কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বিপ্লবীদের বাদানুবাদ ও প্রতিবিপ্লবীদের উচ্ছ্বাস

ড. মনজুর আলম । সূত্র : যুগান্তর, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বিপ্লবীদের বাদানুবাদ ও প্রতিবিপ্লবীদের উচ্ছ্বাস

জুলাই বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী কিছু সমন্বয়ক ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কতক উপদেষ্টা এবং কিছু রাজনৈতিক দলের নেতাদের (বিশেষ করে বিএনপির) সঙ্গে বাগবিতণ্ডা ইদানীং রাজনৈতিক মাঠে বেশ আগুন ছড়াচ্ছে। এ আগুন দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় অস্থিরতা ও উত্তাপ ছড়ালেও নিয়ন্ত্রণের বাইরে এখনো যায়নি। তাই অতিসত্বর এ আগুন নির্বাপণ না করলে লস অ্যাঞ্জেলেসের মতো সংস্কার, উন্নয়ন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, নতুন বন্দোবস্ত, নির্বাচন ধুলায় মিটে যাবে। সেই সঙ্গে গণতন্ত্র ও দেশের মানুষের স্বপ্ন সব পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।

 

 

তাই যারাই জুলাই বিপ্লবের পক্ষে ছিলেন, তাদের সবারই উচিত (এবং যারা বিদেশে আছেন) সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে যাতে এ আগুন অতিদ্রুত নেভানো যায়। নচেৎ বিপ্লবের সমর্থনকারীরাও মরবেন, দেশকেও মারবেন। পাশাপাশি দীর্ঘ ১৬ বছরে যারা শহিদ হয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন, দৃষ্টিহীন হয়েছেন, তাদের বলিদান বৃথা হয়ে যাবে।

 

 

দেশি-বিদেশি শকুনিরা হাঁ করে বসে আছে কখন এ বিভেদ জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের অংশীজনদের সমঝোতায় ফাটল ধরাবে আর তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে। এটা নিশ্চিত, তখন তারা আপনাদের খুবলে খুবলে খাবে, কচুকাটা করবে বা জীবন্ত কবর দেবে। আপনাদের জীবন্ত কবর দেওয়া বা কুচি কুচি কাটার উৎসবে আজকে যারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বাহিনীতে আপনাদেরই মদদে নিশ্চিন্তে ষড়যন্ত্র করছেন এবং আপনাদের বিভেদে আনন্দের ঢেঁকুর গিলছেন, তারাই পরমানন্দে সে উৎসবে যোগ দেবেন।

 

 

আপনাদের সব্বাইকে পুড়িয়ে বা বুড়িগঙ্গায় ডুবিয়ে মারার চিত্র অবিশ্বাস্য মনে হলেও (যেমনটা কোনো কোনো দল অতীতে মনে করেছিল ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে যোগ দিলে তাদের নেতাদের ফাঁসি হবে না) এটাই সত্যি হতে পারে। হতে পারা নয়, হবেই। নিকট ইতিহাস তারই প্রমাণ দেয়। তাই ‘সাধু সাবধান’। আপনাদের বিভাজনের সুযোগ নিয়ে বিগত কিছুদিন কোনো আলামতই কি দেখতে পাচ্ছেন না? ভাববেন না এগুলো একসূত্রে গাঁথা নয়।

 


ঘুম যদি ভেঙে থাকে, তবে এখনই শুদ্ধি অভিযান শুরু করুন উপদেষ্টামণ্ডলীতে, মন্ত্রণালয়ে, দপ্তরে, বিভিন্ন বাহিনীতে। নিজেদের কবর নিজেরা খুঁড়তে না চাইলে এখনই জরুরি ভিত্তিতে। এর কোনোই বিকল্প নেই। যতই দিন যাবে, ততই কঠিন হয়ে পড়বে। নির্বাচন হলে তখন শুদ্ধি অভিযান করবেন ভাবছেন? ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যাবে। শিকড় অনেক গভীরে চলে যাবে। কথায় আছে, ‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো’। এখনই গোয়ালঘর পরিষ্কারের কোনো বিকল্প নেই। বলিষ্ঠ (robust) পরিকল্পনা করুন, পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ও আদর্শ সবাইকে অবহিত করুন। জুলাই বিপ্লবের সব অংশীকে সঙ্গে নিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করুন।

 

 

অন্তর্বর্তী সরকার আজ ক্ষমতায়, তাই তাদেরই দায়িত্ব সিন্ডিকেট ভাঙা এবং ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা। দায়িত্ব তাদেরই। এখন তারা কীভাবে সমস্যাগুলোর সমাধান করবেন তার দায়িত্ব তাদেরই। পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং জবাবদিহিতা তাদেরই দায়িত্ব। তাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে-যারা বিপ্লব সমর্থন করেছে, তাদের সঙ্গে মিলে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে, না একাকী নিজেরাই করবে? এটা অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত। কিন্তু পাশাপাশি এর দায়-দায়িত্বও তাদের।

 

 

দেশের মানুষ কিন্তু সিন্ডিকেট, ষড়যন্ত্র ইত্যাদি শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে উঠছে।। সত্যিকার শুদ্ধি অভিযান চালু হলেই অনেক সমস্যার সমাধান হতে শুরু করবে। অনেক সিন্ডিকেট দুর্বল হতে হতে ভেঙে যাবে। ষড়যন্ত্রও মুখ থুবড়ে পড়বে। থিতিয়ে যাবে। জনগণও সাময়িক অসুবিধা মেনে নেবে। হাতে কিন্তু সময় বেশি নেই।

 

 

ষড়যন্ত্র, সিন্ডিকেট ইত্যাদির দোহাই দিয়ে সরকার ও উপদেষ্টাদের অক্ষমতাকে জনগণ আর কতদিন সহ্য করবে? সেই সঙ্গে বিপ্লবের সব অংশীকে মনে রাখতে হবে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হওয়া মানে তাদেরও ব্যর্থতা (যদিও সরাসরি তারা দায়ী নন!)। বর্তমানে ফ্যাসিস্টদের দোসররা জুলাই বিপ্লবের সমর্থনকারীদের দ্বন্দ্ব, বিভেদ ও ক্ষুদ্র স্বার্থ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অরাজকতার সৃষ্টি করছে, তা কি আপনারা দেখতে পাচ্ছেন? ক্ষমতায় গেলে আজকের সমস্যা আপনাদেরও সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। সে কথা ভেবেছেন কি?

 

 

তাই আজ সবাই যদি এক কণ্ঠে ফ্যাসিস্ট ও তার দোসরদের প্রতিহত করতে না পারেন, সেদিন বেশি দূরে নয় যে, আপনাদেরই তারা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে জীবন্ত পুড়িয়ে বা ডুবিয়ে মারবে। সন্দেহ হলে অতীতের গুম-খুন হত্যাবিষয়ক খবরাখবর দেখে নিন, সাক্ষাৎকার শুনুন এবং আয়নাঘর ইত্যাদি দেখে আসুন। তাই এখনই নিজ স্বার্থেই দ্বন্দ্ব-বিভেদ, ক্ষুদ্র স্বার্থ পরিত্যাগ করুন। আপনাদের অনুসারীদের পরিহার করতে বলুন।

 

 

আজ বাংলাদেশের মানুষ এক নতুন স্বপ্ন দেখছে-যেখানে আমরা সবাই গর্ব করে বলতে পারি ‘আমরা বাংলাদেশের মানুষ’। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক। আমাদের সরকারকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এক নোবেল বিজয়ী (এ মুহূর্তে বিশ্বে তিনিই একমাত্র নোবেল বিজয়ী সরকারপ্রধান)। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এটা আমরা অবশ্যই গর্ব করে বলতে পারি।

 

 

বিশেষায়িত বিশ্ব ফোরামে বা অনুষ্ঠানে অনেক সরকারপ্রধানকে লবিস্ট নিয়োগ করতে হয় একটা গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় মিটিং আয়োজনে। সেখানে সম্প্রতি ডাভসে আমাদের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় মিটিং করার জন্য অন্যদের লাইন পড়ে গেছে। মাত্র চার দিনে ৪৭টি মিটিং। এর গুরুত্বটা যে কতটুকু, তা জেনেই আমাদের মাথা আকাশ ছুঁয়েছে। এটা অনস্বীকার্য, বাংলাদেশকে প্রফেসর ইউনূস এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেন। আগামীতে দেশের রাষ্ট্রনায়করা সে মাত্রা ধরে রাখবেন, আর তাতেই বাংলাদেশের মানুষ বুক চিতিয়ে বলবে, ‘আমি বাংলাদেশি’।

 

 

আমরা বাংলাদেশিরা পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। আমরাই সে জনগোষ্ঠী, যারা ইতিহাসের বর্বরতম ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিনা হাতিয়ারে পালাতে বাধ্য করেছি! মৃত্যুকে পরোয়া না করে আমরা সীমান্ত বাহিনীর সঙ্গে হাতে হাত রেখে দেশের প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষার জন্য কাস্তে হাতে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হতে পারি। আমরাই সেই জাতি, যারা দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য, ভাষার জন্য অবলীলায় জীবন বিসর্জন দিতে পারি। আমার দেশের ছাত্ররাই বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পারে। কিন্তু দেশ-বিদেশের শকুনিরা আমাদের শান্তিতে থাকতে দেবে না। আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেবে না। অথচ ইতিহাসের প্রতিটি সন্ধিক্ষণে আমরা সব ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে লড়াই করে শত্রুকে পরাজিত করেছি।

 

 

ইতিহাসের তেমনি এক সন্ধিক্ষণে আজ যদি আমাদের একতাই না থাকে, তাহলে লাখো-কোটি মানুষের প্রত্যাশা, তরুণ ছাত্রদের স্বপ্ন, নতুন বাংলাদেশ-সেটা গড়ার আগেই তা পুড়ে যাবে। যে কৃষক কাস্তে হাতে দেশ রক্ষায় জীবন বাজি রেখে সীমান্তে দণ্ডায়মান, দেশকেই যদি কেউ গিলে খায়, তবে সে কৃষক কোন সীমান্ত রক্ষা করবে? আমাদের সবার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে। আমরা কি সেটাই চাই?

 

 

আমরা যে দলই করি না কেন, যে রাজনৈতিক ভাবনা থাকুক না কেন, আমরা জানি, দেশের প্রতিটি ব্যবস্থা, প্রতিটি খাত পঙ্কিলতায় ভরে আছে। সবকিছুই অনৈতিক কর্মকাণ্ডে ঠাসা। আর তার অন্যতম কারণ (একমাত্র নয়) রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন। রাজনীতিবিদদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড, নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন। ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন। প্রশাসনকে আজ্ঞাবহ দাস হিসাবে ব্যবহার।

 

 

তাই প্রশ্ন : প্রতি পাঁচ বা চার বছর পরপর নির্বাচন হলেই কি গণতন্ত্র চালু হয়ে যাবে? গণতন্ত্র জীবনের, অর্থনীতির, পররাষ্ট্রনীতির, সমাজব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে নিয়ে যাওয়াই কি গণতান্ত্রিক দলগুলোর কাজ নয়? ভোট শেষ হয়ে গেলে জনগণকে নেতাদের এত ভয় কেন? সব কর্মের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে কেন এত অনীহা? গণতন্ত্রের মিথ্যা সবক দিয়ে আর কতদিন!

 

 

নীতিনির্ধারকরা বা দেশের কর্তাব্যক্তিরা যদি জবাবদিহিতার আওতায় থাকেন, তাহলে কারও পক্ষেই জবাবদিহিতার বাইরে অবস্থান সম্ভব নয়। গণতান্ত্রিক দেশে আইন সবার জন্যই সমান-তা তিনি প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী বা দেশের একজন কৃষক, শ্রমিক বা ছাত্র, যাই হোন না কেন।

 

 

প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, রাষ্ট্র সংস্কার এক চলমান পদ্ধতি। এটা আবহমানকাল ধরে চলবে। উপরন্তু সংস্কার ভালো ফল নিয়ে আসতে পারে, আবার খারাপ ফলও হতে পারে। নির্ভর করছে সংস্কার প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য, সময় কাঠামো, পরিকল্পনা, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় উপকরণ (অর্থবল, লোকবল এবং আনুষঙ্গিক সুবিধা) ও পরিচালনা। আরও সোজাসাপটা করে বললে-কাগজে-কলমে সংস্কার করলেই কী, আর না করলেই কী? যদি তার ব্যবহারিক প্রয়োগই না হয় বা ভালো উদ্দেশ্যে না হয়! আমাদের দেশে এ রকম লাখ লাখ উদাহরণ রয়েছে। একদিনের পত্রিকা পড়লেই হাজার হাজার আইনের অপপ্রয়োগ ও প্রয়োগহীনতার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে।

 

 

তাই আমাদের দেশের মূল সমস্যা : এক : ‘আইন সকলের জন্য সমান নয় এবং প্রয়োগ ভিন্নতা’; দুই : সর্বক্ষেত্রে জবাবদিহিতা এবং দায়িত্ববোধের অভাব। এসব অনিয়ম-অনাচার বাড়তে বাড়তে এমন এক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, দেশের তরুণ সমাজ আর নিতে পারছিল না। ১৬ বছরেরও দীর্ঘ সময় দেশের সব মানুষ এক বৃহৎ জেলখানায় থাকতে থাকতে বোধশক্তি হারাতে বসেছিল। সব অন্যায়কেই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। আইনের অপপ্রয়োগকেই নিয়মসিদ্ধ বা ভবিতব্য বলে ভাবতে শুরু করেছিল।

 

 

তখনই দেশের ছাত্র ও তরুণ সমাজ সে যন্ত্রণাদায়ক অনাচার আর মেনে নিতে পারেনি। তাই তারা সব ভয়কে জয় করে সমস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠেছিল, ‘আর নয়! অনেক হয়েছে, আর নয়’। ‘আমরা আর এ দুর্গন্ধময় পঙ্কিল সমাজব্যবস্থায় থাকতে রাজি নই। অনেক হয়েছে, আর নয়’।

 

 

রাজনৈতিক পঙ্কিলতা, কুটচাল, সর্বগ্রাসী ক্ষমতার অপব্যবহার, অনৈতিকতা, বৈষম্য ও বীভৎসতা থেকে মুক্তি পাওয়াই যে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মূল কারণ, সেটা উচ্চকণ্ঠে বলার প্রয়োজন নেই। ছাত্র ও তরুণরাই সে অমাবস্যার অন্ধকারে দেশকে আলো দেখিয়েছিল। এক অজানা অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে দেশের মানুষকে আলোর বর্তিকা দেখিয়ে বের করে এনেছিল। ১৬ বছর এক বৃহৎ কারাগারে থাকা দেশের জনসাধারণ তাই পাগলের মতো ছুটে বের হয়ে এসেছিল মুক্তির স্বাদ নিতে। স্বাধীনভাবে আবার বাঁচতে।

 

 

এ কথা অনস্বীকার্য যে, এ বিপ্লবে সব স্তরের, সব দল, জাতপাত, শ্রেণি নির্বিশেষে সবাই অংশ নিলেও ছাত্ররাই আলোর মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিল। সমাজের উচ্চস্তরের সুবিধাভোগী শ্রেণির পুত্র-কন্যা থেকে শুরু করে কৃষক-শ্রমিক-রিকশাচালকের সন্তান, সবাই সেই আলোর মিছিলে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এটাই সহজ সরল সত্যি।

 

 

এটাও সত্যি যে, সে অগ্নিবিস্ফোরণে সমাজের সব স্তরের সব গোষ্ঠীর সব মতের মানুষ আলোর বর্তিকা মিছিলে দলবেঁধে অংশগ্রহণ করেছিল। অনেকে সুবিধাভোগী হলেও নীতির প্রশ্নে, ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নে, সত্য-মিথ্যার প্রশ্নে সমাজের বিরুদ্ধে, প্রচলিত শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শক্তি ধারণ করেছিল। সুবিধাভোগী হয়েও নীতি-আদর্শকে বিসর্জন দেয়নি। প্রয়োজনে ঠিকই সমাজের উচ্চস্তরের বিরুদ্ধে নীরব যুদ্ধ করেই সেই আলোর বর্তিকার মিছিলে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আদর্শ, মানবিকতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই তারা জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে জীবন বাজি রেখে অংশগ্রহণ করেছিল।

 

 

আজ তাই প্রশ্ন-ছাত্রদের আলোর বর্তিকার মিছিলে যারা পথ দেখিয়েছিল, তারা তো আমাদেরই সন্তান, ভাইবোন বা আত্মীয়স্বজন। তবে কেন আজ বিভাজনের কথা উঠছে? কেনই বা তারা বাবা-মা, চাচা-চাচি বা বড়ভাই সমতুল্যদের যথাযথ সম্মান করছে না, অগ্রহণযোগ্য ভাষায় কথা বলছে? কোথায় যেন বিভ্রাট।

 

 

বিভ্রাটই হোক আর অবিবেচনাপ্রসূতই হোক, এ রকম বাহাসে কাদের লাভ? কারা বিভাজনের গন্ধ পেয়ে তালি বাজাচ্ছে। দেশ ও বিদেশের কিছু সংবাদমাধ্যম, ইউটিউব, ফেসবুক তার প্রমাণ। অতি সূক্ষ্মভাবে বিভাজনের বীজকে কারা পানি দিচ্ছেন, কথামালার রং ছিটিয়ে কিছু মিডিয়া বিশ্লেষণের নামে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টিতে তাপ ছড়াচ্ছেন-সে ব্যাপারে সব জুলাই-আগস্ট বিপ্লব সমর্থকদের বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।

 

 

কিন্তু এর মূল দায় ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক নেতাদের ওপরই বর্তায়। তাই প্রশ্ন স্বাভাবিক, তারা কি ফ্যাসিস্ট সরকার বা তার প্রেতাত্মার প্রত্যাবর্তন চাইছেন? তারা কি চান, স্বৈরাচার বা তার দোসররা ছলে-বলে-কৌশলে দেশকে আবারও অন্ধকার জগতে নিয়ে যাক? তখন কিন্তু সবার আগে এখন যারা কাদা ছোড়াছুড়ি করছেন, তাদের লাশই বুড়িগঙ্গায় ভাসবে। বা খুঁজে পাওয়া যাবে না। কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই অপ্রিয় সত্য।

 

 

তাই যারা সমস্বরে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ ধ্বনি দিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারকে দেশছাড়া করেছেন, তারা নিজেদের মাঝে কাদা ছোড়াছুড়ি থেকে বিরত থাকুন। আপনারা মাফ করলেও ফ্যাসিস্টরা কিন্তু আপনাদের মাফ করবে না। তাই প্রত্যেকেই একে অপরকে শ্রদ্ধা করুন সম্মান দিয়ে এবং শব্দচয়নে সতর্ক থাকুন। বড়দের সম্মান করুন, ছোটদের আশীর্বাদ দিন। কথা বলার আগে চিন্তা করুন। কারণ অনেকেই এখন ভোল পালটে আপনার শব্দবিভ্রাটকে কাজে লাগিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে ওতপেতে বসে আছে। তাই কোথায় কী বলবেন পরিষ্কার থাকুন। ভুল হলে শুধরে নিন।

 

 

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, প্রধান উপদেষ্টার আমন্ত্রণের অপেক্ষা না করেই (যদিও প্রধান উপদেষ্টার অফিস এ ব্যাপারে আরও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন) আপনারা নিজেরাই ঘনঘন একসঙ্গে বসুন, কথা বলুন এবং মনোমালিন্য বা নীতিগত বৈপরীত্যের সমাধান বের করুন। প্রয়োজনে একসঙ্গে বসে ফ্যাসিস্ট ও তার দোসরদের কীভাবে প্রতিহত করবেন শালাপরামর্শ করুন। বারবার বসুন। একসঙ্গে জনসভা করুন। একসঙ্গে সবাই স্রেফ জনসভা করলেই পুরো চিত্র বদলে যাবে (যদিও যারা পরিস্থিতির ফায়দা লুটতে চায়, তারাই এর বিরোধিতা করবে)। আপনারাও জানতে পারলেন ঘরের শত্রুকে সেই বিভীষণ। দেশের স্বার্থে পতিত সরকার ও তাদের দোসরদের বিপক্ষে আপনাদের একাত্মতা জানান দিন।

 

 

আজ দেশের মানুষ আশ্বস্ত হতে চায়। আর তারা আশ্বস্ত হলেই বিদেশ এবং দেশে যারা দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড করছে, তাদের পা থেকে ধীরে ধীরে মাটি সরে যাবে। একদিন সে চোরাবালিতে অবশ্যই তাদের বিলুপ্তি ঘটবে। ফ্যাসিস্ট প্রেতাত্মাদের আজীবন কবরখানায় পাঠানোর শক্তি আপনাদেরই হাতে। দেরি হওয়ার আগেই সে শক্তি সংগঠিত করুন। দেশ, জনগণ এবং আপনাদের স্বার্থেই সে শক্তি প্রয়োগ করুন।


ড. মনজুর আলম : সহযোগী অধ্যাপক, হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়, ফিনল্যান্ড