বিসিএস পরীক্ষার সিলেবাস পরিবর্তন প্রস্তাব ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
সফিক ইসলাম । সূত্র : বণিক বার্তা, ২০২ মার্চ ২০২৫

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন সম্প্রতি সরকারের কাছে তাদের সুপারিশমালা পেশ করেছে। এতে তারা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) লিখিত পরীক্ষার সিলেবাস পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছে। কমিশন বিসিএসের জন্য ৬০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষার প্রস্তাব করেছে। বর্তমানে বিসিএস চাকরিপ্রার্থীদের ৯০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা দিতে হয়। এর মধ্যে বাংলা ২০০, ইংরেজি ২০০, বাংলাদেশ বিষয়াবলি ২০০, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি ১০০, গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা ১০০ এবং সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ১০০। কমিশন তাদের সুপারিশে বাংলায় ২০০ নম্বরের পরিবর্তে ১০০ নম্বর, বাংলাদেশ বিষয়াবলি ২০০ নম্বরের পরিবর্তে ১০০ নম্বর, গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা ১০০ নম্বর সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে ৬০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা নেয়ার সুপারিশ করেছে। কমিশন কেন লিখিত পরীক্ষার নম্বর কমানোর সুপারিশ করেছে তার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। এমনকি তারা কেন গণিত বাদ দেয়ার সুপারিশ করেছেন তারও কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। সংগত কারণেই কমিশনের এমন প্রস্তাবে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) হলো রাষ্ট্রের জন্য ‘উপযুক্ত ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি নির্বাচন করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের জন্য এ ‘উপযুক্ত ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি’ নির্বাচন করা এ প্রতিষ্ঠানের প্রধানতম দায়িত্ব।
- সিলেবাস একটি টেকনিক্যাল বিষয় এবং তা সম্পূর্ণরূপেই একটি ফলাফলভিত্তিক বিষয়। অর্থাৎ কোনো পরীক্ষা বা কোর্সের সিলেবাস কেমন হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ভর করে এ পরীক্ষা বা কোর্সের মাধ্যমে আমরা কী অর্জন করতে চাই তার ওপর। এটা কেবল বিসিএস পরীক্ষার জন্যই সত্য নয়, যেকোনো একাডেমিক কোর্সের জন্যও সত্য। ডাক্তারি কোর্সের সিলেবাস যেমন হবে, কম্পিউটার প্রকৌশল কোর্সের সিলেবাস তার থেকে অবশ্যই ভিন্নতর হবে। সংগত কারণেই পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষার সিলেবাস কেমন হবে তা নির্ভর করবে আমরা কেমন পাবলিক সার্ভেন্ট চাই তার ওপর। একই সঙ্গে আমাদের জেনে নেয়া দরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় আমাদের কেমন পাবলিক সার্ভেন্ট দরকার?
- বাংলাদেশ কোনো রাজতান্ত্রিক বা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র নয়। এটি সামন্তবাদী রাষ্ট্রও নয়। পরিপূর্ণরূপে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র না হয়ে উঠলেও সম্ভবত একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিনির্মাণই বাংলাদেশের লক্ষ্য। সাংবিধানিকভাবে এ রাষ্ট্রের মালিক হলো এর জনগণ। কাজেই স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বাংলাদেশের সব পেশার প্রধান লক্ষ্যই হলো এ রাষ্ট্রের নাগরিকদের সর্বোচ্চ মঙ্গলসাধন। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কারো পক্ষেই এখন আর বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা সম্ভব নয়। ফলে পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা, সহযোগিতা ও সুসম্পর্ক বজায় রেখে মোটামুটি বৈশ্বিক মানের জনসেবা প্রদানও সরকারি কর্মচারীদের অন্যতম লক্ষ্য। কাজেই যেকোনো পদ বা পেশাই হোক না কেন, কর্মস্থল দেশের ভেতরে কিংবা বাইরে যেখানেই হোক না কেন, সর্বাবস্থায়ই রাষ্ট্রের নাগরিকদের সর্বোচ্চ মাঙ্গলসাধন এবং রাষ্ট্রের স্বার্থ সর্বোচ্চকরণই হলো সরকারি কর্মচারীদের প্রধানতম করণীয়। এ লক্ষ্য সামনে রেখেই পিএসসি বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্য থেকে ‘উপযুক্ত ও যোগ্যতর’দের বাছাই করার দায়িত্বপ্রাপ্ত একটি প্রতিষ্ঠান।
- কোনো দেশের নাগরিকের সর্বাধিক মঙ্গলসাধনই যদি এর কর্মচারীদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে থাকে তাহলে সবার আগে চাকরিপ্রার্থীদের নিজ দেশ, নিজ দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস, দর্শন, ভাষাসহ সবকিছু অত্যন্ত ভালোভাবে জানতে হবে। এ কারণে যেকোনো রাষ্ট্রেই সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে নিজ দেশের ভাষা, ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বাংলাদেশও এর থেকে ভিন্নতর হতে পারে না। ফলে বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারি চাকরিজীবীকে বাংলাদেশের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। কিন্তু কমিশন বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ বিষয়াবলির ওপর ২০০ নম্বর কমানো সুপারিশ করেছে যা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
- কমিশনের রিপোর্টের সবচেয়ে মারাত্মক দিকটি হলো গণিত ও মানসিক দক্ষতার ১০০ নম্বর বাদ দেয়ার সুপারিশ। প্রথমেই বলে নেয়া দরকার, বর্তমানে পিএসসির সিলেবাসে যে গণিত রয়েছে তা উচ্চতর গণিত নয়, মৌলিক গণিত। গণিতের ভাষায় একে প্রাথমিক গণিতই বলা চলে। নির্দিষ্ট মাত্রার মৌলিক গণিত পৃথিবীর সব দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বাধ্যতামূলক রাখা হয়। বাংলাদেশের সর্বশেষ শিক্ষানীতিতেও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর পর্যন্ত গণিতকে বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে। এমনকি মাদ্রাসা শিক্ষায়ও গণিত বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
- কিন্তু মৌলিক গণিত কেন বাধ্যতামূলক করা হয়? মৌলিক গণিত শুধু একটি বৈজ্ঞানিক বা একাডেমিক বিষয় নয়, বরং এটি বাস্তব জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। এই গণিতের গুরুত্ব সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই, কারণ এটি আমাদের প্রতিদিনকার জীবন এবং কাজের সঙ্গে এমনভাবে জড়িত যে তা যেকোনো বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই বুঝতে সক্ষম। আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার প্রায় সব স্তরে গণিতের ব্যবহারকেও কেউ অস্বীকার করতে পারে না। সংগত কারণেই পৃথিবীর উন্নত দেশের পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষায় গণিতকে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সিঙ্গাপুরসহ পৃথিবীর সব দেশের পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষায় গণিত উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ভারতে গণিত কেবল মানসিক দক্ষতা পরিমাপের জন্য নয়, বরং সরকারি কর্মকর্তাদের একটি মৌলিক দক্ষতা বলে বিবেচনা করা হয়। ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় গণিতের যে গুরুত্ব দেয়া হয়, বাংলাদেশের সামগ্রিক বিসিএস পরীক্ষায়ও ততটা গুরুত্ব দেয়া হয় না। ভারতে প্রিলিমিনারি পর্বে ২০০ নম্বরের পরীক্ষা নেয়া হয়। এর মধ্যে সাধারণ জ্ঞান ১০০ নম্বর ও দক্ষতা মূল্যায়ন ১০০ নম্বর। দক্ষতা মূল্যায়নের বড় অংশজুড়ে রয়েছে গাণিতিক দক্ষতা, যৌক্তিক দক্ষতা। চীনের পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষায় বেসিক গণিত, বীজগণিত, পরিসংখ্যান ও সম্ভাব্যতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর বাইরে তত্ত্ব¡ ও উপাত্ত বিশ্লেষণ, চার্ট, লেখচিত্র, অনুপাত ও শতাংশভিত্তিক গণনাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
- বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। গণতন্ত্র যেখানে এখনো প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি লাভ করেনি। এখানে সরকারি চাকরিজীবীদের প্রশাসনিক দক্ষতার ওপরই বহুলাংশে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। কাজেই এমন একটি রাষ্ট্রের জন্য দক্ষ প্রশাসনিক কর্মী বাহিনীর বিকল্প নেই। আর মৌলিক গণিতে পর্যাপ্ত জ্ঞান ছাড়া দক্ষ কর্মীবাহিনী সম্ভব নয়। কারণ রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো, আর্থিক নীতি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও উন্নয়ন প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের সঙ্গে গণিতের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে যারা রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত থাকবেন বা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী কাজ করবেন, তাদের জন্য মৌলিক গণিতের পাশাপাশি আরো কিছুটা উচ্চতর গণিতের জ্ঞান থাকা জরুরি।
- গণিত যুক্তিশীল চিন্তা ও বিশ্লেষণাত্মক দক্ষতা গড়ে তোলার প্রধানতম হাতিয়ার। ফলে গণিত-জ্ঞান জটিল সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়াকে সহজ ও সুনির্দিষ্ট করে তোলে। আধুনিক যুগকে বলা হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যুগ। এ যুগে রাষ্ট্রের প্রায় সব স্তরের কাজেই তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ, সংকলন, বিশ্লেষণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এ তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমেই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। গণিতের পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকলে সরকার বা প্রশাসন বা দায়িত্বশীল কারো পক্ষে এ বিশ্লেষণ কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পাদন করা সম্ভব নয়, যার ফলে উন্নয়ন পরিকল্পনা, জনসংখ্যার হিসাব, অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে জটিল সমস্যা সৃষ্টি হতে বাধ্য। সর্বোপরি গণিতের জ্ঞান মানুষের মেধা ও মননের বিকাশ ঘটায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। গণিতজ্ঞান থাকলে একটি লেখচিত্র থেকেই পুলিশের একজন কর্মকর্তা খুব সহজেই তার এলাকার অপরাধপ্রবণতা উপলব্ধি করতে পারবে কিংবা একটি ছোট্ট সারণি থেকেই একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা দ্রব্যমূল্যের হাল-হকিকত সম্পর্কে ধারণা পাবেন এবং তার করণীয় নির্ধারণ করতে পারবেন। গণিতে ন্যূনতম জ্ঞান ছাড়া এ দক্ষতা অর্জন অসম্ভব। তাই গণিত বাদ দেয়া মানে হলো রাষ্ট্র পরিচালনায় কর্মচারীদের যুক্তিশীলতা ও বিশ্লেষণ দক্ষতার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা এবং যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে অবমূল্যায়ন করা। কাজেই জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার সিলেবাস থেকে গণিত বাদ দেয়ার সুপারিশ কেবল অগ্রহণযোগ্যই নয়, তা রাষ্ট্রের জন্য ঝুঁকিপূর্ণও বটে। এটি কেবল সরকারি কর্মচারীদের প্রশাসনিক দক্ষতার ওপর বিরূপ প্রভাবই ফেলবে না, বরং সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়নেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
- জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট থেকে অনুমান করা যায়, বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার নম্বর কমানোর সুপারিশের পেছনে একটি কারণ হতে পারে সময় বাঁচানো। কমিশনের রিপোর্টের সংযুক্তি ৯-এ উল্লেখ করা হয়েছে, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা নিতে সময় নেয় সাড়ে তিন থেকে সাড়ে চার বছর। উদাহরণ হিসেবে তারা ৪১তম বিসিএসেএর কথা উল্লেখ করেছে। ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশে পিএসসি সময় নিয়েছে পাঁচ মাস, যা সম্পূর্ণরূপে অযৌক্তিক। কারণ প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় এমসিকিউ পদ্ধতিতে। মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয় এমসিকিউ পদ্ধতিতে এবং তারা তিন লাখ প্রার্থীর ফল প্রকাশ করে মাত্র তিনদিনে। সেখানে পিএসসি অনুরূপ পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে সময় নেয় পাঁচ মাস। একই রকম দীর্ঘসূত্রতা লক্ষ করা যায় লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ক্ষেত্রেও। পরীক্ষা পরিচালনা ও ফল প্রকাশে পিএসসির দীর্ঘসূত্রতা তাদের অযোগ্যতা ও অদক্ষতারই প্রকাশ। কিন্তু এর সংশোধন করতে হবে তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে; পরীক্ষার নম্বর কমিয়ে নয়।
কাজেই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার নম্বর কমানোর সুপারিশ গ্রহণযোগ্য নয়, এ অযৌক্তিক সুপারিশ প্রত্যাহার করতে হবে। একই সঙ্গে বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় গণিতের অংশ বৃদ্ধি করতে হবে, লিখিত পরীক্ষায় বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ বিষয়াবলির নম্বর বণ্টন ২০০ অপরিবর্তিত রাখতে হবে এবং গণিত ও পরিসংখ্যানের জন্য ১০০ নম্বর এবং মানসিক দক্ষতার জন্য ১০০ নম্বর নিশ্চিত করতে হবে।
সফিক ইসলাম: সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি হরগঙ্গা কলেজ