কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বিশ্ব বাণিজ্যে রূপান্তর অর্থনৈতিক উন্নয়নের বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির হচ্ছে

পিনেলোপি কাউজিয়ানু গোল্ডবার্গ, মিশেল রুটা । সূত্র : বণিক বার্তা, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫

বিশ্ব বাণিজ্যে রূপান্তর অর্থনৈতিক উন্নয়নের বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির হচ্ছে

তিনটি বড় ধরনের পরিবর্তনের ফলে বিশ্ব বাণিজ্য গভীরভাবে রূপান্তরিত হচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি দেশগুলোর তুলনামূলক সুবিধা এবং যে ধরনের পণ্য তারা উৎপাদন ও রফতানি করে তা পুনর্নির্ধারণ করছে। অ্যাক্টিভিস্ট ধাঁচের বাণিজ্য ও শিল্প নীতির পুনরুত্থান বাণিজ্যপ্রবাহ বিঘ্নিত করতে পারে এবং পাল্টাপাল্টি প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা বৃদ্ধি ভূরাজনৈতিক রেখা বরাবর বিশ্ব অর্থনীতি দ্বিধাবিভক্ত করার ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।

 


এ পরিবর্তনগুলোর যৌথ প্রভাব বিশ্ব বাণিজ্যের খোলনলচে পাল্টে দিতে পারে। এতে গত তিন দশকের পরিচিত ক্যানভাস পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। যদিও বর্তমান নীতি বিতর্কের প্রধান প্রপঞ্চ বিশ্বায়নের দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রকৃতি, তবে মূল ফোকাস প্রধানত উন্নত দেশগুলোর প্রয়োজন ও অগ্রাধিকার তোষণ। কিন্তু উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য তা কী ফল নিয়ে আসবে এ প্রশ্ন আড়ালে থেকে যায়।

 

 


এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে উন্নয়ন এগিয়ে নিয়ে যেতে বাণিজ্য ও বিশ্বায়নের ভূমিকা অনুধাবন জরুরি। গত তিন দশকে, অনেক উন্নয়নশীল দেশ রফতানিনির্ভর প্রবৃদ্ধি মডেল অনুসরণ করেছে, যা দ্রুত দক্ষতা বৃদ্ধি ও টেকসই উৎপাদনশীলতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

 

প্রথমত, উন্নয়নশীল এ অর্থনীতিগুলো স্বল্প দক্ষতা, শ্রম-নিবিড় শিল্পোৎপাদন, পর্যাপ্ত শ্রমশক্তির উপস্থিতি এবং অগ্রসর অর্থনীতি থেকে বিনিয়োগের সুযোগ নিয়েছে। বিশ্ববাজার এবং দক্ষতার সঙ্গে পরিচয়ের ফলে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ এবং অর্থনৈতিক বিস্তার সহজ হয়েছে। বাণিজ্যনির্ভর ম্যানুফ্যাকচারিং প্রবৃদ্ধি অন্যান্য খাতেও ছড়িয়ে পড়েছে এবং তা ব্যাপক অর্থনৈতিক অগ্রগতির একটি শক্তিশালী ইঞ্জিন হয়ে ওঠে।

 

 

এটা মানতে হবে, উন্নয়ন হাওয়ার ওপর ঘটে না। ১৯৯০-এর পরবর্তী সময়ে রফতানিনির্ভর প্রবৃদ্ধি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চালকের ওপর নির্ভর করেছিল। এর মধ্যে প্রধান হলো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে অভূতপূর্ব অগ্রগতি, যার ফলে সরবরাহ চেইনে বিশ্বায়নের আঁচ আরো ভালো করে লেগেছিল। উৎপাদন প্রক্রিয়া দক্ষতা অনুযায়ী বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকায় তা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছিল।

 

 

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল কার্যকর নীতিমালা। বহুপাক্ষিকতাবাদের গ্রহণ, উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) সদস্যপদ গ্রহণ এবং উন্নত দেশগুলোর শিল্পনীতির শিথিল ব্যবহার বিশ্ব বাণিজ্য আরো স্পষ্টতর ও উদার হয়েছিল। এদিকে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য চুক্তি বৈদেশিক বাণিজ্য নিরুৎসাহিত করা ঠেকানো এবং কাঠামোগত সংস্কার এগিয়ে নেয়া সহজতর ছিল।

 

 

শেষত স্নায়ুযুদ্ধ শেষে আপাত ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, শান্তি ও পূর্বাভাসযোগ্যতার একটি যুগের সূচনা করেছিল। জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ও রাজনৈতিক ভাবাদর্শ নিয়ে উদ্বেগের চেয়ে অর্থনৈতিক দক্ষতাকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছিল। এ দর্শন বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন মসৃণ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল।

 

 

কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেশ বড় আকারের পরিবর্তন এসেছে। রোবোটিকস, থ্রিডি প্রিন্টিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) আবির্ভাব অর্থনৈতিক উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী ও জটিল প্রভাব রাখতে পারে। যদিও এ প্রযুক্তিগুলোর দ্বারা চালিত অটোমেশনের ঢেউ স্বল্প দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমিকদের চাকরি হারানোর ঝুঁকি তৈরি করেছে। তবে তা অনেক দেশ ও কোম্পানির সামনে সুযোগ নিয়ে এসেছে।

 

 

সম্ভবত আরো গুরুত্বপূর্ণভাবে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি পরিষেবাগুলিকে আরো বেশি বাণিজ্যযোগ্য করে তুলতে পারে, রফতানিনির্ভর প্রবৃদ্ধির জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে, তবে উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জও তৈরি করতে পারে। উৎপাদনের বিপরীতে, ব্যবসায় এবং আইটি পরিষেবাগুলোর জন্য অত্যন্ত দক্ষ কর্মশক্তি প্রয়োজন। এ ধরনের পরিষেবা খাতগুলোকে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিনে রূপান্তরিত করতে সরকারগুলোকে প্রশিক্ষণ এবং কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করতে হবে।

 

 

নীতিমালা ও ভূরাজনীতির পরিবর্তনের বৈশ্বিক বাণিজ্যের জন্য প্রভাব সমানভাবে জটিল। ২০২৩ সালে উন্নত অর্থনীতিগুলো দ্বারা গৃহীত শিল্পনীতিগুলোর প্রায় ২০ শতাংশ ভূরাজনৈতিক এবং জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক বিবেচনায় চালিত হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি (ইভি) এবং সেমিকন্ডাক্টরকে লক্ষ্য করে এমন ব্যবস্থাগুলোকে ভূরাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল অবস্থান থেকে সরবরাহ শৃঙ্খল বৈচিত্র্যকরণের প্রচেষ্টা হিসেবে যুক্তিযুক্ত করা হয়েছিল।

 

 

যদিও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার স্বল্পমেয়াদি প্রভাব নিয়ে গবেষণা চলমান, আমাদের নিজ কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হলো যে এগুলো বাণিজ্যপ্রবাহে মৌলিক পরিবর্তন আনছে। এক্ষেত্রে এর অন্যতম উদাহরণ যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৮ সালে চীন-আমেরিকা বাণিজ্য উত্তেজনা শুরু হওয়ার পর থেকে কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশ আমেরিকান বাজারে গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটি বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের পুনর্গঠন। বিশেষত তৃতীয় দেশের মাধ্যমে চীনে তৈরি মধ্যবর্তী পণ্যের পুনঃসমাবেশের ফল।

 

 

তবে বাণিজ্য উত্তেজনা উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য স্বভাবতই উপকারী নয়। প্রথমত, যে দেশগুলো বাণিজ্যপ্রবাহের পুনর্বিন্যাস থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে, তারা প্রান্তিক বৈশ্বিকীকরণের বাইরে থাকা নিম্ন আয়ের দেশ নয়, বরং তারা এমন দেশ, যারা এরই মধ্যে বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। যেমন মালয়েশিয়া, মেক্সিকো ও ভিয়েতনাম।

 

 

এছাড়া সিমুলেশনগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বে বিভাজনের বিস্তার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে। গত তিন দশকে, মুক্ত বিশ্ববাজারে প্রবেশাধিকার উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এ মডেল থেকে দূরে সরে যাওয়া দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলোর অনেক ক্ষতি করবে। যেহেতু এ দেশগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় বড় অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক বাজারের অভাব রয়েছে।

 

 

স্পষ্টত বিশ্ব অর্থনীতির নয়া ক্যানভাস এখনো রূপ নিচ্ছে। কিন্তু এটি ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে বিশ্বায়নের পরিবর্তনশীল প্রকৃতি গত কয়েক দশকের রফতানিনির্ভর প্রবৃদ্ধির অসাধারণ গল্পের পুনরাবৃত্তি কঠিন করে তুলবে। বিশ্ব বাণিজ্য যে তিনটি বড় ধরনের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা মোকাবেলায় আমাদের বাস্তবমুখী ও দূরদর্শী সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।

 


[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

পিনেলোপি কাউজিয়ানু গোল্ডবার্গ: ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক; বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ এবং আমেরিকান ইকোনমিক রিভিউর সাবেক প্রধান সম্পাদক