচারবিরোধী কনভেনশনের অধীনে আন্তঃসীমান্ত অপরাধ মোকাবিলায় প্রতিশ্রুতি শক্তিশালী করে নিরাপত্তা সহযোগিতা এগিয়ে নেওয়া হয়। শীর্ষ সম্মেলনে প্রস্তাবিত বিমসটেক বিজনেস অ্যাডভাইজরি কাউন্সিলের মাধ্যমে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা এবং তরুণ ফোরামের মাধ্যমে তরুণ সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। পাশাপাশি পর্যটন সংযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বন্ধনকে শক্তিশালী করার ওপর জোর দেওয়া হয়।

 

 

বর্তমান শীর্ষ সম্মেলন এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ উপস্থাপন করেছে, বিশেষত ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড মহাসড়ক এবং কলাদান মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে আঞ্চলিক সংযোগকে রূপান্তরিত করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

 

 

বিমসটেকের ভিশন হলো অবকাঠামোগত, ডিজিটাল এবং সামুদ্রিক সংযোগ বৃদ্ধি করার মাধ্যমে আঞ্চলিক একীভূতকরণকে এগিয়ে নেওয়া। তবে অসম বন্দর অবকাঠামো এবং নিয়ন্ত্রণমূলক বৈষম্যের কারণে অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত রয়েছে। একইভাবে, বিমসটেক মাস্টারপ্ল্যান ফর ট্রান্সপোর্ট কানেক্টিভিটির মতো উদ্যোগগুলো আশাব্যঞ্জক হলেও সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান ডিজিটাল বিভাজন প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সমন্বিত বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।

 

 

বিমসটেককে একটি কার্যকর আঞ্চলিক জোট হিসেবে গড়ে তুলতে হলে এটিকে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগত ও ভূ-রাজনৈতিক বাধা অতিক্রম করতে হবে এবং সবার দৃঢ় ও অটুট রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রদর্শন করতে হবে। আসিয়ানের শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বিপরীতে, বিমসটেক সদস্য দেশগুলোর ভিন্নমুখী জাতীয় স্বার্থ এবং নির্দিষ্ট তহবিল ব্যবস্থার অভাবে সংগ্রাম করে চলেছে। সংস্থাটি প্রযুক্তিগত সহযোগিতার ওপর সীমিত ফোকাস রাখায় জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবপাচারের মতো জরুরি অপ্রথাগত নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলার সক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়েছে।

 

 

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ক্রমাগত তীব্র হচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জকে সুযোগে রূপান্তর করার মাধ্যমে বিমসটেক দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে অর্থপূর্ণ ও রূপান্তরমূলকভাবে সংযুক্ত করতে পারবে কিনা, তা নির্ধারণ করবে এর সাফল্য।

 

 

বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইনে অধ্যাপক ইউনূস ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছে এমন এক সময়ে যখন দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে উত্তেজনা চরম পর্যায়ে। আলোচনায় কিছু সংবেদনশীল ইস্যু যেমনÑ শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ, তিস্তা পানিবণ্টন এবং সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের মতো বিষয়গুলো উঠে এসেছে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং পরে হাসিনার ভারতীয় আশ্রয় গ্রহণের পর এটিই প্রথম উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক আলোচনা। অন্যদিকে বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণ নিয়ে দিল্লির উদ্বেগও এই বৈঠকের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

 

 

এই বৈঠকে আরও গভীর ভূ-রাজনৈতিক ইঙ্গিত নিহিত রয়েছে। বিশেষত অধ্যাপক ইউনূসের সাম্প্রতিক চীন সফরের প্রেক্ষাপটে, কারণ অনেকেই তার চীন সফরকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে বৈচিত্র্য আনার প্রচেষ্টা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। নয়াদিল্লির জন্য এই বিমসটেক সম্পৃক্ততা তাদের কৌশলগত অবস্থান পুনর্নির্ধারণের একটি সুযোগ প্রদান করেছে। ভারত ঐতিহ্যগতভাবে ভারতবান্ধব প্রতিবেশী দেশে চীনের কাছে কৌশলগত সুবিধা রোধের প্রতি সব সময়ই সচেষ্ট। বিতর্কিত ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনায় মোদির সদিচ্ছা ইঙ্গিত দেয় যে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন চায়। দীর্ঘস্থায়ী উত্তেজনা ঢাকাকে চীনের কক্ষপথে আরও ঠেলে দিতে পারে, যা ভারতের আঞ্চলিক প্রভাবকে ঝুঁকিতে ফেলবে।

 

 

যদি উভয় পক্ষ রাজনৈতিক মতপার্থক্যকে পৃথক রেখেও সংযোগসাধন, বাণিজ্য ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাস্তবমুখী সহযোগিতা এগিয়ে নিতে পারে, তাহলে বিমসটেক একটি স্থিতিশীলতার মঞ্চ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। তবে মূল অভিযোগগুলো সমাধানে ব্যর্থতা অবিশ্বাসকে আরও গভীর করতে পারে, যা বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও ক্ষমতার ভারসাম্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।

 

 

বাংলাদেশের বিমসটেক সভাপতিত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে এই কূটনৈতিক জটিলতাগুলো সামলানোর দক্ষতা পরীক্ষার সম্মুখীন। এই জোটটি কেবল প্রতীকী অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে কিনা, নাকি দ্বন্দ্ব ব্যবস্থাপনার একটি কার্যকর ফোরামে পরিণত হবে, বাংলাদেশকে সেই কূটনৈতিক পরীক্ষারও সম্মুখীন হতে হবে আগামী দুই বছর।

 

 

নতুন বিশ্বব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আঞ্চলিক সহযোগিতার বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। কিন্তু বিমসটেক যদি দূরদর্শী বক্তব্যকে বাস্তব পদক্ষেপে রূপান্তর করতে ব্যর্থ হয় তবে তা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। আসিয়ানের একীকরণ সাফল্য থেকে শিক্ষা নিয়ে ডিজিটাল বিভাজন, নিরাপত্তা হুমকি এবং সবুজ রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা মোকাবিলা করে এই ব্লকটি বৈশ্বিক অস্থিরতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। তবে সুসংহত বাণিজ্য কাঠামো এবং অবকাঠামোগত বিনিয়োগের মতো জরুরি সংস্কার ছাড়া বিমসটেক একটি অপূর্ণ প্রতিশ্রুতিই থেকে যেতে পারে। বাংলাদেশের নেতৃত্বাধীন আগামী দুই বছর পরীক্ষা করবে যে, এই বৈচিত্র্যময় জোটটি আলোচনার ফোরাম থেকে বেরিয়ে বাস্তব অগ্রগতির একটি শক্তিতে পরিণত হতে পারে কি না।

 

সাইমন মোহসিন : রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক