বিনিয়োগে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব
মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান [প্রকাশ : যুগান্তর, ০৩ জুলাই ২০২৫]

একটি দেশের উন্নয়নের জন্য সুবিনিয়োগ একটি সঞ্জীবনী শক্তি, এ কথা সর্বজনবিদিত। অর্থনীতির প্রাচীন সূত্রানুযায়ী-অধিক বিনিয়োগ, অধিক কর্মসংস্থান, অধিক উৎপাদন, অধিক আয়, অধিক সঞ্চয়ের পর আবারও অধিক বিনিয়োগ চক্রাকারে চলে। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত হলেও আমরা বিনিয়োগের সূত্রে যথার্থভাবে আবদ্ধ হতে পারছি না। ফলে, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এখনো বেকার কিংবা অর্ধবেকার অথবা ছদ্মবেকার। এ দেশে দারিদ্র্যের হার এখনো ১৮.৭ শতাংশ, অর্থাৎ ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ৩ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। এ হার পৃথিবীর অন্তত ১৪০টি দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। দারিদ্র্য হারের সঙ্গে বেকারত্বের হারের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। যদিও বেকারত্ব ছাড়াও দরিদ্রতার অন্যান্য কারণও রয়েছে। অন্যদিকে সাধারণভাবে বেকারত্ব হারের সঙ্গে বিনিয়োগ হারের বিপরীত সম্পর্ক রয়েছে।
আমাদের জিডিপির ৩০-৩১ শতাংশের মধ্যেই বিনিয়োগ সাধারণত ওঠানামা করছে। দেশের মোট সঞ্চয়ের সঙ্গে এটি সংগতিপূর্ণ হলেও দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলোতে জিডিপির ৪০-৪৫ শতাংশ বিনিয়োগের নজিরও রয়েছে। উদাহরণ হিসাবে আমরা চীনের কথা বলতে পারি। আমাদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, দরিদ্রতার হার হ্রাস, তথা দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। বিশেষ করে জনসংখ্যার ডিভিডেন্টের বিষয়টি বিবেচনায় রাখলে আগামী দশকটি আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জনসংখ্যা ডিভিডেন্ট ২০৩৫-২০৪০-এর মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
বিনিয়োগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অর্থসংস্থানের কৌশল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে বৈদেশিক ঋণ করে যেসব বিনিয়োগ হয়েছে, তার দায় বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বহন করতে হবে। বর্তমানে দেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় ১০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ ঋণও রয়েছে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করার অন্যতম একটি উপায় হচ্ছে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (FDI)। বিশ্বের অনেক দেশই FDI-এর মাধ্যমে সফলতার সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটাচ্ছে, যেমন-ভিয়েতনাম, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া এবং চীনে ২০২৪ সালে FDI-এর পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৩৮.২, ৪৫.৬, ৫৫.৩৩, এবং ১১৪.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ একই বছরে তা বাংলাদেশে ছিল মাত্র ১.২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
পিপিপির মাধ্যমেও বৈদেশিক বিনিয়োগের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তবে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য একটি সাধারণ প্রয়োজনীয় শর্ত হচ্ছে, বিনিয়োগের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা। দেশীয় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের ভরসা খুঁজে না পেলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও নিঃসংকোচে বিনিয়োগে আগ্রহী হন না। বৈদেশিক বিনিয়োগের একটি অন্যতম সুযোগ পিপিপি হলেও, পিপিপিতে এখন পর্যন্ত আমাদের খুব বেশি দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
পিপিপিতে বর্তমানে মোট ৮২টি প্রকল্প তালিকাভুক্ত থাকলেও এযাবৎ মাত্র ৪টি প্রকল্প সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত, ২টি আংশিক বাস্তবায়িত এবং বাকি ৭৬টি প্রকল্প গবেষণাধীন কিংবা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। ১৬টি প্রকল্পের গবেষণা ও চুক্তি সম্পাদন হওয়ার পর তা বিভিন্ন কারণে প্রত্যাহার অর্থাৎ বাতিল করা হয়েছে। প্রকল্প বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে অনেক সতর্ক ও আন্তরিক হতে হবে। সঠিক প্রকল্প বাছাই করতে না পারলে অযথা সময় এবং অর্থ ব্যয় হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/দপ্তর/সংস্থা নিজস্ব উদ্যোগে দক্ষতার সঙ্গে প্রিফিজিবিলিটি করতে পারলে রুগ্ণ ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দেওয়া সম্ভব হবে। পিপিপি’এতে সিইও হিসাবে কিছুদিন (দুই মাস পাঁচ দিন) কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। পিপিপির মতো একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় অধিক্ষেত্রেও কেন এখনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি, ঐকান্তিক উৎসাহ নিয়ে তার কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছি। পিপিপিএ’র সার্বিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনান্তে মনে হয়েছে, এ বিষয়ে আমরা যথেষ্ট প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম না। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর সংস্থা থেকেও এর জন্য যথেষ্ট চাহিদা সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন।
পিপিপির একটা অন্যতম সুবিধা হলো, এর বেশির ভাগ ক্রয় প্রক্রিয়া সরকারিভাবে করার দরকার পড়ে না। এতে সময় বাঁচে। যথাসময়ে প্রকিউরমেন্ট সম্পন্ন করা সহজ হয়। প্রকল্পের অর্থসংস্থানের সিংহভাগ বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা করে থাকেন, সে কারণে মাথাপিছু ঋণের বোঝাও বাড়ে না। সরকারি-বেসরকারি খাতের দক্ষতা ও মনিটরিং প্রক্রিয়া একত্রে কাজে লাগানো যায়। এতে দুর্নীতিও হ্রাস করা সম্ভব। পিপিপির সুবিধা গ্রহণ করতে হলে পিপিপি কর্তৃপক্ষকে জ্ঞান, বুদ্ধি ও জনবলে যথেষ্ট শক্তিশালী হতে হবে; যাতে অন্য মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থায় এটি প্রয়োজনীয় টেকনিক্যাল সাপোর্ট প্রদান করতে পারে। পিপিপিএতে অভিজ্ঞ জনবলের রিটেনশনের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত কাজ হওয়ায় কর্মরতদের প্রণোদনার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। প্রত্যেক মন্ত্রণালয়/বিভাগ যাতে নিজস্ব উদ্যোগে প্রিফিজিবিলিটি করতে পারে, সেজন্য মন্ত্রণালয়গুলোতে একটা দক্ষ পিপিপি সেল থাকা জরুরি। পিপিপির প্রকল্পের অগ্রগতি মনিটরিং ও সমন্বয় জোরদার করার জন্য এর নির্বাহী বোর্ডের একটি বিশাল দায়িত্ব রয়েছে। এ বোর্ড মাসে একটি সভা করতে পারলে পিপিপি প্রকল্পের অগ্রগতি অনেক গতিশীল হতে পারে। চার বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে অথচ নির্বাহী বোর্ডের কোনো সভা হয়নি। পিপিপিএ’র বোর্ড অব গভর্নরস রয়েছে। বিগত সরকারের আমলে ছয় বছরেও কোনো সভা হয়নি। অথচ বছরে দুটি বোর্ড সভা হওয়ার বিষয়টি আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে কাম্য বিনিয়োগ অর্জনের জন্য আমাদের এ অবস্থা থেকে উত্তরণ জরুরি।
আমাদের অবকাঠামো, পরিবহণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইটি, কৃষি ও জ্বালানিসহ বিভিন্ন সেক্টরে দেশে পিপিপির প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু বৈদেশিক বিনিয়োগই নয়, পিপিপিতে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগেরও সুযোগ রয়েছে। বৃহৎ বিনিয়োগের পাশাপাশি পিপিপিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগও করা প্রয়োজন। বিনিয়োগের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনাসহ কৌশলপত্র এবং এর বাস্তবায়ন মনিটরিং টুলস ডেভেলপ করা প্রয়োজন। বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ঘুস ও চাঁদাবাজি যথার্থ অর্থে বন্ধ করতে হবে। দাপ্তরিক কর্মকাণ্ডে যতদূর সম্ভব প্রসেস সিমপ্লিফাই করতে হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। এছাড়া বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করার জন্য একটি ভালো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করতে পারলে আমাদের আগামী দিনগুলোতে তা বিনিয়োগের যাত্রাকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করবে। এতে কর্মসংস্থান বাড়াবে, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব হার কমাবে এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান : সাবেক সচিব; প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, পিপিপি কর্তৃপক্ষ