ব্রিকসের সদস্য দেশ ব্রাজিল, চীন, ভারত, রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার নেতারা এক নতুন অভিন্ন মুদ্রা প্রচলন নিয়ে ২০২৩ সালে আলোচনা করেন। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা ডা সিলভা ৭৫ বছর ধরে বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারকারী মার্কিন ডলারের বিকল্প মুদ্রা প্রচলনের পক্ষে জোরালো মত দেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন অক্টোবরের ব্রিকস সম্মেলনে একটি প্রতীকী ব্রিকস নোট তুলে ধরে এ ধারণা সমর্থন করেন। আশা করা যাচ্ছে, ব্রিকসের নতুন সদস্য দেশ মিসর, ইথিওপিয়া, ইরান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও এ মুদ্রা গ্রহণ করবে।
এরই মধ্যে মার্কিন ডলারের বিপরীতে ব্রিকস মুদ্রা প্রচলনের প্রস্তাবটি নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে উত্তেজিত করে তুলেছে। ডলারের বিকল্প মুদ্রার প্রচলন বা সমর্থন করা হলে তিনি ব্রিকসের দেশগুলোর ওপর শতভাগ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন। ট্রাম্প তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে সতর্ক করে বলেন, ‘আমরা চাই ব্রিকস দেশগুলো অঙ্গীকার করুক তারা নতুন ব্রিকস মুদ্রা তৈরি করবে না বা ডলারের বিকল্প কোনো মুদ্রাকে সমর্থন করবে না; নতুবা তাদের শতভাগ শুল্ক প্রদান করতে হবে।’
এর আগেও ট্রাম্প মেক্সিকো ও কানাডার ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক, চীনের পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ শুল্ক এবং অন্যান্য বাণিজ্য অংশীদারদের ওপর ১০ থেকে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন। তবে এসব হুমকি তার ‘স্বঘোষিত’ সফল চুক্তিগুলোর একটিও বাস্তবায়নে সক্ষম হবে না।
ট্রাম্পের বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথা শুনে মনে হয়, তিনি ব্রিকসের মুদ্রাকে বড় হুমকি ভাবছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো ট্রাম্প হুমকি না দিলেও এ ধরনের উদ্যোগের বাস্তবায়ন হওয়ার সম্ভাবনা কম।
যদি প্রস্তাবিত মুদ্রা ব্রিকস দেশগুলোর জাতীয় মুদ্রার পাশাপাশি প্রচলিত থাকে, তবে তা জনপ্রিয় হবে না। সফল আন্তর্জাতিক মুদ্রা হতে হলে একটি মুদ্রার অবশ্যই জাতীয় মুদ্রা হওয়াটা জরুরি। যেমন ইংরেজি ভাষা বিশ্বব্যাপী লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা (সর্বজন ব্যবহারযোগ্য ভাষা) হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেলেও এস্পেরান্তো (ইউরোপের সাধারণ একটি লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা গড়ে তুলতে মহাদেশটির ভাষাগুলোর নির্যাস নিয়ে গঠিত নতুন একটি ভাষা) পায়নি। ঠিক তেমনই আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) রিজার্ভ অ্যাসেট [সংরক্ষিত সম্পদ] এসডিআর আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে সফল হতে পারেনি, কারণ এর মান বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রার ওপর নির্ভরশীল।
প্রস্তাবিত ব্রিকস মুদ্রাকে মার্কিন ডলারের প্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলতে হলে ব্রিকস সদস্য দেশগুলোকে নিজেদের জাতীয় মুদ্রা বাদ দিয়ে একটি একক মুদ্রা চালু করতে হবে। পাশাপাশি এ মুদ্রা পরিচালনার জন্য একটি অভিন্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংক গঠন করাও জরুরি।
অথচ ব্রিকসে প্রতিটি দেশের অর্থনীতির ধরন অন্যটির চেয়ে ভিন্ন। মুদ্রাভিত্তিক জোট গড়ে তোলা তাই কঠিন বলা যায়। এ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় কেবল আকারে ছোট ও পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত অর্থনীতিগুলোর মধ্যে। এসব দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন হয় সবচেয়ে বেশি। আবার এসব দেশের অভিন্ন লক্ষ্য, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও তুলনামূলকভাবে সমন্বিত শ্রমবাজারও থাকে।
যদি সদস্য দেশগুলোর অর্থনীতিতে ভিন্নতার মাত্রা বেশি হয়, তখন এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের পর কোনো কোনো দেশ মন্দায় পড়তে পারে। আবার অন্যান্য দেশেও অতিরিক্ত উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। মুদ্রা জোটের সদস্য দেশগুলোকে নিজস্ব অর্থ সরবরাহ, সুদহার ও বিনিময় হারের ওপর নিয়ন্ত্রণ ত্যাগ করতে হয়। এতে তাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা দূর করার ক্ষমতাও সীমিত হয়ে আসে। শ্রমশক্তি বাড়ানো বা শক্ত রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি না থাকলে দেশগুলোর ভিন্নতা বড় ধরনের দ্বন্দ্ব এবং অনাকাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এখন পর্যন্ত সাধারণ মুদ্রা প্রচলনের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারা জোটগুলোর মধ্যে অন্যতম পশ্চিম আফ্রিকা ও মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত সিএফএ ফ্রাংক জোন। আঞ্চলিক মুদ্রাটির বিনিময় হারকে ইউরোর ওঠানামার সঙ্গে সংযুক্ত করা রয়েছে। এমন আরেক জোট ইস্টার্ন ক্যারিবিয়ান কারেন্সি ইউনিয়ন। এর সদস্য দেশগুলো হলো অ্যাঙ্গোলা, অ্যান্টিগা ও বারবুডার মতো ইংরেজি ভাষাভাষী ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্রগুলো। জোটগুলো কার্যকর। কারণ তাদের সদস্য দেশগুলো ছোট, কাছাকাছি অবস্থিত এবং সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিকভাবে সম্পর্কযুক্ত। যেমন সিএফএর সবচেয়ে বড় সদস্য আইভরি কোস্টের জিডিপি নিউইয়র্কের বাফেলো শহরের চেয়েও ছোট।
এক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো ব্যতিক্রম উদাহরণ ইউরো অঞ্চল। ২০ দেশের এ জোটে যদিও অনেকগুলো বৃহৎ অর্থনীতি আছে, কিন্তু সেগুলো পারস্পরিকভাবে সম্পৃক্ত। তাদের সীমানা যেমন সংযুক্ত, তেমনি তাদের অর্থনীতিও। শান্তিপূর্ণ ও ঐকবদ্ধ ইউরোপ গড়ে তোলার বিষয়েও দৃঢ় অঙ্গীকার রয়েছে দেশগুলোর। যদিও যুক্তরাজ্য, সুইডেন ও নরওয়ে ইউরোজোনের বাইরে থাকার বিষয়টি বেছে নিয়েছে এবং গ্রিসের মতো প্রান্তিক দেশগুলো ইউরোর আর্থিক শৃঙ্খলার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে।
কিছু আঞ্চলিক ব্লক অনেক দিন ধরে একটি সাধারণ মুদ্রা প্রচলনের কথা আলোচনা করে এলেও তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। ২০০১ সালে ছয় সদস্যবিশিষ্ট গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) ২০১০ সালের মধ্যে একটি মুদ্রা জোট প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি। এমনকি আকারে ছোট, সাংস্কৃতিকভাবে একই রকম এবং একে অন্যের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত দেশগুলোও তাদের আর্থিক সার্বভৌমত্ব ছাড়তে রাজি হয়নি। সে তুলনায় প্রস্তাবিত ব্রিকস মুদ্রার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
ব্রিকসের অন্তর্ভুক্ত অনেক দেশই আকারে বড়। জোটটি চার মহাদেশে বিস্তৃত। এসব দেশের মানুষ বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। এছাড়া তাদের সীমান্তগুলো ঐতিহাসিকভাবেই অর্থনৈতিক সংযোগ গড়ে তোলার চেয়ে সংঘাত সৃষ্টি করেছে বেশি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় চীন ও ভারতের কথা। হিমালয় সীমান্তে দীর্ঘকাল সামরিক বাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা ছিল। অক্টোবরে তারা কোনোমতে একটি শান্তি চুক্তিতে পৌঁছেছে।
ব্রিকস দেশগুলোর ব্যবসায়িক চক্রগুলোর মধ্যে কোনো সংযোগ নেই। বিশ্বব্যাপী জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি তেল উৎপাদক দেশ রাশিয়া, ব্রাজিল, ইরান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্য লাভজনক হলেও আমদানিকারক দেশ চীন ও ভারত চাপের মধ্যে থাকে। এ পরিস্থিতি ব্রিকস দেশগুলোর জন্য একটি অভিন্ন মুদ্রা জোট গড়ে তোলার ক্ষেত্রে জিসিসি দেশগুলোর ক্ষেত্রের চেয়েও বড় বাধা।
এটি সত্য, বিশ্বব্যাপী ডলারের চাহিদা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া ধীর হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এটি গতি সঞ্চার করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বারবার আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপও উল্লেখযোগ্যভাবে এ প্রক্রিয়াকে গতিশীল করেছে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন ব্রিকস দেশগুলোর বিরুদ্ধে শতভাগ শুল্ক আরোপ করলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বরং তাদের আন্তর্জাতিক রিজার্ভ হিসেবে রেনমিনবি (ইউয়ান), স্বল্প মানের মুদ্রা, এমনকি স্বর্ণ মজুদের দিকেও ঝুঁকতে বাধ্য হতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প রেনমিনবি এবং অন্যান্য যেসব মুদ্রা ব্যবহারকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যে উদ্বৃত্তে রয়েছে, ডলারের বিনিময় হার কমানোর মাধ্যমে সেগুলোর সঙ্গে মার্কিন বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর কথা বলছেন। আবার এ ধরনের লক্ষ্যের সঙ্গে ডলারের আন্তর্জাতিক ব্যবহারকে কাজে লাগানোর যেসব প্রয়াস নেয়ার কথা তিনি বলছেন, সেগুলোও খুব একটা যায় না। বরং ডলারের বিনিময় হার কমানোর বক্তব্যটি ট্রাম্পের যেসব প্রতিশ্রুতি মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে পারে, সেগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন তার ফেডের স্বাধীনতা খর্বের হুমকি বা অভিবাসীদের গণহারে প্রত্যাবাসনের প্রস্তাব। তবে ডলারের মতো মূল্যস্ফীতির বাড়তি ঝুঁকিতে থাকা একটি মুদ্রা, যা একই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রিজার্ভ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়; সেটির বিনিময় হার কমানোর চিন্তাটি খুব একটা চিত্তাকর্ষক না। মোদ্দা কথা হলো ট্রাম্পের ট্যারিফ সংক্রান্ত হুমকিগুলো বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে খুব একটা কাজে আসবে না।
জেফরি ফ্রাঙ্কেল: হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাপিটাল ফরমেশন ও গ্রোথ বিষয়ক অধ্যাপক; সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের অর্থনৈতিক পরামর্শক পরিষদের সাবেক সদস্য এবং ইউএস ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের গবেষণা সহযোগী
ভাষান্তর: সাবরিনা স্বর্ণা