কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বিনিয়োগের শর্তগুলো বুঝতে হবে

আবুল কাসেম হায়দার [প্রকাশ : যুগান্তর, ১২ মে ২০২৫]

বিনিয়োগের শর্তগুলো বুঝতে হবে

দেশে বিনিয়োগের বড় খরা চলছে। এ অবস্থার কবে উন্নতি হবে তা নিশ্চিত বলা যায় না। তবে ধারণা করা হচ্ছে সময় লাগবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসতে আরও একটু সময় লাগবে বলে মনে হচ্ছে। বড় সংকট আস্থার। দ্বিতীয় সংকট ব্যাংকিং খাতের। তৃতীয় সমস্যা হচ্ছে জ্বালানি ও বিদ্যুতের ঘাটতি।

 

 

কিছুদিন আগে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার জন্য ঢাকায় বেশ ভালো রকমের উন্নতমানের, তথা উপস্থাপনা বেশ চমৎকার-এমনই এক বিনিয়োগ সম্মেলন হয়ে গেল। কিছু কিছু বিনিয়োগ হয়েছে। বেশকিছু বিনিয়োগের প্রস্তাবনাও এসেছে। তবে অনেক প্রশ্ন। অনেক সমাধানের আশার বাণী শোনানো হয়েছে। ধীরে ধীরে বরফ গলবে মনে হয়।

 

বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান : কর্মসংস্থানের প্রধান চালিকাশক্তি বিনিয়োগ। যত বিনিয়োগ, তত উৎপাদন এবং সে অনুপাতে তৈরি হয় কর্মসংস্থান। বিডার বিনিয়োগবিষয়ক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৯-১০ সালে প্রায় ৩৯৩ কোটি মার্কিন ডলারের দেশি বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে ২ লাখ ৯১ হাজার ৪১৮ জনের। একই বছর ৮৯ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয় ৩৯ হাজার ২৪৫ জনের। আর ২০২০-২১ সালে ৬৬৬ কোটি ৬৯ লাখ ডলারের দেশি বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার ১০০ জনের। এর বিপরীতে প্রায় ১০৬ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয় ২০ হাজার ৬৮৬ জনের।

 

২০০৯-১০ থেকে ২০২০-২১ সাল পর্যন্ত মোট ৫৭৫ কোটি ডলারের স্থানীয় ১২ বছরে ১০ হাজার ৫৭৫ বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ২৮৫ হাজার ৯৪৩ লাখ ১৮ হাজার জনের। একই সময় কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয় প্রায় ৫ লাখ ৪৬ হাজার জনের। বিদেশি বিনিয়োগে এ দেশে আনুষ্ঠানিক খাতে একজনের কর্মসংস্থানে ৯৩ হাজার ৪২৮ ডলার বিনিয়োগ করতে হয়। এর বিপরীতে একজনের কর্মসংস্থান তৈরিতে স্থানীয় বিনিয়োগ লাগে ৩৭ হাজার ৫২৮ ডলার। অর্থাৎ কর্মসংস্থানে দেশি বিনিয়োগের তুলনায় একজনের বিদেশি বিনিয়োগ লাগে আড়াই গুণ বেশি।

 

 

বিদেশি বিনিয়োগের দুরবস্থা : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই থেকে ডিসেম্বর) দেশে প্রকৃত বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে ২১ কোটি ৩০ লাখ ডলারের। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৭৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে প্রকৃত বিদেশি বিনিয়োগ ৫৩ কোটি ১০ লাখ ডলার বা ৭১ শতাংশের বেশি কমেছে। স্থানীয় বিনিয়োগ থেকে যে মুনাফা হয়, তা সাধারণত দেশেই থাকে এবং পুনর্বিনিয়োগ হয়। স্থানীয় বিনিয়োগে যে পরিমাণ কর্মসংস্থান হয়, বিদেশি বিনিয়োগে ততটা হয় না। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিডার বিনিয়োগবিষয়ক সম্মেলনে আইএফসি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পাঁচটি বড় বাধা চিহ্নিত করা হয়। সেগুলো হচ্ছে বিদ্যুতের সমস্যা, অর্থায়নের সীমিত সুযোগ, দুর্নীতি, অনানুষ্ঠানিক খাতের আধিক্য ও উচ্চ করহার।

 

 


দেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বৈষম্য : দেশের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার বেশি, যদিও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিদেশ থেকে কম সুদে ঋণ আনতে পারেন। সেই সঙ্গে তারা মুনাফা অন্যদেশে নিয়ে যেতে পারেন; বাংলাদেশের স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা সাধারণত অন্য দেশে বিনিয়োগ করতে পারেন না। করতে চাইলে নানা সংস্থা থেকে অনুমোদন নিতে হয়। সেই কারণে বিদেশিদের তুলনায় দেশি উদ্যোক্তাদের বেশি প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। সম্প্রতি বিডা এত ঘটা করে বিনিয়োগ সম্মেলন করল, কিন্তু সেই সম্মেলনের পরপরই শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলো। এমনকি নতুন দামে গ্যাস দেওয়া হবে বলে অনেক দিন ধরে গ্যাসের নতুন সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না।

 

 

স্থানীয় বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে না। স্থানীয় হোক বা বিদেশি হোক, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নীতি ধারাবাহিকতার নিশ্চয়তা খুবই জরুরি। দুটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে সমস্যা রয়েছে। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগে স্থবিরতা।

 

 

দেশের বিদ্যমান অস্থিতিশীল পরিবেশ বিনিয়োগের জন্য অনুকূল নয়। এ পরিস্থিতিতে দেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা না পেলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আস্থা পাবেন না। বিদ্যমান এ অনিশ্চয়তা থেকে উত্তরণে গণতান্ত্রিক উত্তরণের রূপরেখা প্রয়োজন। সংস্কার কবে নাগাদ করা হচ্ছে, এরপর যারা ক্ষমতায় আসবেন, তারা বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কী ব্যবস্থা নেবেন-এসব বিষয় বোঝার জন্য বিনিয়োগকারীরা মুখিয়ে আছেন।

 

 

বিনিয়োগে বড় বাধা : আমরা চাই দেশে বিপুলসংখ্যক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক। বিনিয়োগ বাড়ুক। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি হোক। কিন্তু বাধা অনেক।

 

 

১. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি : দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১৭০০ মেগাওয়াট। উৎপাদনক্ষমতা রয়েছে ১৩০০ থেকে ১৫০০ মেগাওয়াট। ঘাটতি রয়েছে ২০০ মেগাওয়াট। আরও বেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে বিদ্যুতের ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে। অন্যদিকে বাংলাদেশে গ্যাসের বর্তমান চাহিদা রয়েছে ৪১০ কোটি ঘনফুট। গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে ৩৮০ কোটি ঘনফুট। ঘাটতি রয়েছে ১১০ কোটি ঘনফুট। দীর্ঘদিন দেশে গ্যাস উৎপাদনের জন্য কূপ খনন বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বিগত সরকার আমলে হয়ে পড়েছিল একটি আমদানিকারক সংস্থা বা এজেন্ট। অথচ এ প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ ছিল গ্যাস আবিষ্কার, উত্তোলন ও বিতরণ। এই কাজটি না করে প্রতিষ্ঠানটি দুর্বল ও অকেজো হয়ে পড়েছে। সমুদ্রে আমাদের গ্যাসের সন্ধানের কাজ এখনো শুরু করা যায়নি।

 

 

দেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বৈষম্য : ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার বেশি, যদিও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিদেশ থেকে কম সুদে ঋণ আনতে পারেন। সেই সঙ্গে তারা মুনাফা অন্যদেশে নিয়ে যেতে পারেন; বাংলাদেশের স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা সাধারণত অন্যদেশে বিনিয়োগ করতে পারেন না। করতে চাইলে নানা সংস্থা থেকে অনুমোদন নিতে হয়। সেই কারণে বিদেশিদের তুলনায় দেশি উদ্যোক্তাদের বেশি প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নীতি ধারাবাহিকতার নিশ্চয়তা খুবই জরুরি। দুটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে সমস্যা রয়েছে। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করছে।

 

 

২. অর্থায়ন ও ব্যাংক খাত : বিনিয়োগের জন্য আর্থিক বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশে বিনিয়োগ ব্যাংকগুলো অনেকটা দুর্বল ভূমিকায় রয়েছে। বিগত সরকারের আমলে পরিকল্পিতভাবে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসিসহ ১০টি ব্যাংকে লুটতরাজের মাধ্যমে পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো থেকে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে বিদেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে। দেশের অর্থ পাচার করে এস আলম ও সামিট পাওয়ার সিঙ্গাপুরে শ্রেষ্ঠ ধনীর তালিকায় স্থান পেয়েছে। অর্থ লুটের ফলে ব্যাংকগুলো সত্যিকার বিনিয়োগকারীকে ঋণ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই দেশি বিনিয়োগে ভাটা পড়েছে। দেশি বিনিয়োগ না হওয়ার কারণে বিদেশি বিনিয়োগ ও বেশ হ্রাস পেয়েছে। তাছাড়া রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসেনি। দুর্বল আর্থিক খাত দিয়ে কোনো দেশে বিনিয়োগ হয় না। যার ফলে উৎপাদন হ্রাস পায়। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায় না। বেকারত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতকে আসল স্থানে ফিরে আনতে হবে।

 

 

৩. দুর্নীতি ও অনিয়ম : বিগত স্বৈরশাসক ১৬ বছর ধরে একনাগাড়ে দেশকে দুর্নীতি ও অনিয়মের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। দুর্নীতি, অনিয়ম ও ঘুস বাণিজ্য ছাড়া সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করা যায় না। তাই আমাদের দেশে ব্যবসার খরচ অনেক বেশি হয়ে পড়ে। দুর্নীতি, অনিয়ম ও ঘুস বাণিজ্য বন্ধ করতে হলে সরকারকে কঠোর হতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপিসহ কর্তাব্যক্তিদের ব্যক্তিগতভাবে সৎ ও দেশপ্রেমিক হবে। মাথা ঠিক না হরে দেহের অন্য অঙ্গ কোনোক্রমে ভালো হতে পারে না। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে দুর্নীতি হ্রাস করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

 

 

৪. উচ্চ করহার ও সুদের আধিক্য : দেশে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক করহার অনেক। প্রায় ৪৫ শতাংশ কর আমাদের দিতে হয়। অধিক কর দেওয়ার কারণে বিনিয়োগে অর্থ আর থাকে না। কর অধিক হওয়ার ফলে ব্যবসায়ীদের দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হবে। কর, ভ্যাটসহ নানা করের জালে ব্যবসায়ীরা বন্দি। এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার।

 

 

 

৫. নীতি সহযোগিতা : নীতি সহযোগিতা বিনিয়োগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঘনঘন নীতি পরিবর্তনে বিনিয়োগকারীরা সমস্যার সম্মুখীন হন। বিশেষ করে ঘনঘন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি বিনিয়োগে বড় বাধা। তাতে দীর্ঘমেয়াদি প্রজেক্ট চালানো কঠিন হয়।

 

 

 

৬. জাতীয় নির্বাচন ও রাজনীতি : রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনিয়োগের প্রধান শর্ত। বিনিয়োগকারীরা স্থিতিশীল, দীর্ঘমেয়াদি সরকার চায়। তাই বিনিয়োগ বৃদ্ধির স্বার্থে দ্রুত জাতীয় নির্বাচন প্রয়োজন। দীর্ঘমেয়াদি নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন। তাই সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ একটি নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন। তবেই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ দেশে আসবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বেকারত্ব কমবে। দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।

 

 

 


আবুল কাসেম হায়দার : প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও সাবেক সহসভাপতি, এফবিসিসিআই