বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা রাজনৈতিক ও নীতিগত অনিশ্চয়তা
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট আরো কাটছাঁট করা যেত। চলতি অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় এ বাজেটের আকার ৭ হাজার কোটি টাকা কমানোর কথা বলা হয়েছে। ড. সেলিম রায়হান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্যও ছিলেন তিনি। আসন্ন অর্থবছরের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবিত বাজেটের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবরিনা স্বর্ণা [সূত্র : বণিক বার্তা, ১৯ জুন ২০২৫]

আসন্ন অর্থবছরের জন্য বাজেটের আকার ধরা হয়েছে সাত লাখ নব্বই হাজার কোটি টাকা। শুরুতেই চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের সঙ্গে এ বাজেটের তুলনামূলক মূল্যায়ন জানতে চাই।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট আরো কাটছাঁট করা যেত। চলতি অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় এ বাজেটের আকার ৭ হাজার কোটি টাকা কমানোর কথা বলা হয়েছে। অথচ অন্যদিকে সরকারি কর্মচারীদের ৭ হাজার কোটি টাকার বিশেষ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমার আপত্তি রয়েছে। কেন কেবল সরকারি কর্মজীবীদের বিশেষ সুবিধা দেয়া হবে? সরকারি কর্মজীবীর বাইরে নব্বই ভাগ সাধারণ মানুষ রয়েছে যারা সরকারি চাকরি করে না। তাদের জন্য কি সুবিধা আছে? এ দিক বিবেচনায় বাজেটের আকার আরো সংকুচিত করা যেত, বাজেটকে আরো শক্ত ভিত্তি দেয়া যেত। অনেক অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বন্ধ বা স্থগিত করা যেত। কিংবা কমানো যেত। চলতি অর্থবছরের বা আগের বাজেটের অনেক প্রকল্প বিগত সরকারের আমলে নেয়া হয়েছিল, যেগুলো নানা কারণে অতি মূল্যায়িত। সেগুলোয় প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা রয়েছে, দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে এসব উঠেও এসেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এগুলো আরো পুনর্বিবেচনা করার প্রয়োজন ছিল।
চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৭৫ দশমিক ৪১ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে সাধারণ সরকারি সেবা খাতে। একদিকে সরকারি সেবায় ব্যয় বাড়ছে, অন্যদিকে সরকার তরুণদের জন্য ১০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছে, উদ্যোক্তা তৈরির কথা বলছে। বিষয়টি সাংঘর্ষিক বা স্ববিরোধী কিনা?
অবশ্যই স্ববিরোধী। বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে অনেক স্ববিরোধী বিষয় আছে এবং অনেকটাই জুলাই চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিকও। তরুণদের জন্য ১০০ কোটি টাকার যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। আমরা অতীতেও দেখেছি বাজেটে বড় বড় অংকের বরাদ্দ থাকত। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়নে নানা সমস্যা হতো। এমন কিছু ত্রুটি থাকত যেগুলোর কারণে বরাদ্দের অপচয় হতো। আবার বাজেটে ভালো অনেক দিকও আমরা দেখেছি। কিন্তু বাজেট বাস্তবায়নে বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের যেসব সীমাবদ্ধতা আছে—দক্ষতার ঘাটতি, অনিয়ম-দুর্নীতি, অপচয় এগুলো কাটিয়ে ওঠার বিষয়টি এবারের বাজেটেও একেবারেই স্পষ্ট নয়। এ জায়গা থেকে আসন্ন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকেও গতানুগতিক বাজেট বলেই মনে হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারও এর বাইরে যেতে পারেনি। যদিও সরকারের গতানুগতিক বাজেট থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ ছিল। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তারা সে সুযোগটা হাতছাড়া করেছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ, ২৬ হাজার কোটি টাকা, যার বেশির ভাগ পূরণ করা হবে অভ্যন্তরীণ ঋণ নিয়ে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে দেশের রাজস্ব আহরণে নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বরাবরই ব্যর্থ হয়ে আসছে। উপরন্তু এনবিআরের সংস্কার ঘিরে নতুন কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ও প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?
আশঙ্কা করছি বাজেট বাস্তবায়নে অনেক সমস্যা হবে। অতীতে দেখা গেছে বাজেটের সর্বোচ্চ ৭৫-৮০ শতাংশ খরচ হয়। আমি খরচ এবং বাস্তবায়নের মধ্যে পার্থক্য রাখতে চাই। কারণ খরচ হয়তো হবে, কিন্তু বাজেটের যে মূল উদ্দেশ্য থাকে তা অর্জিত হয় না। এর জন্য প্রধানত দায়ী হলো অনিয়ম-দুর্নীতি।
সামনের বাজেটে রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সেটাও উচ্চাভিলাষী বলে মনে হয়। কারণ বর্তমানে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ খুবই কম, গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও নিম্নমুখী। প্রসঙ্গত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের নিচে রয়েছে। আবার বলা হচ্ছে, আগামী অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৫ শতাংশের ঘরে উন্নীত হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে বিনিয়োগের যে প্রবাহ তাতে আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলনও উচ্চাভিলাষী বলে আমার মনে হয়। এমন পরিস্থিতিতে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা কঠিন হবে।
এনবিআরের সংস্কার ঘিরে যেসব জটিলতা তৈরি হয়েছে, তার প্রভাবও পড়বে রাজস্ব আহরণে। আর বাজেট ঘাটতিও প্রস্তাবিত অংকে সীমাবদ্ধ থাকবে বলে মনে হয় না। সেজন্য অভ্যন্তরীণ বা ব্যাংক ঋণের পরিমাণ আরো বাড়বে। কারণ সরকারকে কিছু কিছু খরচ করতেই হবে যেমন ঋণের সুদ বাবদ খরচ। বাজেটের ছয় ভাগের এক ভাগ সরকারি ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে। তারপর ভর্তুকি বাবদ খরচ করতে হবে। এসব ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকারের খুব বেশি কাটছাঁটের সুযোগ নেই। এসব ব্যয় আগামীতে আরো বাড়বে, কমবে না। কিন্তু পরিচালন ব্যয় কমানো যেত যেটা আমি শুরুতেই বলেছি।
সামগ্রিকভাবে বলা যায়, রাজস্ব আহরণের চাপ আরো বাড়বে। এর লক্ষ্যমাত্রা অতীতের মতো অর্জন করা যাবে না। নতুন নতুন জটিলতা আরো সৃষ্টি হবে। যে কারণে হয়তো পরিস্থিতি আরো স্থবির হওয়ার পাশাপাশি ঘাটতি বাজেট মেটাতে সরকার যত ঋণ নেবে তত ঝুঁকি বাড়বে। এমনিতেও সরকারের নানা উৎস থেকে অতিমাত্রায় ঋণ নেয়ায় ঝুঁকি বাড়ছে।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে জোর দেয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু আমরা দেখছি, দেশের ৯০ শতাংশ কর্মসংস্থান বেসরকারি খাতে হওয়া সত্ত্বেও এ খাতে ঋণপ্রবাহ কম, যার অন্যতম কারণ বাড়তি সুদহার। এছাড়া অবকাঠামোগত সমস্যা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় বিনিয়োগের পরিমাণও অনেক কম। এমন পরিস্থিতিতে সরকার কর্মসংস্থান সৃষ্টির সমস্যাগুলো সমাধান করবে কীভাবে?
কর্মসংস্থান সৃষ্টির কেন্দ্রীয় বিষয় হলো বিনিয়োগ, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ। সরকারি বিনিয়োগে কর্মসংস্থানের পরিসর খুব একটা বাড়ে না। তাই কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিনিয়োগ আসতে হবে ব্যক্তি খাত থেকে। কিন্তু বর্তমানে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ পরিস্থিতি বেশ খারাপ। বিনিয়োগ না হওয়ার পেছনে অনেক কারণই থাকে। তবে দেশে বর্তমানে এর পেছনে বড় কারণ সামগ্রিক অনিশ্চয়তা। নীতির ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক পালাবদল কীভাবে হবে সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা, নির্বাচন কবে হবে তার নিশ্চয়তা নেই।
এমনকি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা আছে। পাশাপাশি ব্যবসার খরচ বিভিন্নভাবে বেড়েছে। এসব সমস্যা সমাধানের কথা শুনলেও বাস্তবায়ন দৃশ্যমান নয়। প্রস্তাবিত বাজেটেও তেমন কোনো উদ্যোগ দেখছি না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে সুদের হার বাড়িয়ে গেছে। কিন্তু এর সুফল সেভাবে মেলেনি আর সামনেও মূল্যস্ফীতি কতটুকু নিয়ন্ত্রণে আসবে সেটা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আমাদের মূল্যস্ফীতির বড় অংশ এখন আর চাহিদাজনিত নয়। নানা কারণে তা এখন হয়ে থাকে।
ফলে সুদের হার বাড়িয়ে চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণের ফলাফল দু-এক বছর আগে যেমন পাওয়া যেত, এখন তেমন পাওয়া যাবে না। বরং বর্তমানে উচ্চ সুদের হারের কারণে বিনিয়োগ ও ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির আশা স্তিমিত হয়ে গেছে। এত উচ্চমাত্রার সুদ এবং ভয়াবহ অনিশ্চয়তার পরিবেশে বিনিয়োগকারীরা হয়তো ঋণ নেবে না, বিনিয়োগও করবে না। সামগ্রিকভাবে বাজেটেও বিনিয়োগের জন্য ভালো খবর নেই। এ পর্যায়ে যে স্থবিরতা তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো রোডম্যাপ নেই। আমি যেসব ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীর সঙ্গে কথা বলেছি তারা এখনো হতাশ। তাদের অনুকূলে বাজেটে তেমন কিছু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। উদ্যোগ নেই, করছাড়ের বিষয়ও নেই। সব মিলিয়ে বিনিয়োগ করার জন্য বিনিয়োগ উপযোগী পরিবেশ তৈরির বিষয়টি অনুপস্থিত। অথচ ব্যবসার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ব্যবসা উপযোগী পরিবেশ। এক্ষেত্রে সরকারের মূল সংস্কার প্রয়োজন। এ বাজেটে এটার বেশ ঘাটতি রয়েছে, যা আছে সেটা খুবই নগণ্য, যেটা দেখে ব্যবসায়ীরা খুব একটা আগ্রহী হন না।
চলমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে কী করা যায়?
দেশের সামগ্রিক কাঠামোয় বর্তমানে বিনিয়োগের অনুকূলে নেই। তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা রাজনৈতিক ও নীতিগত অনিশ্চয়তা। বিনিয়োগকরীরা অনিশ্চয়তায় আছেন কোন সরকার আসবে, কীভাবে আসবে। এ অনিশ্চয়তা কিছুটা কমাতে হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচনের রূপরেখা দেয়া উচিত এবং সব দল যাতে ঐকমত্যে আসে সে ব্যবস্থা করা উচিত। পাশাপাশি বিনিয়োগের জন্য যেসব বাধা, যেমন ব্যবসার খরচ ও জমির দাম বৃদ্ধি এগুলো কমানোর জন্য কী কী উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে তা আরো সুস্পষ্ট হওয়া দরকার।
এর বাইরে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) ওয়ানস্টপ সার্ভিসকে কীভাবে আরো অর্থবহ করা যায় সেটিও স্পষ্ট করতে হবে। আমি ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওসের ওয়ানস্টপ সার্ভিস দেখেছি, সেগুলো প্রকৃত অর্থে ওয়ানস্টপ সার্ভিস। কাউকে এ দেশের মতো বিভিন্ন জায়গা দৌড়াদৌড়ি করতে হয় না। কিন্তু আমাদের এখানে ওয়ানস্টপ সার্ভিস কাগজে কলমে আছে, বাস্তবে নেই। এসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের কীভাবে আস্থা তৈরি করা যায়, সেখানে গুরুত্ব দেয়া উচিত। দেশীয় ও বিদেশী বিনিয়োগকারীরা মনে করে দুটি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় বাধা। এক. এনবিআর। বিভিন্ন সময় কর নিয়ে অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত, এসআরও ইস্যু করে তারা বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাসই ভেঙে ফেলে। কর দেয়ার ক্ষেত্রে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ভোগান্তির শিকার হন। এ জায়গাগুলো ঠিক করা দরকার।
দুই. ব্যাংক খাত। যখন ব্যাংক খাত থেকে ঋণের প্রবাহ কমে যায় তখন কিছু কিছু খাত মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষত যেগুলো নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সম্ভাবনাময় এসএমই খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ জায়গাগুলোয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার যদি করা যায়, তাহলে বিনিয়োগ পরিস্থিতি অনুকূলে আসবে।
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংক খাত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখনো দেশের ব্যাংক খাত পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করা যায়নি। বাজেট চূড়ান্ত করার আগে এ খাতের সংকট মোকাবেলায় আপনি সরকারকে কী সুপারিশ দেবেন?
ব্যাংক খাত পুনরুদ্ধারে ভালো কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগের সরকারের আমলের তুলনায় এ খাত থেকে অনিয়ম, দুর্নীতি, খেলাপি ঋণ, লুটপাট এগুলো কিছুটা কমানো গেছে। এর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশংসা করি। তবে ব্যাংক খাতে সংকটের আসল কারণগুলো উঠে এলেও পুরোপুরি আসছে না।
শোনা যাচ্ছে পাঁচটা ব্যাংকে একীভূত করা হবে। এটা নিয়েও নানা কথা হচ্ছে। আমরা গভর্নরের মুখেও একেক সময় একেক কথা শুনছি। এসব ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয়রা যখন একেক সময় একেক কথা বলেন, সেটা বিপদসংকেত দেয়। তাই ব্যাংক খাত সংস্কারের রূপরেখাটা কী সেটা স্পষ্ট করা দরকার। এর জন্য অংশীজন যারা আছেন, বিশেষ করে সরকার, বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারী, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে এটার স্পষ্টতা থাকা প্রয়োজন। কবে, কীভাবে কোন রূপরেখা মেনে সংস্কার করা হবে—পুরোটা স্পষ্ট করতে হবে। এতে সবার মধ্যে বিশ্বস্ততা ও ভরসা তৈরি হবে। পাশাপাশি যারা ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্রঋণ নেন এবং নানাভাবে ব্যাংকের সঙ্গে জড়িত তারাও ভরসা পাবেন।
বর্তমানে আহত ব্যাংক খাতের রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে হবে। এটা করলেই কেবল হবে না, আমাদের একটা সুস্থ সবল ব্যাংক খাত তৈরি করতে হবে। সেটার জন্য আরো সংস্কার লাগবে এবং বিভ্রান্তিকর কথার প্রচার বন্ধ করতে হবে।
ব্যাংক খাতে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার কমেছে। তার পরও আমরা দেখছি অবৈধ টাকা বৈধ করার সুযোগটি আগের তুলনায় কিছুটা পরিমার্জন করে বহাল রাখা হচ্ছে। এ সুযোগ থাকার দরকার আছে কি?
এটা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়, এতে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হয়। এ সুযোগ দিয়ে অসৎ করদাতাদের উৎসাহিত করা হয়। এটার সাফল্যও বেশি নয়। কারণ যারা অবৈধভাবে টাকা আয় করে, তারা সেটা প্রকাশ করতে চায় না কোনোভাবেই, করলে বহু নজরদারির মধ্যে পড়তে হয়। মানে যতই অনুকূল পরিবেশ তৈরি হোক না কেন তারা নিজেদের প্রকাশ করতে চায় না। আর এবার টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ রাখা হবে বলা হচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করেও লাভ নেই। কেউই স্বীকার করবে না যে সে অসৎ পথে টাকা আয় করেছে। তাই নৈতিকতার জায়গা থেকেও এ ধরনের সুযোগ রাখা উচিত নয়। আমি মনে করি, অর্থ উপদেষ্টা এটা শুনবেন এবং বাতিল করবেন।
আসন্ন বাজেটের দর্শন ঠিক করা হয়েছে, ‘সমতাভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্র’। আমরা জানি সমতার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে রাষ্ট্রের অভৌত কাঠামো যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ ও বিনিয়োগ। পুরো বাজেটে এসব ক্ষেত্রের চিত্র কেমন দেখছেন?
জুলাই অভ্যুত্থানের দুটি মূল বিষয় ছিল বৈষম্য বিরোধিতা। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও বিষয়টা সামনে এল যে কীভাবে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়া যায়। আর দ্বিতীয় বিষয় ছিল কর্মসংস্থান। দুটি ক্ষেত্রেই বাজেটে বড় ঘাটতি আছে! কথায় অনেক কিছু আছে, কিন্তু বাস্তবে বাজেটের মধ্যে এটার অনুপস্থিতি বড় আকারে নজরে আসছে। বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা বিষয়ে কিছু জায়গায় বাজেটে কাটছাঁট করা হয়েছে। এবারের বাজেটে যে বড় ধরনের পরিবর্তন আসার কথা ছিল বৈষম্যবিরোধী চেতনা থেকে, সে জায়গায় আমি হতাশ হয়েছি। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে সরকারের কাজ করার সুযোগ ছিল। কারণ সরকারে যারা আছেন তারাও এ চেতনা নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। তারা চাইলে এগুলো নিয়ে আরো কাজ করতে পারতেন এবং তারা সময়ও পেয়েছেন। আমরা আশা করিনি যে অন্তর্বর্তী সরকার একটা গতানুগতিক বাজেট দেবে! সরকার চাইলে এটার কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে পারত।
কিছুটা সমালোচনা হয়তো হতো, তার পরও আমরা বুঝতাম ভিন্ন একটা পরিপ্রেক্ষিতে ও ভিন্ন কাঠামোয় শিক্ষা স্বাস্থ্যকে খুব গুরুত্ব দিয়ে তারা এটা করেছেন। শুধু বরাদ্দ বাড়ানোই নয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দক্ষতা কীভাবে বাড়ানো যায় সেক্ষেত্রেও গুরুত্ব দেয়া দরকার ছিল। কারণ বিগত বছর দেখেছি, তাদের টাকা আছে কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে খরচ করতে পারছে না। এ জায়গাগুলোয় পরিবর্তনের বিষয়ে আমরা আশাবাদী ছিলাম। সেটা একেবারেই নেই। এক্ষেত্রে আমরা হতাশ হয়েছি এবং একটা বড় সুযোগ হারিয়েছি। আমি বিভিন্ন সময় বলেছি, এবারের বাজেটকে একটা উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা যেত। পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার যে কারণে একটা চাপে থাকত যে ভিন্ন ধারার একটা বাজেট বাংলাদেশে করা সম্ভব।