কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বিশ্ব অর্থনীতি : ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধে মূল্য চুকাবে গ্লোবাল সাউথ

জয়তী ঘোষ। সূত্র : বণিক বার্তা, ০৩ মে ২০২৫

বিশ্ব অর্থনীতি : ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধে মূল্য চুকাবে গ্লোবাল সাউথ

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এক গভীর সংকট ডেকে এনেছে। বিশ্বজুড়ে শেয়ার ও বন্ড মার্কেটে চরম অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

 

 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এক গভীর সংকট ডেকে এনেছে। বিশ্বজুড়ে শেয়ার ও বন্ড মার্কেটে চরম অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে যেসব নিম্ন আয়ের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির ওপর নির্ভরশীল, তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, এ সিদ্ধান্তের ফলে মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দা শুরু হতে পারে। এর প্রভাব পড়বে মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোয়। ট্রাম্পের তাৎক্ষণিক ঘোষিত ‘৯০ দিনের বিরতি’র পর বিশ্ববাজারে যে সাময়িক স্বস্তি এসেছিল, তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। যদিও এ বিরতিতে বেশির ভাগ ‘পাল্টা’ শুল্ক অকার্যকর ছিল। তবে চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ১৪৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়। তবে এ শুল্কনীতির ফলে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ও আর্থিক প্রবাহে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে, তা এখনো গুরুতর ঝুঁকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।

 

 

যদিও কিছু শুল্কে সাময়িক বিরতি দেয়া সত্ত্বেও সব ধরনের আমদানির ওপর যুক্তরাষ্ট্রে ১০ শতাংশ সর্বজনীন শুল্ক এখনো বলবৎ রয়েছে। পাশাপাশি, ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, গাড়ি এবং গাড়ির যন্ত্রাংশের ওপর খাতভিত্তিক ২৫ শতাংশ শুল্ক বহাল রয়েছে। যদিও স্মার্টফোন, কম্পিউটার ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্যের ক্ষেত্রে নতুন ছাড় দেয়া হয়েছে। ট্রাম্প ওষুধ, সেমিকন্ডাক্টর, তামা এবং কাঠের ওপর নতুন শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন। এসব পদক্ষেপের সম্মিলিত প্রভাব পড়বে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি পণ্যের সহজলভ্যতা কমে যাবে, দেশটিতে পণ্যের মূল্য বাড়বে এবং রফতানিকারক দেশগুলোর ওপর আর্থিক চাপ বহুগুণে বাড়বে।

 
 
 

তবে প্রতিটি দেশের ওপর কী পরিমাণ শুল্ক আরোপ করা হবে—তা নির্ভর করবে আলাপ-আলোচনার ওপর। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে কঠোর নীতিতে আলোচনা চালানোর ইঙ্গিত দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই প্রকাশ্যে বলেছেন, অনেক দেশের নেতা তাকে ‘তুষ্ট করতে’ সবকিছু করতে রাজি ছিলেন, শুল্ক প্রত্যাহারের আশায় তারা আমার পেছনে ঘোরাঘুরি করছিলেন।’ ফলে চূড়ান্তভাবে তার শুল্কনীতির পরিধি কী হবে, তা এখনো অনিশ্চিত রয়েছে।

 
 
 

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চীনা পণ্যের ওপর ট্রাম্পের সর্বশেষ শুল্ক বৃদ্ধি কার্যত নিশ্চিত করেছে যে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ আরো দীর্ঘায়িত ও তীব্রতর হতে চলেছে। শুল্কহার ১০৪ থেকে বাড়িয়ে ১৪৫ শতাংশ নির্ধারণ মূলত প্রতীকী পাল্টা পদক্ষেপ। কেননা এর আগের হারেই চীনা পণ্য আমদানি প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। চীন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে শুল্ক বাড়ানোর পর এ পদক্ষেপ নেয়া হয়। বাস্তবে এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসন চীনের সঙ্গে বাণিজ্য কার্যত বন্ধ করার ইঙ্গিতই দিয়েছে।

 

 

চীনা পণ্যের ওপর ট্রাম্পের অব্যাহত অবিশ্বাস এবং শুল্কবৃদ্ধির ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তা ও দেশীয় উৎপাদকরা গভীর সংকটে পড়েছেন। চীনা মালিকানাধীন কারখানার পণ্য, এমনকি তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে আমদানি হলেও সেগুলোকেও ট্রাম্প সন্দেহের চোখে দেখছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশাধিকার বজায় রাখতে আগ্রহী দেশগুলো এখন হন্যে হয়ে বিকল্প উৎস ও উৎপাদন কেন্দ্র খুঁজছে। ফলে বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন খাতে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, যার প্রভাব আরো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

 

 

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম প্রধান অন্তরায় হলো অনিশ্চয়তা। ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিগুলোর অব্যাহত অনিশ্চয়তা—যা হঠাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ, আকস্মিক পাল্টা ঘোষণা ও একবার কার্যকর-আবার বাতিল ধরনের মনোভাবের মাধ্যমে চিহ্নিত—বিনিয়োগ ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রকে প্রায় অচল করে দিয়েছে। প্রচলিত ঝুঁকি মূল্যায়ন মডেলগুলো এ ধরনের নীতিগত অনির্দেশ্যতাকে ধরতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হচ্ছে। ট্রাম্পের ‘আচমকা চমকে দেয়ার’ ধাঁচের কৌশল, যা অনেকটা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মতো তথাকথিত ‘শক্তিশালী নেতা’দের স্টাইলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে।

 

 

বাড়তে থাকা অনিশ্চয়তা বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করবে। নানা ধোঁয়াশায় পড়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন প্রকল্প স্থগিত রাখছে এবং পূর্ব নির্ধারিত সম্প্রসারণ পরিকল্পনাও পিছিয়ে দিচ্ছে। পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে বিশ্ব। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে বড় ধরনের ধস নামতে পারে। এটি ট্রাম্পের শুল্কনীতির সরাসরি প্রভাবের বাইরেও বিস্তৃত হতে পারে।

 

 

এর চেয়েও উদ্বেগজনক বিষয় হলো—যুক্তরাষ্ট্র এ বাণিজ্যযুদ্ধে চীনের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারবে না। চীনা সরকার তা স্পষ্টভাবেই জানে এবং দীর্ঘমেয়াদি কৌশলে এগোচ্ছে। এ দুই পরাশক্তির মধ্যে চলমান ‘অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার যুদ্ধ’ যেকোনো সময় বড় ধরনের আর্থিক সংকটে রূপ নিতে পারে বা আরো ভয়াবহভাবে সামরিক সংঘাতের দিকেও গড়াতে পারে।

 

 

সতর্ক সংকেত এরই মধ্যে বাজতে শুরু করেছে। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিলের চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে, যা মার্কিন আর্থিক নেতৃত্বের ওপর আস্থার অবনমনকে নির্দেশ করে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার, বন্ড এবং ডলারের মূল্য একসঙ্গে কমে যাওয়া আরো গভীর সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে ট্রেজারি বিল কি আদৌ সম্পদের মানদণ্ড হিসেবে কার্যকর থাকবে? যদিও তা এখনো উচ্চমূল্যের আর্থিক লেনদেনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, কিন্তু এর স্থায়িত্ব নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠছে।

 

 

আগের বহু সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের মতো এবারো যুক্তরাষ্ট্র নিজ অর্থনীতিতে ধাক্কা খাবে—এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সবচেয়ে বড় চাপটা গিয়ে পড়বে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর। এরই মধ্যে বাতিল কিংবা বিলম্বিত রফতানি আদেশের কারণে এসব দেশের উৎপাদন খাত দুর্বল হয়ে পড়ছে, বাড়ছে বেকারত্ব। এরই মধ্যে বৈশ্বিক আর্থিক বাজারে অস্থিরতা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করে তুলেছে। যদিও এখনো ট্রাম্পের শুল্কনীতির সম্পূর্ণ প্রভাব পড়তে পারে।

 

 

এ উত্তেজনাকর পরিস্থিতির প্রতিফলন এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সার্বভৌম ঋণপত্রে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরো উদ্বেগজনক। ৯ এপ্রিল পর্যন্ত এক মাসে উদীয়মান বাজারের ডলারে প্রকাশিত ঋণপত্রের মূল্যমান গড়ে ২ দশমিক ৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে গড় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশে। মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, গ্যাবন ও জাম্বিয়ার মতো ঋণ-চাপে জর্জরিত দেশগুলোর বন্ডমূল্য ১০ শতাংশেরও বেশি কমেছে।

 

 

দুর্ভাগ্যক্রমে, উন্নয়নশীল দেশগুলো এ ধরনের আর্থিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে খুবই পরিচিত। বহু দশক ধরে অনেক দেশই মুদ্রার অবমূল্যায়ন, ঋণের খরচ বৃদ্ধি, সরকারি অর্থের সংকট, বাধ্যতামূলক ব্যয় হ্রাস এবং অভ্যন্তরীণ বাজারের অস্থিরতার চক্রে আটকে আছে, যা বিনিয়োগ ও বেসরকারি খাতের কার্যক্রমে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করেছে।

 

 

উন্নয়নশীল দেশের জন্য এ শিক্ষা স্পষ্ট। বৈশ্বিক বাণিজ্য যেমন বিপর্যস্ত হচ্ছে, তেমনি আর্থিক বৈশ্বিকীকরণও এমনভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে যে উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে স্থিতিশীল ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন চাওয়া দেশগুলোর জন্য এটি আরো কম আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।

 

 

ট্রাম্প বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা ভেঙে ফেলার জন্য সংকল্পবদ্ধ, যা তার দৃষ্টিতে অন্য দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সুবিধা নিতে সুযোগ দেয়। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে, অনেক উন্নয়নশীল দেশ তাদের এ অসমতাভিত্তিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ এবং অধীনে থাকা সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা শুরু করবে, যা আর তাদের স্বার্থরক্ষা করছে না। তবে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প গড়ে ওঠা পর্যন্ত সামনে চলার পথ এখনো বিপজ্জনক থাকবে।

 

 

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট-২০২৫]

জয়তী ঘোষ: ম্যাসাচুসেটস এমহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক; দ্য ক্লাব অব রোম’স ট্রান্সফরমেশনাল ইকোনমিকস কমিশনের সদস্য এবং ইনডিপেনডেন্ট কমিশন ফর দ্য রিফর্ম অব ইন্টারন্যাশনাল করপোরেট টেক্সেশনের কো-চেয়ার।

অনুবাদ: দিদারুল হক