বিশ্ব আজ নিয়ন্ত্রণহীন?
সাখাওয়াত হোসেন সুজন [প্রকাশ : দেশ রূপান্তর, ০১ ডিসেম্বর ২০২৫]

জাতিসংঘরের সদস্যদের ৮০ ভাগ দেশ ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। এ বছর নতুন করে যারা স্বীকৃতি দিয়েছে তারা হলো ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, পর্তুগালসহ অনেক দেশ। মোট ১৫৭টি দেশের এই স্বীকৃতিও যেন প্রতীকী। এত কিছুর পরও ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নেই ফিলিস্তিনিদের হাতে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বাস্তব নিয়ন্ত্রণ (ডি ফ্যাক্টো) আইনি স্বীকৃতির চেয়ের শক্তিশালী। প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন সরকারই ফিলিস্তিনের এই ডি ফ্যাক্টো সরকার। এই সরকার পশ্চিম তীরের কিছু অংশ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে। সেখানে পুলিশ, স্কুল, হাসপাতাল ইত্যাদি চালায়।
গাজায় ২০০৭ থেকে হামাস ডি ফ্যাক্টো নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু ২০২৫-এর যুদ্ধের পর যুদ্ধবিরতি হয়েছে। এখনো গাজার বড় অংশ ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। প্রায় ৭৫ শতাংশকে তারা বাফার জোন তথা করিডর হিসেবে ব্যবহার করছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ ফিলিস্তিনিদের হাতে নেই। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, বিশ্বনিয়ন্ত্রণও বিশ্ববাসীর হাতে নেই। না হলে বর্তমান বিশ্বে মানবিকতার এমন বিপর্যয়কর অবস্থা হওয়ার কথা ছিল না। নখদন্তহীন বাঘ জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনও এমন কথা বলছে। দুই বছর ধরে পরিচালিত জরিপের ওপর ভিত্তি করে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন প্রমাণ করে, ‘সংগঠিত ও ব্যাপক নির্যাতনের কার্যত রাষ্ট্রীয় নীতি’ গ্রহণ করেছে ইসরায়েল।
গার্ডিয়ানে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যুদ্ধাপরাধে নিরাপত্তা বাহিনীকে একেবারে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে, যা উদ্বেগজনক। ফিলিস্তিনি বন্দিদের বারবার গুরুতর মারধর, কুকুর লেলিয়ে দিয়ে আক্রমণ, বিদ্যুতের শক, পানিতে চুবিয়ে নির্যাতন, দীর্ঘক্ষণ চাপ দিয়ে রেখে অত্যাচার ও যৌন সহিংসতার প্রমাণ এক ভয়াল দানবের স্বরূপ উন্মোচন করে যার নাম ইসরায়েল। প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনি বন্দিদের ‘পশুর মতো আচরণ করতে বাধ্য করা বা প্রস্রাব করানো’ দ্বারা অপমাণিত করা হয়েছিল।
পদ্ধতিগতভাবে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করা, অতিরিক্ত বাধা প্রয়োগ, হাত-পায়ের সামান্য ক্ষতকে বাড়িয়ে অঙ্গচ্ছেদ পর্যন্ত করার ঘটনা পাওয়া গেছে। এর মানে, হাতে চোট লাগলে হাত কেটে ফেলা এবং পায়ে আঘাত লাগলে পা কেটে ফেলা। জাতিসংঘের ১০ জন স্বাধীন বিশেষজ্ঞ কমিটি ইসরায়েলের বেআইনি যুদ্ধ আইনের ব্যাপক ব্যবহারের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা হাজার হাজার ফিলিস্তিনি পুরুষ, নারী এবং শিশুদের বিচার ছাড়াই দীর্ঘস্থায়ী আটককে ন্যায্যতা দিতে চাইছে। খোদ ইসরায়েলি মানবাধিকার গোষ্ঠীর সর্বশেষ পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলি কারাগার ৩ হাজার ৪৭৪ জন ফিলিস্তিনিকে ‘প্রশাসনিক আটক’, অর্থাৎ বিচার ছাড়াই আটকে রেখেছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে দুই বছরের সময়কালকে অন্তর্ভুক্ত করে জাতিসংঘের এ নতুন প্রতিবেদনে ‘বিনা অভিযোগে বা রিমান্ডে থাকা শিশুদের উচ্চ অনুপাত’-এর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
সেখানে বলা হয়েছে, ইসরায়েল কর্র্তৃক আরোপিত ফৌজদারি দায়বদ্ধতার বয়স ১২ বছর। অথচ ইসরায়েলি কারাগারে ১২ বছরের কম বয়সী শিশুদেরও আটক রাখা হয়েছে। নির্যাতনের বিরুদ্ধে ১৯৮৪ সালের জাতিসংঘ কনভেনশন বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ কমিটি আরও যুক্তি দেয় যে, অধিকৃত ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি নীতির দৈনিক আরোপ, সামগ্রিকভাবে, ‘নির্যাতনের সমান হতে পারে’। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘গাজা যুদ্ধের সময় ৭৫ জন ফিলিস্তিনি তাদের হেফাজতে থাকা অবস্থায় মারা গেছেন। যে সময় ফিলিস্তিনিদের জন্য আটক অবস্থার ‘উল্লেখযোগ্য অবনতি’ ঘটেছিল। এতে দেখা গেছে, মৃতের সংখ্যা ‘অস্বাভাবিকভাবে বেশি এবং মনে হচ্ছে এটি শুধু ফিলিস্তিনি বন্দি জনসংখ্যার ওপর প্রভাব ফেলেছে।'
যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের পরিসংখ্যান : ২০২৫ সালের ১০ অক্টোবর গাজায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর থেকে, ইসরায়েল প্রায় প্রতিদিনই হামলা চালিয়ে চুক্তি লঙ্ঘন করেছে, শত শত মানুষ নিহত হয়েছে। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, ১০ অক্টোবর থেকে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত ইসরায়েল কমপক্ষে ৪৯৭ বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে, বিমান, কামান এবং সরাসরি গুলি চালিয়েছে। অফিস জানিয়েছে, ইসরায়েল ১৪২ বার বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গুলি চালিয়েছে, ‘হলুদ রেখা’ অতিক্রম করে আবাসিক এলাকায় ২১ বার অভিযান চালিয়েছে। হলুদ রেখা হলো একটি নতুন সীমানা বা সীমারেখা, যা যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর গাজার জন্য নির্ধারিত হয়েছে। এই সীমারেখা গাজাকে দুটি অঞ্চলে এ ভাগ করেছে। এর একদিকে এমন অংশ যা ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে, অন্যদিকে এমন অংশ যেখানে কমবেশি ফিলিস্তিনি নিয়ন্ত্রণ থাকবে। অথচ ইসরায়েল সব উপেক্ষা করে গাজায় ২২৮ বার বোমা ও গোলাবর্ষণ করেছে এবং ১০০ বার মানুষের সম্পত্তি ধ্বংস করেছে। এতে আরও বলা হয়েছে, ইসরায়েল গত মাসে গাজা থেকে ৩৫ জন ফিলিস্তিনিকে আটক করেছে। গুরুত্বপূর্ণ মানবিক সহায়তা আটকে রেখেছে, ঘরবাড়ি ও অবকাঠামো ধ্বংস করেছে। ২৯ সেপ্টেম্বর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যামূলক যুদ্ধের অবসান, ছিটমহলে আটক অবশিষ্ট বন্দিদের মুক্তি, অবরুদ্ধ অঞ্চলে মানবিক সাহায্যের পূর্ণ প্রবেশাধিকার এবং ইসরায়েলি বাহিনীর তিন-পর্যায়ের প্রত্যাহারের রূপরেখা তৈরির জন্য ২০-দফা প্রস্তাব উন্মোচন করে। প্রথম পর্যায়ের চলমান কিছু প্রধান শর্তের মধ্যে রয়েছে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে গাজায় যুদ্ধবিরতি, গাজায় সব সাহায্যের অবরোধ তুলে নেওয়া এবং সাহায্য বিতরণে হস্তক্ষেপ বন্ধ করা, হামাসের হাতে গাজায় আটক সব বন্দিকে জীবিত বা মৃত অবস্থায় মুক্তি দেওয়া, ইসরায়েলি কারাগার থেকে প্রায় ২ হাজার ফিলিস্তিনি বন্দি এবং নিখোঁজ ব্যক্তিদের মুক্তি, ইসরায়েলি বাহিনীকে ‘হলুদ রেখায়’ প্রত্যাহার।
আল জাজিরার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সবশেষ ৪৮ দিনের যুদ্ধবিরতির মধ্যে ৩৯ দিনেই গাজায় হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। মাত্র আট দিনের কিছু বেশি সময় কোনো সহিংস হামলা, নিহত বা আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। অথচ যুক্তরাষ্ট্র জোর দিয়ে বলছে যে, ‘যুদ্ধবিরতি’ চলছে। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১০ অক্টোবর দুপুরে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ইসরায়েল কমপক্ষে ৩৪৭ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। হামলায় ৮৮৯ জন আহত হয়েছে। ১৯ এবং ২৯ অক্টোবর সর্বশেষ যুদ্ধবিরতির পর থেকে দুটি মারাত্মক দিন, ইসরায়েল মোট ১৫৪ জনকে হত্যা করে।
১৯ অক্টোবর, রাফায় দুই ইসরায়েলি সৈন্য নিহত হওয়ার পর হামাসকে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগে ইসরায়েলি বাহিনী গাজা উপত্যকা জুড়ে ব্যাপক বিমান হামলায় ৪৫ জনকে হত্যা করে। হামাসের সশস্ত্র শাখা আল কাসসাম ব্রিগেড উল্লেখ করেছে যে, রাফাহ এলাকা ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে এবং সেখানে কোনো ফিলিস্তিনি যোদ্ধার সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। ২৯ অক্টোবর, রাফায় বন্দুকযুদ্ধের পর ইসরায়েল ৫২ জন শিশুসহ ১০৯ জনকে হত্যা করে, যেখানে একজন ইসরায়েলি সৈন্য নিহত হয়। সৈন্যের মৃত্যুর ‘প্রতিশোধ’ নিতেই ‘ইসরায়েলিরা পাল্টা হামলা চালিয়েছে বলে সেদিন সাংবাদিকদের জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২২ নভেম্বর, উত্তর ও মধ্য গাজা জুড়ে ইসরায়েলি ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ২১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন আরও কয়েক ডজন আহত হয়েছেন।
গাজায় ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত হতাহতের সংখ্যা পর্যবেক্ষণ করে নিহতদের সংখ্যা নিশ্চিত করা হয়েছে ২০ হাজার ১৭৯ শিশুসহ কমপক্ষে ৬৯ হজার ৭৮৫ জন। আহত কমপক্ষে ১ লাখ ৭০ হাজার ৯৬৫ জন। যুদ্ধবিরতিতে বলা হয়েছিল যে, ‘পূর্ণ সাহায্য অবিলম্বে গাজা উপত্যকায় পাঠানো হবে’। তবে বাস্তবতা এখনো সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির তথ্য অনুসারে, বর্তমানে প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তার মাত্র অর্ধেক গাজায় পৌঁছাচ্ছে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি ত্রাণ সংস্থাগুলোর একটি জোট বলছে যে যুদ্ধবিরতির অধীনে সম্মত হওয়া সাহায্যের মাত্র এক-চতুর্থাংশ। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ১০ অক্টোবর থেকে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত, গাজার অভ্যন্তরে মাত্র ৫ হাজার ৪৫৮টি ট্রাক তাদের নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছেছে। যা গাজায় মানবিক সহায়তা পর্যবেক্ষণ করে। ট্রাক চালকদের মতে, সাহায্য সরবরাহে দেরি হওয়ার কারণ ইসরায়েলি চেকিংয়ে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি সময় লেগেছে।
এ ছাড়াও ইসরায়েল মাংস, দুগ্ধজাত পণ্য এবং শাকসবজিসহ প্রয়োজনীয় এবং পুষ্টিকর খাদ্যসামগ্রী আটকে দিয়েছে, যা সুষম খাদ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর পরিবর্তে পুষ্টিকর নয়, এমন খাবার যেমন স্ন্যাকস, চকলেট, চিপস এবং কোমল পানীয় গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। ইউনিসেফ সতর্ক করেছে, অক্টোবরে গাজায় ৫ বছরের কম বয়সী প্রায় ৯ হাজার ৩০০ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। উচ্চমাত্রার অপুষ্টি গাজা উপত্যকায় শিশুদের জীবন ও সুস্থতার জন্য হুমকিস্বরূপ, শীতের আবহাওয়ার সূত্রপাত রোগের বিস্তারকে ত্বরান্বিত করে এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের মধ্যে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়। সংস্থাটি জানিয়েছে, গাজার সীমান্তে প্রচুর পরিমাণে শীতকালীন সরবরাহ আটকে আছে। এই অঞ্চলে নিরাপদ, দ্রুত এবং বাধাহীনভাবে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।